সংশ্লিষ্টদের দাবি দীর্ঘ সাড়ে চার মাসে লোকসান ১০ হাজার কোটি টাকা
করোনা মহামারির ছোবলে গত বছর থেকে ধুঁকছে দেশের পর্যটন শিল্প। সংশ্লিষ্টদের দাবি, এ খাতে লোকসানের পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ অবস্থায় প্রায় সাড়ে চার মাস পর গতকাল থেকে পর্যটনকেন্দ্রগুলো শর্ত সাপেক্ষে খুলে দেওয়া হয়েছে। এতে একদিকে করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি অন্যদিকে অর্থনৈতিক সঙ্কট ভাবাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।
দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল রাখা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় গতকাল (১৯ আগস্ট) থেকে শর্ত সাপেক্ষে পর্যটনকেন্দ্র খোলার অনুমতি দিয়ে গত ১২ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে। পর্যটনকেন্দ্রের যেসব শর্ত পালন করতে হবে সেগুলো হলো- ১. পর্যটনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদনকেন্দ্র আসন সংখ্যার শতকরা ৫০ ভাগ ব্যবহার করে চালু করতে পারবে। ২. সকল ক্ষেত্রে মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করতে হবে এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রণীত স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। ৩. যে কোনো প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে অবহেলা পরিলক্ষিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব বহন করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পর্যটনকেন্দ্র খোলার অনুমতির সঙ্গে দেওয়া শর্তের সঙ্গে অনেকে দ্বিমত পোষণ করেছেন। ওয়ান্ডারল্যান্ড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যামিউজমেন্ট পার্কস অ্যান্ড এট্রাকশন্সের (বাপা) উপদেষ্টা জিএম মুস্তাফিজ বলেন, সারা দিনই মানুষ আসবে। জ্বর মেপে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে প্রবেশ করানো হবে। পার্কগুলো উন্মুক্ত স্থান। সেখানে ৫০ শতাংশ দর্শনার্থী প্রবেশের সুযোগ দেওয়া উচিত হয়নি।
তবে পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলছেন, বিনোদনকেন্দ্র ও রিসোর্টগুলো নির্দেশনা মানছে কি না তা স্থানীয় প্রশাসন শক্তভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। তিনি বলেন, জীবিকা ও অর্থনীতির কথা চিন্তা করে পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটন শিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বিনোদনকেন্দ্র ও হোটেল-রিসোর্ট সরকারের নির্দেশনা মানছে কি না তা স্থানীয় প্রশাসন শক্তভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।
শামসুল হক শারেক, কক্সবাজার থেকে জানান, দীর্ঘদিন পর খুলে দেয়া হয়েছে কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল ও সৈকতসহ বিনোদন কেন্দ্রগুলো। এতে পর্যটক ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও হোটেল মালিকরা খুশি। তারা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। হোটেল-মোটেল ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো খুলে দেয়া হলেও শর্ত রয়েছে সব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন হলে প্রয়োজনে আবারো ব্যবস্থা নেয়া হবে। কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের পর্যটন স্পটগুলোতে নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের সৈকতসহ বিনোদনকেন্দ্রে ৬টি পয়েন্টে স্বাস্থ্যবিধি পালন ও নিরাপত্তা রক্ষায় নজরদারি বাড়িয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার শেহরিন আলম সৈকতে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার হোটেল-মোটেল ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো খোলার প্রথম দিনে খুব বেশি পর্যটক বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে দেখা না গেলেও কক্সবাজার সৈকতে বাড়তে শুরু করেছে পর্যটকদের পদচারণা। সৈকতের লাবণী পয়েন্ট, সীইন পয়েন্ট, ডলফিন মোড় ও হিমছড়ি ও দরিয়া নগর ঘুরে দেখা গেছে বেশকিছু পর্যটক কক্সবাজারে এসেছেন তবে বিরূপ আবহাওয়ায় অনেকে সৈকতে নামেননি। কিছু কিছু পর্যটক বৃষ্টি উপেক্ষা করে দেখা গেছে সৈকতে ঘুরে বেড়াতে এবং অনেকেই সাগরের পানিতে নেমে মনের আনন্দে গোসল করতে।
কক্সবাজার হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও পর্যটন উদ্যোক্তা আবুল কাশেম সিকদার বলেন, লকডাউন উঠে যাওয়ায় কক্সবাজারে পর্যটক আসতে শুরু করেছেন। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্ত হোটেল-মোটেল ও পর্যটকরা মেনে চলবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করছেন। খবর নিয়ে জানা গেছে, হোটেল-মোটেলগুলোতে বুকিং বাড়ছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মামুনুর রশিদ বলেন, হোটেল-মোটেল ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে নজরদারি রয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ট্যুরিস্ট গাইড অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মো. এনামুল কবীর ইনকিলাবকে বলেন, অনেকদিন পর পর্যটনকেন্দ্র খুলেছে। সাড়ে চার মাসে এখাতে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তারপরও পর্যটনকেন্দ্র খুলে দেওয়ায় আমরা খুশি। সবাই ঘরে আবদ্ধ থেকে অস্থির হয়ে গেছে। আশা করছি পর্যটন কেন্দ্রগুলো আবার পর্যটকদের উপস্থিতিতে মুখর হয়ে উঠবে। তবে এক্ষেত্রে আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সবকিছু করব। সবাইকে নিরাপদ দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সৈকতে নামতে হবে।
কক্সবাজার ছাড়াও অন্যান্য রিসোর্ট-বিনোদনকেন্দ্রও পরিচ্ছন্ন করে দর্শনার্থীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। পর্যটক টানতে ইউটিউব, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চালানো হচ্ছে পচারণা, দেওয়া হচ্ছে মূল্যছাড়ের ঘোষণা। ঢাকার অদূরে ফ্যান্টাসি কিংডম, নন্দনপার্ক ছাড়াও শ্যামলির ডিএনসিসি ওয়ান্ডারল্যান্ডও (সাবেক শিশুমেলা) খোলা হয়েছে।
দীর্ঘ দুই মাস আট দিন পর খুলে দেওয়া হয়েছে সুনামগঞ্জের সব পর্যটনকেন্দ্র। স্বাস্থ্যবিধি মেনে গতকাল পর্যটনকেন্দ্র উন্মুক্ত করে দেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওর, নীলাদ্রি, টেকেরঘাট, বারেকটিলাসহ পর্যটন এলাকায় সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ছুটছেন পর্যটকরা। এদিকে মৌলভীবাজারে বিভিন্ন পর্যটন স্পট খুলে দেওয়া হলেও বন্ধ রয়েছে জাতীয় উদ্যান লাউয়াছড়া। অনেকেই উদ্যানে ঘুরতে এলেও ফিরে যেতে হয় তাদের। এছাড়া মৌলভীবাজারের অন্যান্য স্পটেও পর্যটকদের উপস্থিতি ছিল অনেকটাই কম।
সাগরকন্যা কুয়াকাটায় ছাড়ের ছড়াছড়ি : সাগরকন্যা কুয়াকাটার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দিতে চান ব্যবসায়ীরা। এ জন্য তারা নানা রকম ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছেন। বলা যায় পর্যটকদের জন্য রয়েছে ছাড়ের ছড়াছড়ি। পর্যটন ব্যবসায়ীরা পর্যটকদের বরণ করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে হোটেলগুলোতে অগ্রিম বুকিং নিচ্ছেন। রেস্তোরাঁগুলো কম দামে ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে রাখার ঘোষণা দিয়েছে।
পর্যটকদের সুন্দরবনে যেতে এখনো মেলেনি অনুমতি : দীর্ঘ সাড়ে চার মাসের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর দেশের সব বিনোদনকেন্দ পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হলেও সুন্দরবনে যাওয়ার অনুমতি এখনো দেওয়া হয়নি। পূর্ব সুন্দরবনের করমজল স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আজাদ কবির জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি না মেলায় সারা দেশের মতো সুন্দরবন পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা যায়নি। বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, করোনা সংক্রমণ রোধে গত ৩ এপ্রিল সুন্দরবনে পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর গত সাড়ে চার মাসে প্রায় ১২ লাখ টাকার রাজস্ব হারিয়েছে বন বিভাগ।
সেন্টমার্টিন যাওয়ায় বাধা : দীর্ঘদিন পর পর্যটন সেক্টর খুলে দেয়া হলেও বৈরী আবহাওয়ায় কারণে সেন্টমার্টিনে এখনো শুরু হয়নি পর্যটক বরণের প্রস্তুতি। বৈরী আবহাওয়ার প্রতিক‚লতায় সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে এমন সিদ্ধান্ত নেয় স্থানীয় প্রশাসন। ফলে দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে এখনো শুরু হয়নি পর্যটন সংশ্লিষ্ট হোটেল, কটেজ সাজানো ও জাহাজ চলাচলের প্রস্তুতি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন