ইমরান মাহমুদ
প্রতিযোগিতা মানেই উন্নতি, প্রতিযোগিতা মানেই সমৃদ্ধি। এই প্রতিযোগিতা যেমনটা হয় দলীয়ভাবে, ঠিক তেমনি ব্যক্তিগত লড়াইও অনেকাংশে ভালো কিছু বয়ে আনে। সেই হিসেবে বন্ধু তামীমের সঙ্গে সাকিবের লড়াইটা চলছে ভালই। ভালো ছাত্রদের মধ্যে একটা স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা থাকে। কে ফার্স্ট হবে, কে বেশি নম্বর তুলবে। সেটা বাংলাদেশ দলে থাকলেও মন্দ কী! দেশের হয়ে তিন ভার্সনের ওয়ানডে ক্রিকেটের সব ক’টিতে সর্বোচ্চ রানে বিরল রেকর্ডটা গড়ে ফেলেছেন তামীম ইতোমধ্যে। বন্ধুর সঙ্গে রানের লড়াইয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না ঠিকই, তবে দেশের হয়ে তিন ভার্সনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সব ক’টিতেই সর্বাধিক উইকেটের মালিকানা পেয়ে অনন্য রেকর্ড গড়ে ফেলেছেন সাকিব। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে বাঁ হাতি স্পিনার আবদুর রাজ্জাককে টপকে ২০৮তম উইকেট শিকারের সেই বিরল রেকর্ডটা করে ফেলেছেন সাকিব। সিরিজের প্রথম ম্যাচের এই রেকর্ডেই শেষ হয়ে যায়নি এই বাঁ হাতি স্পিনারের অনন্য অর্জন।
ওয়ানডে ক্রিকেটে এক ভেন্যুতে উইকেটের সেঞ্চুরিতে এতোদিন শুধুই উচ্চারিত হতো সারজা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের নাম। উচ্চারিত হতো পাকিস্তানের দুই লিজেন্ডারি পেস বোলার ওয়াসিম আকরাম এবং ওয়াকার ইউনুসের নাম। সারজায় ৭৭ ম্যাচে ওয়াসিম আকরামের ১২২ উইকেট এবং ৬১ ম্যাচে ওয়াকার ইউনুসের ১১৪ উইকেটের সে কৃতিত্বটা অটুট ছিল ১৪ বছর। ১৯৮৫ সাল থেকে ২০০২Ñএই সময়ের মধ্যে ‘টু’ ডাব্লুউ’র গড়ে ফেলা সেই রেকর্ডে ভাগ বসাতে পারেননি শ্রীলংকান গ্রেট স্পিনার মুরালীধরনও। ১৪ বছর পর এক বাংলাদেশি বোলারের হাত ধরেই বিশ্ব দেখল ওয়ানডে ক্রিকেটে এক ভেন্যুতে উইকেট শিকারের তৃতীয় সেঞ্চুরিয়ানকে। সাকিব আলোয় সারজার পাশে উঠে এলো শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের নাম।
শের-ই-বাংলায় ৯৬ উইকেট নিয়ে আফগানিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে মাঠে নেমেছিলেন সাকিব। নিজের দ্বিতীয় ওভারেই নেন দুই উইকেট। প্রথম স্পেলে উইকেট ছিল ওই দুটিই। পরের স্পেলে পাননি কোনো উইকেট। তৃতীয় স্পেলে ফিরেই আউট করেন বিপজ্জনক মোহাম্মদ শাহজাদকে। এরপর নিজের শেষ ওভারে রশিদ খানকে এলবিডব্লিউ করে স্পর্শ করেন এই মাঠে উইকেটের শতক। এই ভেন্যুর অভিষেক থেকেই সাকিব দ্যুতি দেখছে বিশ্ব। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে চিগুম্বুরাকে বোল্ড আউটে সেই যে শুরু সাকিবের শিকার, তা বেড়ে তিন অংকে রূপ পেলো গত পরশু। মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে এই মাইলফলকে পৌছে যেতে সাকিবের দরকার ছিল ৪ উইকেট, ৪ স্পেলের বোলিংয়ে সে লক্ষ্যটাই পূর্ন হয়েছে তার (৪/৪৭)। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের একমাত্র ৫ উইকেট পেয়েছেন এই মিরপুরেই। সাকিব সাফল্যে এক ভেন্যুতে সর্বাধিক উইকেট শিকারের রেকর্ডটাও বুঝি অপেক্ষা করছে এখন। ওয়াকার ইউনুসকে টপকে যেতে প্রিয় ভেন্যুতে এখন অপেক্ষা তার ১৫ উইকেট, ওয়াসিম আকরামকে ছাড়িয়ে বিশ্ব রেকর্ডে অপেক্ষা তার ২৩ উইকেট। সেরা পাঁচে সাকিব ছাড়া আছেন বাংলাদেশের আরও একজন। শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামেই ৫৩ ম্যাচে ৭৭ উইকেট নিয়েছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। শারজাহতে ৪৫ ম্যাচে ৮২ উইকেট নিয়ে চার নম্বরে মুত্তিয়া মুরালিধরন। মাশরাফির ঠিক পরেই আছেন আব্দুর রাজ্জাক। শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামেই ৫২ ম্যাচে ৭৫ উইকেট রাজ্জাকের। কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে ৫৭ ম্যাচে ৭৫ উইকেট মুরালিধরনের।
তবে আফগানিস্তানের কাছে হারে সাকিবের আরেকটি কৃতিত্ব পড়েছে ঢাকা। তিন ফরমেটের ক্রিকেট মিলে এক ভেন্যুতে সর্বাধিক রানের বিশ্ব রেকর্ড দীর্ঘদিন অটুট ছিল অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের। ১৯৯৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত টেস্ট, ওয়ানডে, টি-২০ মিলে ৫৭ ম্যাচে ১১ সেঞ্চুরি ২২ ফিফটিতে ৩৪৬৭ রানে এক ভেন্যুতে সর্বাধিক অন্তর্জাতিক রানের সেই রেকর্ডটি আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে টপকে যাচ্ছেন সাকিব,সিরিজকে সামনে রেখে সে আভাসই ছিল। সিরিজের প্রথম ম্যাচেই পন্টিংকে টপকে বিশ্বরেকর্ডটা হতে পারতো সাকিবের। তবে ৪৮তম ওভারে দৌলত জাদরানের বলে মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়ে ৪৮ রানে সাকিব ফিরে আসায় বেড়েছে প্রতীক্ষা। সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে প্রথম রানটির সঙ্গে সঙ্গেই পন্টিংকে টপকে গেলেন সাকিব। মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে টেস্ট, ওয়ানডে, টি-২০ মিলে ৯৮তম ম্যাচে এসে ৩৪৮১ রানে এক ভেন্যুতে রান সংগ্রহে সবাইকে টপকে করেছেন বিশ্বরেকর্ড।
নিজেকে বরাবরই ব্যাটিং অলরাউন্ডার ভেবে এসেছেন সাকিব। বোলিংয়ের চেয়ে ব্যাটিংয়ের বেশি আগ্রহ তাঁর। একটা সময় তো মনে হচ্ছিল, ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের সবগুলো রেকর্ড সাকিবের হয়ে যাবে। কিন্তু রান তোলার গতি হঠাৎ দ্রুত বাড়িয়ে দিয়ে দৃশ্যপটে চলে এলেন তামিম ইকবাল। যে তামিমের কাছেই এখন বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের সবগুলো মূল রেকর্ড।
অথচ গত বছর ফেব্রুয়ারিতেও সাকিব ছিলেন শীর্ষে। বিশ্বকাপ চলার সময়েই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ওয়ানডেতে ৪ হাজার রানের মাইলফলক পেরিয়েছেন সাকিব। আফগানিস্তানের বিপক্ষে মানুকা ওভালের সেই ম্যাচের পর ওয়ানডেতে সাকিবের মোট রান ছিল ৪০৪০, তামিমের তখনো ৩৯৯০। বিশ্বকাপ থেকেই বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেটের অবিশ্বাস্য উত্থানে সাকিব ধীরে ধীরে আড়ালে সরে যেতে থাকেন। দলে অনেক নতুন পারফরমারের আবির্ভাব, সেই সঙ্গে তামিম-মাহমুদউল্লাহদের মতো অভিজ্ঞদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া সাকিবের কাঁধ থেকে অনেকটা চাপ সরিয়ে নেয়।
এই সময়েই সাকিবকে পেরিয়ে যেতে থাকেন তামিম। বিশ্বকাপ পর্যন্তও সাকিবই ছিলেন ওয়ানডে রানে তামিমের চেয়ে এগিয়ে। ভারতের বিপক্ষে সেই আলোচিত কোয়ার্টার ফাইনাল শেষে সাকিবের রান ৪১৭৩, তামিমের ৪১২৫। বিশ্বকাপের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে তিন ওয়ানডেতে ১৩২, অপরাজিত ১১৬ ও ৬৪ রানের তিনটি ইনিংসে সাকিবকে এই লড়াইয়ে সেই যে পেছনে ফেললেন, তখন থেকে তামিমই শীর্ষে।
এমনকি টেস্টেও দুজনের লড়াইটা ছিল সমানে-সমান। ২০১৩ সালের অক্টোবরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টটি দারুণ এক অবস্থানে এনে দাঁড় করায় দুজনকে। ওই টেস্ট শেষে তামিমের রান ছিল ২০৫৬, সাকিবের ২০৫৩। ২০১৪-র অক্টোবর-নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন টেস্ট সিরিজের সময়ও দুজন ছিলেন কাছাকাছি। ওই সিরিজে প্রথম টেস্ট শেষে তামিমের রান ২৪৪০, দ্বিতীয় টেস্ট শেষে সাকিবের রান ২৪৪১। গত ছয়-সাতটি টেস্টেই সেই ব্যবধান বাড়িয়ে নিলেন তামিম। সাকিবের (২৮২৩) চেয়ে টেস্টে এখন তামিমের (৩১১৮) রানের ব্যবধান ২৯৫।
এক ভেন্যুতে তিন ভার্সনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৩ হাজার ক্লাবের সদস্যপদে সাকিব ছাড়াও আছেন তামীম। চলমান ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দু’টি ম্যাচে প্রেমাদাসায় ৮১ ম্যাচে জয়সুরিয়ার করা ৩১৪৬ রানকে টপকে মিরপুরে এখন তামীমের রানের সমষ্টি ৩২১৮। এক ভেন্যুতে সর্বাধিক রানে তার সামনে এখন সিংহলীজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে মাহেলা জয়বর্ধনের ৩৪৪১, মেলবোর্নে রিকি পন্টিংয়ের ৩৪৬৭ এবং মিরপুরে সাকিবের ৩৪৮১ রান। এক ভেন্যুতে তৃতীয় তিন হাজারী ক্লাবের সদস্য পদের হাতছানি এখন দিচ্ছে মুশফিকুর রহিমের। এই লক্ষ্য পূরনে অপেক্ষা এখন তার ৬৪ রান।
এই আফগানিস্তান সিরিজটি না দিয়েও দিয়েছে অনেক কিছু। প্রথম ওয়ানডেতে তিন ধরনের ক্রিকেটে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ৯ হাজার রান পূর্ণ করেছেন তামিম ইকবাল। তাঁর টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির মোট রান এখন ৯০৬৫। ৮৯তম ব্যাটসম্যান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই মাইলফলক পেরোলেন তামিম। মোট রানে গতকালই তামিম পেরিয়ে গেছেন কপিল দেবকে। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে সাকিব, মোসাদ্দেক কীর্তি। এরই মধ্যে তিন ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে বাংলাদেশ মোট রানে ১ লাখের মাইলফলক পেরিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ৪৬৮ ম্যাচে বাংলাদেশের রান ১ লাখ ১০ হাজার ৭৮০। এর মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা ব্যাটে তুলেছেন ১ লাখ ২ হাজার ৬৯৩ রান। বাকি ৮ হাজার ৮৭ রান এসেছে এক্সট্রা থেকে।
তামিমের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮ হাজার ৩৭২ রান এসেছে সাকিব আল হাসানের ব্যাট থেকে। মজার ব্যাপার হলো, তৃতীয় সর্বোচ্চ রান বাংলাদেশ কিন্তু পেয়েছে মিস্টার এক্সট্রার কাছ থেকে। আর কেউ যে ৮ হাজার রান দিতে পারেনি বাংলাদেশকে। ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তামিম-সাকিবের পরে ৭ হাজার ২৭৯ রান নিয়ে তিনে আছেন মুশফিকুর রহিম।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১ লাখ ৭০ হাজার ২৭৪টি বল খেলে এতগুলো রান তুলেছে বাংলাদেশ। উইকেট পড়েছে ৪ হাজার ৬৪৯টি।
১,১০,৭৮০ রানের মধ্যে বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেট থেকে পেয়েছে ৪১ হাজার ৬৯৭ রান। ওয়ানডে থেকে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার ৬৫৬ রান। আর টি-টোয়েন্টি থেকে পেয়েছে ৮ হাজার ৪২৭ রান। ওয়ানডেতে শততম জয়ের প্রত্যাশায় মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। সেটি হয়নি। তবে সাকিবের এই ‘সেঞ্চুরি’ই বা কম কি-সে!
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন