শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

এখন বেকারদের জন্য ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুবর্ণ সময়

মো. জিল্লুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২৩ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম

অনলাইনে আয়ের অন্যতম জনপ্রিয় উপায় হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিং। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে যারা কাজ করেন, তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে কাজের সুযোগ দেয় বিভিন্ন ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেস বা কোম্পানি। নিজ দক্ষতার তথ্য দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে কাজের জন্য আবেদন করতে হয়। অন্যদিকে কাজ প্রদানের জন্য রয়েছে নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। ঘণ্টায় পাঁচ থেকে শতাধিক ডলার পর্যন্ত আয় করা সম্ভব ফ্রিল্যান্সিং সাইটগুলো থেকে। ফ্রিল্যান্স কাজের অর্থ আনা কঠিন হলেও বর্তমানে বিভিন্ন গেটওয়ে ও অনলাইন পেমেন্টের মাধ্যমে অর্থ আনা সহজ হয়েছে। আপওয়ার্ক, ফ্রিল্যান্সার, গুরু, ফাইভারআর, ওয়ার্কএনহায়ার ইত্যাদি বিখ্যাত ফ্রিল্যান্সিং সাইট।

ফ্রিল্যান্সিং শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে, মুক্তপেশা। গৎবাঁধা নিয়মের বাইরে নিজের ইচ্ছেমতো সময়ে এবং পছন্দের ধরন অনুযায়ী কাজ করার নাম ফ্রিল্যান্সিং। অন্যভাবে বলা যায়, নির্দিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠানের অধীনে না থেকে মুক্তভাবে কাজ করাকে ফ্রিল্যান্সিং বলে। এ ধরনের পেশাজীবিকে বলা হয় ফ্রিল্যান্সার বা মুক্ত পেশাজীবী। ফ্রিল্যান্সিং বা ফ্রিল্যান্সার শব্দগুলো আমাদের কাছে সাম্প্রতিক হলেও এই ধরনের পেশার সঙ্গে অনেকে অনেক আগ থেকেই কমবেশি পরিচিত। ঠিকাদার, পত্রপত্রিকার কলাম লেখক, স্থানীয় সাংবাদিক, বাসার/ভবনের ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রী- এরা নির্দিষ্ট একটি পত্রিকা বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকে না। একই সাংবাদিক অনেকগুলো সংবাদপত্রের সঙ্গে কাজ করে, একই ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রী অনেকগুলো কাজে যুক্ত থাকে কিংম্বা কোন কাজ ১৫-২০ মিনিটে শেষ করে, আবার কোন কাজ মাসব্যাপী চলতে পারে।

চাকরিজীবীদের মতো এরা বেতনভুক্ত নয়। কাজ ও চুক্তির ওপর নির্ভর করে আয়ের পরিমাণ কম বা বেশি হতে পারে, তবে স্বাধীনতা আছে, ইচ্ছেমতো, ঘরে বসে বিশ্বের যে কোনো দেশ থেকে আয় করার সুযোগও আছে। এজন্য স্বাধীনমনা লোকদের আয়ের জন্য এটি একটি সুবিধাজনক পন্থা। সুতরাং ফ্রিল্যান্সিং বলতে আমরা সেই কাজগুলোকে বুঝি যেগুলো কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে করা হয় এবং কাজগুলো হয় বিদেশিদের জন্য (মূলত পশ্চিমা ও ইউরোপের দেশগুলো) এবং প্রাপ্তিটা হয় আমরেকিান ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ডে বা ইউরোতে।

উন্নত দেশগুলোতে (আমেরিকা কিংবা ইউরোপ) মজুরি অত্যন্ত বেশি। কোনো কোম্পানির যদি ওয়েবসাইট তৈরি করার প্রয়োজন হয়, এজন্য যদি একজন ওয়েব ডিজাইনার নিয়োগ করতে হয় তাহলে বিপুল পরিমাণ টাকা গুনতে হয়। সে কাজটিই অন্য কোনো উন্নয়নশীল দেশের (যে দেশের মজুরি অনেক সস্তা) ওয়েব ডিজাইনার দিয়ে করিয়ে নিলে তুলনামূলক কম টাকায় করানো যায়। তাই ঐসব দেশের মানুষ আমাদের মতো দেশ থেকে কম খরচে করিয়ে নেন, তাতে করে দুজনেরই লাভ। বর্তমান ইন্টারনেট ব্যবস্থায় খুব সহজে এ কাজ করা সম্ভব।

ফ্রিল্যান্সাররা অনলাইনে তাদের কাজের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে নিয়ে আসেন। রেমিটেন্স আহরণের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন দেশের লাখো তরুণ। তারা বেকারত্ব দূরীকরণ, নিজের এবং সমাজের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখলেও তাদের সামাজিক পরিচয় নিয়ে খুবই দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন। ব্লগসাইটগুলোতে কিংম্বা ট্রেনিং সেন্টারগুলোর পোস্টারে দেখা যায়, কম্পিউটারের পর্দা থেকে ডলার উড়ে আসছে, যেন ধরার লোক নাই কিংম্বা পায়ের উপর পা তুলে ডলার গুণছেন। এগুলো এ সম্পর্কে অতিরঞ্জিত প্রচারণা। তবে যারা এ পেশায় দক্ষ তাদের ক্ষেত্রে এটি শতভাগ সত্য ও বাস্তব।

ফ্রিল্যান্সিংয়ের শতাধিক খাত রয়েছে। বহুল আলোচিত ও চাহিদা সম্পন্ন খাতগুলো হলো: ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল ডেভেলপমেন্ট, প্রোগ্রামিং ও সফটওয়্যার, নেটওয়ার্কিং, লেখালেখি, সাপোর্ট (সেবা/পণ্যের সঙ্গে জড়িত সহযোগিতা), বিক্রয় ও বিপণন (মার্কেটিং), ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি, খুচরো করে বললে প্রায় ৬০/৭০টি বিষয়ে ফ্রিল্যান্সিং করা যায়। বাড়িতে, মেসে, নিজের ঘরে, ক্যাম্পাসে, যানবাহনে, যেখানে ইচ্ছা বা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হয়, সেখানে বসে কাজ করা যায়। ফ্রিল্যান্সিং কাজের পরিচিত সাইটগুলো হচ্ছে- আপওয়ার্ক, ফ্রিল্যান্সার, ফাইভার, গুরু, নাইনটিনাইন ডিজাইনস, পিপল পার আওয়ার ইত্যাদি এবং পেপল, পাইয়িনিয়র হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিং সাইটে লেনদেনের আন্তর্জাতিক মাধ্যম।

সাধারণত ফ্রিল্যান্সারদের কাজের কোন সময়সীমা নেই। এর ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেই। ক্লায়েন্টের সঙ্গে ফ্রিল্যান্সারেদের চুক্তির উপর তা নির্ভর করে। এসমস্ত কাজের ক্ষেত্রে প্রায় সময় ফ্রিল্যান্সারকে রাতে কাজ করতে হতে পারে। তবে মনে রাখা জরুরি, যে কাজই করা হোক না কেন তা ভালো করে জেনে-বুঝে তারপর করতে হবে এবং ক্লায়েন্টের সঙ্গে সব সময় ভালো যোগাযোগ রাখতে হবে। আর এই বিষয়গুলো পরবর্তী সময়ে নতুন কাজে অনেক সাহায্য করে।

বাংলাদেশে ছয় লাখ আইটি পরিষেবা কর্মী বা ফ্রিল্যান্সার রয়েছে এবং দলভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং সংস্থাগুলির সংখ্যা প্রায় ১৬০০। এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকদের মাধ্যমে একসাথে বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। ই-কমার্সের উত্থান এবং অনলাইন সরঞ্জামের চাহিদা ফ্রিল্যান্সারদের কাজের সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে। তদুপরি, বৈশ্বিক করোনা মহামারীর প্রভাবে বৈশ্বিক ব্যবসাগুলি ব্যয় হ্রাস করার চেষ্টা করছিল কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলে। যেসব ফ্রিল্যান্সার চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাদের পরিষেবাগুলি নতুনভাবে ডিজাইন ও পুনর্বিন্যাস করেননি তারা মহামারীর মধ্যে সমস্যায় ভুগছেন। উদাহরণস্বরূপ, ভ্রমণ ও পর্যটন সম্পর্কিত আইটি পরিষেবা সরবরাহকারীরা এই খাতের মন্দার কারণে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে ফ্রিল্যান্সাররা তাদের আন্তর্জাতিক নিয়োগকর্তাদের দ্বারা গৃহীত পেমেন্ট আনতে অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছেন। ২০১২ এর আগে বাংলাদেশের আউটসোর্সিংয়ের আয়ের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে গৃহীত হয়ে আসছিল। যদিও কিছু অর্থ ব্যাংক-টু-ওয়্যার ট্রান্সফারের মাধ্যমে এসেছিল, তবে এটি ব্যয়বহুল ছিল। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নোটিশ জারি করে, ফ্রিল্যান্সারদের অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে পরিষেবা সরবরাহকারী (ওপিজিএসপি) এর মাধ্যমে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ গ্রহণের ব্যবস্থা করে। তার কয়েক মাস পরে, ব্যাংক এশিয়া বাংলাদেশের প্রথম ঋণদাতায় অংশীদার হয়ে ফ্রিল্যান্সার আয়ের অংশীদারিত্বের অংশীদার পাইজা পে নামে একটি ওপিজিএসপি উদ্যোগ নিয়েছিল। যেহেতু পাইজা ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মগুলির সাথে ভালো সংযোগ স্থাপন করে নি, স্বাধীন অনলাইন কর্মীরাও বেশি সুযোগ করতে পারেনি। পরে ব্যাংকটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ওপিজিএসপি পাইওনিয়ারের সাথে অংশীদারিত্ব করে এবং মার্চ ২০১৫ এ এর পরিষেবা চালু করে। ফ্রিল্যান্সার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ব্যাংক এশিয়া আনুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলির মাধ্যমে প্রাপ্ত তহবিলের অর্ধেক গ্রহণ করে থাকে। ব্যাংক এশিয়ার হিসাব মতে, ২০১৪ সাল থেকে ব্যাংকটির মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সাররা ৫৯৯ মিলিয়ন ডলার গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে প্রাইভেট কমার্শিয়াল ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থপ্রদানের প্রবণতা বছরে বছরে ৪০ শতাংশের বেশি বেড়েছে, ২০২০ সালে ১৪০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

২০১৮ সালে বাংলাদেশ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এবং মাস্টারকার্ডের অংশীদারিত্বের সাথে ব্যাংক এশিয়া বাংলাদেশের প্রথম-প্রথম ফ্রিল্যান্সার কার্ড ‘স্বাধীন’ কার্ড চালু করার ঘোষণা দিয়েছিল। কার্ডটি ফ্রিল্যান্সারদের সরাসরি আন্তর্জাতিক নিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ প্রদানের অনুমতি দেয়। ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংকও ফ্রিল্যান্সারদের জন্য অর্থ প্রদানের চ্যানেল। বাংলাদেশ ব্যাংক ফেব্রুয়ারিতে একটি নোটিশ জারি করে, আইটি ফ্রিল্যান্সারদের মোবাইল আর্থিক পরিষেবাদির মাধ্যমে স্বল্প মূল্যের উপার্জন বাড়িতে বসে গ্রহণ করার ব্যবস্থা করে।

বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার্স ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (বিএফডিএস) এর মতে, ‘যদিও অর্থ গ্রহণ করার জন্য অনেক বিকল্প রয়েছে, তবে বৃহত্তম নেটওয়ার্ক পেপালের অনুপস্থিতি ফ্রিল্যান্সারদের জন্য এক বড় সমস্যা রয়ে গেছে।’ আইসিটি পণ্য বা পরিষেবা রফতানির বিপরীতে সরকার ২০১৩ সাল থেকে দশ শতাংশ নগদ সহায়তা প্রদান করে আসছে। তবে কেবল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আইটি এবং বেসিসের সদস্যপদ প্রাপ্ত ফ্রিল্যান্সিং সংস্থাগুলিই এর যোগ্য। তবে বিষয়টি পৃথক ফ্রিল্যান্সারদের সুবিধার জন্য সম্প্রসারণ করা দরকার বলে মনে করেন এখাতের সংশ্লিষ্টরা।

করোনা মহামারীর কারণে ফ্রিল্যান্সিং কাজের ক্ষেত্রে ঝুঁকে পড়ছে অনেক বৃহৎ প্রতিষ্ঠানও। বিশ্লেষকরা বলছেন, সংস্থাগুলো ভার্চুয়াল ওয়ার্কপ্লেসে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় ও বাড়িতে বসে কাজের সুযোগ দেওয়ায় ফ্রিল্যান্স চাকরির চাহিদা বেড়েছে বহুগুণ। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে খরচ কমাতে অনেক প্রতিষ্ঠান স্থায়ী কর্মীকে সরিয়ে ফ্রিল্যান্স কর্মীর দিকে ঝুঁকছে এবং এটা কর্মহীন বেকারদের কাজের জন্য সুবর্ণ সুযোগ।
লেখক: ব্যাংকার ও মুক্তমনা কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মো নাঈম ইসলাম ১১ জুলাই, ২০২২, ১০:৩৬ পিএম says : 0
ফি কাজ করতে চাই
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন