১৮৭২ সালে চীনের চিং রাজবংশের সেনাপতি এবং কর্মকর্তা লি হংঝাং, যিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় প্রায় ধ্বংস প্রাপ্ত সাম্রাজ্যকে সংস্কারের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন, চীনা জাহাজ নির্মাণে অধিক বিনিয়োগের পক্ষে একটি স্মারকলিপিতে লিখেছিলেন, ‘চীন তিন হাজার বছরের অদেখা বড় ধরনের পরিবর্তন অবলোকন করছে।’ এই বিখ্যাত ও ব্যাপক ব্যবহৃত লাইনটি অনেক চীনা জাতীয়তাবাদীদের কাছে নিজের দেশের ওপর পশ্চিমা আগ্রাসনের স্মারক।
চীনের স্নায়ূযুদ্ধ পরবর্তী একটি নতুন পর্বে প্রবেশের জন্য লি’র লাইনটিকে নতুন আঙ্গিকে ব্যবহার করেছেন দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ২০১৭ সাল থেকে শি চীনের অনেক সমালোচনামূলক পররাষ্ট্র নীতির জবাবে ঘোষণা করেছেন যে, বিশ্ব এক শতাব্দীর অদেখা বড় পরিবর্তনগুলোর মধ্যে রয়েছে। কিন্তু লি এবং শি উভয়ের কথাতেই একটি অভিন্ন বার্তা রয়েছে, ‘অভ‚তপূর্ব ভ‚ -রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে বিশ্বশৃঙ্খলা আবারও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং এর জন্য কৌশলগত সমন্বয় প্রয়োজন।’
যদি লি’র লাইন চীনের প্রতি সর্বোচ্চ অপমনকে চিহ্নিত করে, তবে শি তা থেকে উত্তোরণের একটি উপলক্ষ চিহ্নিত করে। লি কথা যদি বিষাদ উস্কে দেয়, তাহলে শি কথাটি ইতিবাচক সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। আমেরিকান সাংবাদিক এবং লেখক ইভান ওসনোস যুক্তি দিয়েছেন, ‘চীন অনেক বড় শক্তিগুলোর মতো শুধুমাত্র আঞ্চলিক প্রভাব খোঁজে না, বরং এটি একবিংশ শতাব্দীকে আকার দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, যেমন যুক্তরাষ্ট্র বিংশ শতাব্দীকে আকার দিয়েছে’।
১৯৮৯-২০০৮ সাল পর্যন্ত বিশে^ নতুন করে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় চীনের প্রথম কৌশল ছিল, নিরবে আমেরিকান শক্তিকে ভোঁতা করে দেয়া; বিশেষ করে এশিয়া। এরপর তিয়ানানমেন স্কোয়ার, উপসাগরীয় যুদ্ধ এবং সোভিয়েত পতনের ঘটনাগুলোর পর মার্কিন হুমকির বিরুদ্ধে বেইজিং তার শক্তি দ্রæত বাড়িয়ে তোলে। চীনের দ্বিতীয় কৌশল ছিল এশিয়ায় আঞ্চলিক আধিপত্যের ভিত্তি তৈরি করা। ২০০০-২০১১ সালের মধ্যে গেøাবাল ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস-এ বেইজিং মার্কিন শক্তিকে হ্রাস পর্যবেক্ষণ করেছে এবং নিজেকে মেলে ধরতে আরও আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত হয়েছে।
এখন ব্রেক্সিট, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচন এবং করোনাভাইরাস মহামারীর পর ‘এক শতাব্দীতে অদেখা পরিবর্তনগুলো’র আহŸান নিয়ে চীন বিশ^ নেতৃত্বের শীর্ষে পৌঁছানোর তৃতীয় কৌশল অবলম্বন করছে, বিশ্ব নেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থার বদলে দিতে পারে। বর্তমান চীন ২০৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদাপনের মধ্য দিয়ে ‘জাতীগত পুনরুজ্জীবনের’ লক্ষ্য অর্জন করতে প্রস্তুত।
আঞ্চলিক পর্যায়ে, চীন ইতিমধ্যে এশিয়ান জিডিপির অর্ধেকেরও বেশি এবং এশিয়ার সামরিক ব্যয়ের অর্ধেকেরও বেশি। একটি সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত করা চীনা আধিপত্য একসময় জাপান এবং কোরিয়া থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার, আমেরিকান আঞ্চলিক জোটের অবসান, পশ্চিমা প্রশান্ত মহাসাগর থেকে মার্কিন নৌবাহিনীকে কার্যকরভাবে অপসারণ, চীনের আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সম্মতি আদায়, তাইওয়ানের সাথে একীকরণ এবং পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে আঞ্চলিক বিরোধের সমাধান অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
চীনের আধিপত্যের স্বপ্ন দেশটির ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ এবং এর ‘কমিউনিটি অব কমন ডেসটিনি’র মাধ্যমে বাস্তবায়িত করা হবে। একসময় এশিয়ায় সীমাবদ্ধ আধিপত্য এখন বিশ্ব ব্যবস্থা এবং এর ভবিষ্যতের উপর আধিপত্য করতে চলেছে। যদি আধিপত্য কায়েমের দুটি পথ থাকে, তাহলে একটি আঞ্চলিক এবং একটি বিশ্বজনীন। চীন এখন উভয়ই অনুসরণ করছে। অর্থনৈতিকভাবে, এটি মার্কিন আধিপত্যের অধীনে থাকা আর্থিক সুবিধাগুলোকে দুর্বল করে দেবে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং পর্যন্ত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবে।
সামরিকভাবে, পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) বিশ্বব্যাপী ঘাঁটি নিয়ে একটি বিশ্বমানের বাহিনী তৈরি করছে যা বেশিরভাগ স্থানে এমনকি মহাকাশ, মেরু এবং গভীর সমুদ্রের মতো নতুন অঞ্চলে চীনের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। প্রায় এক শতাব্দী আগের হিং¯্রতা, বিশৃঙ্খলা এবং আফিমের ব্যাপক আসক্ত চীন এখন চীন বৈশ্বিক বাণিজ্যের শীর্ষে রয়েছে এবং নিজেকে ‘বিশে^র কারখানা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।’
সম্ভাব্য চীনা আধিপত্যের এই ঝলকটি সম্ভবত আকর্ষণীয়, তবে এটি অবাক হওয়ার মতো নয়। এক দশক আগে, আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক লি কুয়ান ইয়ুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘চীনা নেতারা কি এশিয়া এবং বিশ্বের এক নম্বর শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে স্থানচ্যুত করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ?’ কুয়ান জোর দিয়ে হ্যাঁ বললেন। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই। কেন না?’ কুয়ান বলেন, ‘তারা একটি অলৌকিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি দরিদ্র সমাজকে রূপান্তরিত করেছে, যা এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হতে যাচ্ছে।’
কুয়ান বলেন, ‘১.৩ বিলিয়ন লোক, যার একটি বিশাল এবং খুব প্রতিভাবান অংশ রয়েছে, তারা ৪ হাজার বছরের পুরানো সংস্কৃতির গর্ব করে। তারা কীভাবে এশিয়া এবং সময়ের সাথে বিশ্বের এক নম্বর হওয়ার আকাক্সক্ষা করতে পারে না?’ তিনি বলেন যে, চীন ৫০ বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল, এমন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, এমন একটি নাটকীয় রূপান্তরের কেউ আঁচ করতে পারেনি। এবং প্রতিটি চীনা একটি শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ চীন চায়, তারা এমন একটি জাতি যারা আমেরিকা, ইউরোপ এবং জাপানের মতো সমৃদ্ধ, উন্নত এবং প্রযুক্তিগতভাবে সক্ষম।
কুয়ান চীন সম্পর্কে একটি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ভাগ্যের এই পুনরুজ্জীবিত বোধটি একটি শক্তিশালী শক্তি। পশ্চিমের সম্মানিত সদস্য হিসেবে নয়, চীন চীন হতে চায় এবং সেভাবেই রয়েছে। চীন হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এই শতাব্দী ভাগ করে নিতে চায়, সম্ভবত সমান-সমান হিসাবে, কিন্তু অবশ্যই অধঃস্তন হিসাবে নয়।’ সূত্র : বুকিংস, ডেইলি সিগনাল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন