বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সোনালি আসর

মেঘের কোণায় রোদের হাসি

প্রকাশের সময় : ৩ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফ জ লে রা ব্বী দ্বী ন

জিসান সারাদিন খেলাধুলা করে। যখন যাকে পায় জোর করে ধরেই তার সাথে খেলে সময় কাটায়। পড়ার প্রতি এত্তটুকুনও মনোযোগ নেই তার। পড়তে বসলেই মাথার ভিতর এক্কা-দুক্কা, গোল্লাছুটের ভূতগুলো পিটপিট করে হারমোনিয়াম বাজায়। তখন সে চিন্তা করে খেলার প্রতি আরও বেশি মনোযোগ হওয়া দরকার। কেননা গতকালকের খেলাটা হারার পিছনে শুধু তার মনোযোগের অভাবই দায়ী। তা না হলে এত সুন্দর ক্রিকেট মেছটা কি কেউ হারে? মাত্র দু বলে চার রানের দরকার। তাও সে করতে পারল না। ভাবলে এখনও মাথাটা গরম হয়ে যায়। সেদিন অবশ্য লাস্ট বলে সিক্স মারতে গিয়ে কেস আউট হওয়ার পর রাগের মাথায় স্টেম্প ভেঙ্গে ফেলেছিল। যার জন্যই এখনও সে নিষিদ্ধ হয়ে আছে খেলা থেকে। তাতে কি! দুনিয়াতে কি খেলার অভাব আছে নাকি! সকল খেলাতেই সে পাক্কা। খালি পড়ালেখা ছাড়া। প্রায় সময় যদিও ক্রিকেট খেলায় জিরো রানের অত্যাধুনিক পারফরমেন্স দেখিয়ে বিশ্ব রেকর্ড পর্যন্ত গড়ে ফেলে তবুও গল্প করার সময় ম্যান অব দি ম্যাচ হওয়ার প্রশ্ন তোলা ছাড়ে না। কি জন্য আউট হল আর কেনই বা বোলারের বলটা অফ সাইট থেকে লেগ সাইটে গেল অথবা বলটার যেদিকে যাওয়ার কথা ছিল সেদিকে না গিয়ে সোজাসোজি কেনই বা স্টেম্পে এসে লাগল, এসবের সবকিছুরই একটা না একটা কারণ থাকে। যা জিসান বাবু ছাড়া এ অত্র এলাকায় কোন কীটপতঙ্গই ভালোভাবে বলতে পারবে না। খালি কি ক্রিকেট! ফুটবল খেলাতেও সে নাম্বার ওয়ান। খালি মাঝেমধ্যে গোল পোস্টে বল না ছুড়ে গ্যালারিতে থাকা তুমুল আগ্রহে জগধ্বনি করা তিন চারজন মহামান্য দর্শকদের দিকে বল ছুড়ে জানিয়ে দেয়- ‘আমি আসলেই অলরাউন্ডার। খালি গোল পোস্টে না সময়মত সবদিকেই বিশাল বড় বড় কিক মারতে পারি।’
কিছুদিন আগেও বলে কিক দিতে গিয়ে নিজের পা’টাই মচকে ফেলেছিল এ জিসান। যদিও তার কোন দোষ ছিল না। যত দোষ ঐ গরুটার। মাঠের ঐ প্রান্ত থেকে খিলখিল করে হাসতেছিল তার খেলা দেখে। এই দেখে সে আর ঠিক থাকতে পারেনি। রেগেমেগে ফায়ার হয়ে সোজা গরুটার মুখের মধ্যে বল ছুড়তে চেয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের সেকি পরিহাস! কিকটা বলে না লেগে লেগেছে একটা ইটের মধ্যে। তারপর আর কি করা! সোজা হাসপাতালে দুই মাস। জিসানকে নিয়ে তার বাবা মায়ের চিন্তার কোন শেষ নেই। গ্রামের ভিতর এত সুন্দর প্রাইমারী একটা স্কুল। সকল ছেলেমেয়েরাই পড়ালেখা করছে মন দিয়ে। শুধু জিসানের অবস্থার কোন উন্নতি নেই। বার্ষিক পরিক্ষার রেজাল্টের সময় সবাই যখন পাশের আনন্দে লাফালাফি করে সেই মুহূর্তে সে চিন্তা করে কিভাবে এর পরের বছরেও দুষ্টামিতে সেরা হওয়া যায়। আপাতত স্যারের মুখ থেকে ঘোষণা করা নিজের নামটা তো শুনতে পারবে! কিন্তু এইভাবে আর কতদিন? এবার ক্লাস ফোর থেকে ক্লাস ফাইভে উঠে পড়েছে। হেড স্যার বলেছে তাকে নিয়ে আর পারা গেল না। ছেলেটা সারাদিন খেলা খেলা করে। ক্লাসে বসে বসেই মাথা চাপড়ায় আর ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়ার জন্য আফসোস করে।
জিসানের খুব ভালো বন্ধু রায়হান। রায়হান খুব বুদ্ধিমান এবং পড়ালেখায় কখনও ফাঁকি দেয় না। সেও খুব ভালো ক্রিকেট, ফুটবল, গোল্লাছুট, কানামাছি খেলতে পারে। তাই বলে পড়ালেখা বাদ দিয়ে শুধু খেলা নিয়েই পড়ে থাকতে হবে এমনটা তো নয়! কথায় আছে না- যে পারে সব পারে। রায়হানের মুখ থেকে অনেক উপদেশের বাণী শুনেও জিসানের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসে না। পড়ালেখাকে সে দুচোখে দেখতে পারে না। প্রচুর ঘৃণা করে। বই দেখলেই কল্পনা জগৎ থেকে যত ঘুমেরা আছে সবাই এসে চোখের মধ্যে ভর করে। আবার রাত জেগে টিভিতে খেলা দেখার সময় তখন কোন ঘুম আসে না। ভাবটা এমন যেন নিশাচর প্রাণী।
জিসানের অবশিষ্ট একটা বন্ধুই এখন রয়ে গেছে, রায়হান। সব বন্ধুরাই তাকে এখন আর আগের মত দেখতে পারে না। সে যেমন বইকে ঘৃণা করে তেমনি তাকে এখন সবাই ঘৃণা করে। খেলায় ভেতর থেকে থেকে ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষাটা খারাপ দিয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই জন্য তার কোন দুঃখ নেই।
সামনে আড়ছে বার্ষিক পরীক্ষা। জিসানের মনটা খুবই খারাপ। আজকাল বন্ধুদের মত নিজের মা-বাবাও বদলে গেছে। সারাদিন খালি বকাঝকা করে। জিসান প্রতিদিন দুপুর বেলা খেলাধুলা করে পুকুরে যায় গোছল করতে। মাস খানেক আগে রায়হানের কাছ থেকে সাঁতার শিখেছে। কিন্তু এখন আর রায়হান তার সাথে পুকুরে গোছল করতে যায় না। কেমন যেন সেও দূরে সরে যাচ্ছে। বলতে গেলে খালি বলে তার সাথে পুকুরে নামলে নাকি অনেক সময় অপচয় হয়। তাছাড়া সামনে যেহেতু বার্ষিক পরীক্ষা। তাই আর অন্যদিকে তার কোন মন নেই। জিসান এসব কথা ভাবতে ভাবতে একা একাই পুকুর পাড়ে এসে হাজির হল। কিন্তু একি! পুকুর পাড়ে রায়হান কেন? ও নিশ্চয় আজকে তাকে অনেক কিছু বলবে। বকবে আর ধিক্কার দিবে। তারপর হয়ত বলবে- ‘আজ থেকে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব শেষ। কারণ তুমি একজন পচা ছেলে আর আমি ভালো ছেলে। তোমার সাথে আসলে আমার যায় না।’ ঠিকই তো! কোথায় জিসান আর কোথায় রায়হান। ফ্রাস্ট বয় আর লাস্ট বয়।
রায়হান আসলেই পুকুর পাড়ে বসে জিসানের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু অন্য কোন কারণে না বরং আজ তার সাথে মজার একটা খেলা খেলার জন্য। ব্যাপারটা শুনে জিসানের আনন্দ যেন আর ধরে না। কিন্তু পরক্ষণেই মনটা তার একদম খারাপ হয়ে গেল যখন রায়হানের মুখ থেকে আরেকটি কথা শুনতে পেল। খেলাটা হচ্ছে পুকুরের ঐপাড়ে একটা বল রাখা আছে। সাঁতার কেটে সেই বলটা এই পাড়ে আনতে হবে। সময় মাত্র দুই মিনিট। তার মধ্যেই আনতে না পারলে রায়হান তার কাছ থেকে একেবারে দূরে চলে যাবে। আর কোনদিনই তার সাথে খেলবে না এমনকি কথাও বলবেও না। জিসান অনেকক্ষণ চিন্তা করে তারপর সে রাজি হয়ে গেল। কারণ আজ তাকে পারতেই হবে। রায়হানকে ছাড়া সে যে একদম নিঃস হয়ে যাবে। আর একটা খেলার বন্ধুও থাকবে না। তাই মনে মনে প্রচ- সাহস জুগিয়ে জয়ের প্রত্যাশায় পুকুরে লাফ দিল। রায়হান ঘড়ি দেখে সময় গুনছে আর জিসান সাঁতার কেটে চলছে। আর মাত্র ত্রিশ সেকেন্ড বাকি। জিসানের বুক ভরা সাহস। সে কখনও পরাজয়ের চিন্তা করে না। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বল নিয়ে এই পাড়ে চলে আসল। এই দেখে রায়হানের চক্ষু যেন ছানাবড়া। প্রায় দু’বছর ধরে সে সাঁতার শিখেছে। অথচ আজ পর্যন্ত চার মিনিটেও কখনও এত দ্রুত ওই পাশ থেকে এই পাশে আসতে পারেনি। যা আজ জিসান করে দেখাল। তার ইচ্ছাশক্তি প্রবল। চাইলে ও সব করতে পারবে। রায়হান জিসানের কাছে গিয়ে বলল, ‘জিসান, আজ থেকে তুই আমার খুব ভালো বন্ধু। তোর সাথে প্রতিদিন খেলব, ঘুরব, সাঁতার কাটব। কিন্তু পড়ালেখা না করে স্যারের হাতে যদি মার খাস্ আমার কি তখন ভাল লাগবে বল্ । আমার বন্ধু মার খাবে আর আমি বসে বসে দেখব?’
‘কিন্তু আমার যে পড়ালেখা করতে ভালো লাগে না?’ মাথা নিচু করে বলল জিসান।
‘ভালো লাগে না কে বলেছে? তুই কখনও চেষ্টা করে দেখেছিস? এক মাস আগে আমি যখন তোকে সাঁতার কাটা শিখালাম তখনও তো তুই বলেছিলি আমি পারব না। সাঁতার কাটা আমার ভালো লাগে না। কই, এখন তো পুকুরে নামা ছাড়া একদম-ই থাকতে পারিস না।’
‘কিন্তু পড়ালেখা করতে গেলেই যে আমার ঘুম আসে!’
‘আসবেই তো! তোর যে মন পড়ালেখায় থাকে না তাই। একবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখ্ আমিও তো প্রতিদিন তোর সাথে খেলি, ঘুরে বেড়াই; তাই বলে কি পড়ালেখায় কখনও ফাঁকি দেই। তোকে দেখলে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা খিলখিল করে হাসে আর আমি তখন তোকে দেখে কষ্ট পাই। মনে মনে ভাবি হয়ত একদিন তুইও আমার মত ভালো ছাত্র হবি।’
‘সত্যি বললি?’
‘ইয়েস। কারণ ভালো ছাত্ররা কখনও মিথ্যা কথা বলে না।’
‘ঠিক আছে আমিও তাহলে তোর মত ভালো ছাত্র হব। তোর সাথে প্রতিদিন ঠিক সময়ে পড়ালেখা করব আবার ঠিক সময়েই খেলতে যাব। তুই আমাকে সঙ্গে নিবি তো?’
জিসানের প্রশ্নের উত্তর রায়হান আর দিতে পারে না। চোখ ভরা তার জল। কিছুক্ষণ আগেও আকাশে মেঘ জমেছিল। কিন্তু হঠাৎ মেঘের কোণায় ঝলমলে রোদ হেসে উঠল। বাতাসে ফুলের গন্ধ। সেই গন্ধ যেন রায়হানকে বুকে টেনে নিয়ে বারবার ধন্যবাদ দিচ্ছে। ক্লাসের সেই দুষ্টু ছেলেটা আজ রায়হানের জন্যই ভালো হবার স্বপ্ন আঁকছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন