বিশ শতকের সূচনালগ্ন থেকে বাংলার বিদ্যুচ্চালিত আধুনিক বস্ত্রশিল্পের ইতিহাসের শুরু। ১৯৪৭-এর পূর্বে আধুনিক বস্ত্রশিল্প ছিল সুতা তৈরি ও বয়নের সুবিধাদিসহ নানা উপাদানে গঠিত যৌগিক বস্ত্র কারখানা। পরে এতে যুক্ত হয় বিশেষায়িত বস্ত্রবয়ন, সেলাই কাজ ও হোসিয়ারি শিল্প, রঞ্জন, মুদ্রণ ও ফিনিশিং। ১৯৪৭-এ দেশ ভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে ১১ লাখ সুতা কাটার যন্ত্র এবং ২৭ হাজার তাঁতসহ ১১টি যৌগিক বস্ত্র কারখানা ছিল। ১৯৭২ সালে বস্ত্রকলসহ সকল বৃহদায়তন উৎপাদন শিল্প জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৮২ সালের পর রাষ্ট্রায়ত্ত বয়ন কারখানাগুলো ক্রমশ বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। ১৯৯৯-এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ৪০ হাজার সুতা কাটার যন্ত্রের তুলনায় ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পে ২৪ লাখ সুতা কাটার যন্ত্র সংস্থাপন করা হয়। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, সরকারি খাতে ২১টি কারখানায় ২৫ হাজারের মতো সুতা কাটার যন্ত্র টিকে আছে। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের ৩০১টি কারখানায় এর সংখ্যা ৬০ লাখেরও বেশি।
এক দশক আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের অধিকাংশ বয়ন কারখানা নিম্নমানের সুতা তৈরি করতো। তৈরি পোশাক শিল্পের প্রয়োজন মেটানোর জন্য উন্নত মানের সূ² সুতা এবং পলিস্টার তুলা মিশ্রিত সুতা তৈরির সামর্থ্য ছিল অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু তৈরি পোশাক শিল্পের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশেষ করে বেসরকারিখাতে বয়নশিল্পের বিকাশে এ পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলে গেছে। ১৯৯৯ সালে ১১২ মিলিয়ন কেজি সুতার উৎপাদন দেশের মোট সুতার প্রয়োজনের মাত্র ২২% ভাগ মেটাতে পেরেছিল। ২০১১ সাল নাগাদ বার্ষিক সুতার উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ১,৩৪০ মিলিয়ন কেজি, যা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ এবং রপ্তানিযোগ্য পোশাকখাতেরও বেশিরভাগ চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম।
বয়ন শাখায় উৎপাদিত তন্তুর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন আদলের তুলট, পলিস্টার, সিনথেটিক, পশমি এবং তুলা ও পলিস্টার মিশ্রিত সুতা। ১৯৪৭-৫৬ বছরগুলোতে বয়ন কারখানার তাঁতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল শ্লথ। ১৯৫৭-৭২ পর্যন্ত এই হার কিছুটা বৃদ্ধি পায়। বয়ন কারখানার মতো ৬৮ হাজার তাঁতবিশিষ্ট যৌগিক সেলাই শিল্প কারখানাও ১৯৭২-এ রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। ১৯৮৩ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোকে বিরাষ্ট্রীয়করণের ব্যবস্থা নেওয়া পর্যন্ত তাঁতের সংখ্যা কমবেশি একই রকম ছিল। অপ্রচলিত পুরোনো তাঁতগুলো অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় তাঁতের সংখ্যা ৬৩ হাজার থেকে ৩৯ হাজারে নেমে যায়। ২০১১ সালে সরকারের মালিকানাধীন বস্ত্রকারখানা কমে দাঁড়ায় মাত্র ২০টিতে। এর মধ্যে ১৭টি কারখানার ২১টি ইউনিট চালু ছিল। এ সময় ৩টি নতুন কারখানা চালুর প্রক্রিয়া চলছিল। এসব কারখানায় মোট মাকুর সংখ্যা ৪ লাখ ৯০ হাজারেরও বেশি। তাঁতের সংখ্যা ১ হাজারের কিছু বেশি।
বাংলাদেশের আধুনিক বয়ন শিল্পে উৎপন্ন দ্রব্যগুলো হলো শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি, ব্লাউজ, শার্টের কাপড়, লংক্লথ, পপলিন, সালু, গ্রে মার্কিন ইত্যাদি সুতি কাপড়। উৎপাদনের নিম্নমানের কারণে এক দশক আগেও এ শিল্পের অবস্থা ছিল করুণ। ১৯৯৯ সালে ২ কোটি ৫০ লক্ষ মিটার বস্ত্র উৎপাদন অভ্যন্তরীণ চাহিদার ১% ভাগও মেটাতে পারেনি। তবে একুশ শতকের প্রথম দশকে বেসরকারিখাতে বস্ত্রশিল্পের বিকাশ পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে দিয়েছে। ২০১১ সালে এসে প্রাথমিক বস্ত্রখাত মোট রপ্তানি চাহিদার ৫১ ভাগের মতো পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে।
১০ থেকে ৫০টি তাঁতের কারখানা সম্বলিত বিশেষায়িত বস্ত্রশিল্প উপশাখা শুরু হয়েছিল ১৯৭০-এর দশকের মধ্যভাগে। এই খাতে ১৯৭৬ সালে ১৫.৬ মিলিয়ন মিটার বার্ষিক বস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ৮ হাজার তাঁত ছিল। ১৯৮৩ সালে এ জাতীয় তাঁতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫০০টি। ১৯৮৩-৮৯ বছরগুলোতে এই খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কমে যায়। এই উপশাখায় উৎপন্ন বস্ত্রের মধ্যে বেশির ভাগ সুতি, পলিস্টার এবং সুতি পলিস্টার মিশ্রিত কাপড়। প্রধান উৎপাদিত বস্ত্র হচ্ছে নাইলন শাড়ি, গৃহে ব্যবহার্য লিনেন, পর্দার কাপড়, শার্টের কাপড়, স্যুটের কাপড়, মশারি, মখমল, ঝোলানো পর্দার কাপড়।
অভ্যন্তরীণ বাজারে যন্ত্র-সামর্থ্যরে সন্তোষজনক বাৎসরিক বৃদ্ধি পরবর্তীকালে ধরে রাখা যায়নি এবং ১৯৮৩-৯৯ সময়কালে তা ছিল মাত্র ২.১ ভাগ। এই সময়ে, রপ্তানি চাহিদা মেটাতে ১,৩৯০টি চক্রাকার বুননযন্ত্র যুক্ত করা হয়। এই শাখার প্রধান উৎপন্ন ঈ্যু ছিল জামা, আন্ডারওয়্যার, টি-শার্ট, পোলো শার্ট, মেয়েদের অন্তর্বাস, মোজা, গলাবন্ধ ও সোয়েটার। তবে এরপর থেকে মূলত বেসরকারি খাতে বস্ত্রশিল্পের বিকাশে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে। ১৯৫৬-৭৬ সময়কালে যৌগিক কারখানাগুলোতে আধুনিক রঞ্জন সুবিধাদি সীমিত ছিল এবং হস্তচালিত তাঁতশিল্পে সনাতন পদ্ধতিতে হাত দিয়ে রঞ্জনকাজ চলত। ১৯৭৬-এর পরে বেসরকারি খাতে স্বয়ংক্রিয় ও অর্ধ স্বয়ংক্রিয় রঞ্জন, মুদ্রণ ও ফিনিশিং সুবিধাদি সংস্থাপিত হয়।
২০১১ সালে ৩১০টি ডায়িং প্রিন্টিং ও ফিনিশিং কারখানায় উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়ায় ২৮০ কোটি মিটার। এর বাইরে ২৮০০ নিটিং বা বুনন কারখানাতেও ডায়িং-এর কাজ হয়। যার মধ্যে ২ হাজার কারখানা স্থানীয় বাজারের চাহিদা মেটায় এবং ৮০০ কারখানা রপ্তানিমুখী হয়। এসব কারাখানার উৎপাদন ক্ষমতা ৪১০ কোটি মিটার। হস্তচালিত তাঁতশিল্পে এখনও হাত দিয়ে রং করার প্রচলন রয়েছে। ১৯৭৭-এ বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানি বাজারে প্রবেশ করে। গত দুই দশকে তৈরি পোশাকের রপ্তানি অতি দ্রæতহারে বেড়েছে। কিন্তু সম্প্রসারণশীল রপ্তানি বাজারের জন্য তৈরি পোশাক শিল্পকে এক দশক আগেও প্রয়োজনীয় ৮৫ ভাগ বস্ত্র ও ৪০ ভাগ সুতা আমদানির ওপর নির্ভর করতে হতো।
তবে বস্ত্র শিল্পের বিকাশের কারণে প্রাথমিক বস্ত্রখাত মোট রপ্তানিতে অবদান রাখে ৫১ ভাগের মতো। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, সেলাই করা তৈরি পোশাক বা ওভেন পোশাকের ৪০ ভাগ চাহিদা মেটায় স্থানীয় বস্ত্রখাত। আর বুনন করা পোশাক বা নিট পোশাকের ৯৫ ভাগের বেশি চাহিদা মেটায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সুতা ও কাপড়। সরকারি বেসরকারি বস্ত্র কারখানায় বার্ষিক সুতা উৎপাদন হয় ১৩৪ কোটি কেজি। যা স্থানীয় বাজারে সুতা ও কাপড়ের ৯০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে। রপ্তানি খাতেরও বেশিরভাগ চাহিদা পূরণ করে। তবে এ প্রবৃদ্ধির বেশির ভাগই হয়েছে বেসরকারি খাতে। ২০১১ সালে দেশের বস্ত্রকারখানাগুলোর ৬১ লাখ সুতা কাটার যন্ত্রের মধ্যে ৬০ লাখই ছিল বেসরকারি খাতে। বড় মাপের ৪২০টি বেসরকারি কারখানায় ২৫ হাজারের বেশি যান্ত্রিক তাঁত রয়েছে। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১৪০ কোটি মিটার কাপড়। বেসরকারি খাতের বিশেষায়িত বস্ত্র কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ৬৫ এবং এগুলোতে রয়েছে প্রায় ২৩ হাজার যান্ত্রিক তাঁত। এসব কারখানায় উৎপাদিত হয় ৩০ কোটি মিটার কাপড়। বেসরকারি খাতে হাতে চালিত ছোট তাঁত কলের মোট সংখ্যা ১ লাখ ৪৮ হাজারের বেশি। যাতে তাঁতের সংখ্যা ৪ লাখ ৯৮ হাজারের মতো। এসব হস্তচালিত তাঁতে উৎপাদন হয় ৮৭ কোটি মিটার কাপড়।
বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য এবং এর তৈরি পোশাক শিল্পের বিভিন্ন দ্রব্যের রপ্তানি উন্নত দেশ প্রদত্ত সর্বাধিক সুবিধাদানের নীতি দ্বারা উপকৃত হচ্ছে। বাংলাদেশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স বা জিএসপি-এর একটি অনুগ্রহপুষ্ট অংশীদার। দেশটি বস্ত্রশিল্প ও পোশাক বিষয়ক উরুগুয়ে সম্মেলন চুক্তিতে স্বাক্ষরদানকারী। এছাড়াও বাংলাদেশ বস্ত্রশিল্প ও পোশাকের বাণিজ্য বিষয়ে কানাডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক মাল্টিফাইবার চুক্তি সম্পাদন করেছে।
বাংলাদেশে মাসিক নি¤œ মজুরি হার এবং বস্ত্রকল স্থাপনের উপযোগী অবকাঠামো তৈরিতে তুলনামূলকভাবে কম খরচের জন্য এই বিশেষ খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণীয়। বস্ত্র খাতে বিদেশি বিনিয়োগকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ও অনুমোদন দান করে সরকার বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহ দিয়ে থাকে। এসব সুবিধার মধ্যে রয়েছে, উন্নত, কম উন্নত, একেবারে কম উন্নত এবং বিশেষ শিল্প-বাণিজ্যিক এলাকায় স্থাপিত শিল্পে যথাক্রমে পাঁচ, সাত, নয় ও বারো বছর কর অবকাশ, বিনিয়োগ প্রযুক্তির মূল্যমান ও পারিশ্রমিকের ওপর কর মওকুফ, বিদেশি ঋণের সুদের ওপর কর মওকুফ, মূলধনি লাভের ওপর কর মওকুফ, বিদেশি প্রযুক্তিবিদের জন্য তিন বছর পর্যন্ত আয়কর মওককুফ, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশির বেতনের ৫০% ভাগ পর্যন্ত অর্থ নিজ দেশে প্রেরণের সুবিধা, বিনিয়োগকৃত মূলধন, লাভ ও লভ্যাংশ বিদেশে প্রেরণের সুবিধা এবং প্রেরণযোগ্য লভ্যাংশের পুনর্বিনিয়োগকে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ রূপে গণ্য করা।
বাংলাদেশের বস্ত্র ও পোশাক শিল্প আমাদের অর্থনৈতিকভাবে নানা প্রকার সাহায্য করছে। গার্মেন্টসগুলো রফতানি আয়ের অন্যতম উৎস। ২০০২ সালে বাংলাদেশ বিদেশে বস্ত্র ও পোশাক রফতানি করে ৭৭% পণ্যদ্রব্য। ২০১৩ সালে আমাদের দেশের নারী শ্রমিকের অগ্রসরতার কারণে আমাদের মোট বৈদেশিক মুদ্রা দাঁড়ায় ১৯ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বের সর্বাধিক রপ্তানিকৃত দেশ হিসেবে চীন। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। এখন তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের বস্ত্র পণ্যের ৬০% ক্রেতা হলো ইউরোপিয়ান দেশ আর বাকি ৪০% ক্রেতা আমেরিকান দেশগুলো। মালিকানার কথা বলতে গেলে এই দেশের ৫% গার্মেন্টস এবং অন্যান্য বস্ত্র শিল্পের মালিক হলো বিদেশিরা। ইতিহাসের পাতায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প যেমন স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে, তেমনি বিপরীতভাবে অনেক দুর্ঘটনার সাক্ষীও হয়ে রয়েছে। অনেক সময় বিল্ডার্সদের অসচেতনতা কিংবা হেয়ালির কারণে প্রাণহানি ঘটে। বর্তমানে সকল শিল্প কারখানায় বিপুল নিরাপত্তা প্রদান করা শুরু হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের নারীদের এই শিল্পে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া শ্রমিকদের সুবিধাও প্রদান করা হচ্ছে। তাদের এই শ্রমের কারণেই দেশের শিল্প আগের থেকে বহুলাংশে এগিয়ে গেছে।
লেখক: সহকারি কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন