বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেছেন, ভার্চুয়াল বিশ্ব আজ বাস্তব জগতের প্রতিচ্ছবি। এখানেও নারী-পুরুষের বৈষম্য আছে, ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সাইবার দুনিয়ায় নারীরা নানাভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে, তাদের প্রতি নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে মহিলা পরিষদের উদ্যোগে “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: নারীর মানবাধিকার” শীর্ষক অনলাইন মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার। গেস্ট অফ অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, নাছিমা বেগম; এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, সাংবাদিক, এবং লেখক শাহরিয়ার কবির ও গাজী টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা এবং আইন ও বিচার বিভাগের (আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়) উপসচিব ( জেলা জজ) বেগম মাকসুদা পারভীন ।
সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল সেক্টরে এগিয়ে গেছে। ভার্চুয়াল বিশ্ব আজ বাস্তব জগতের প্রতিচ্ছবি। এখানেও নারী পুরুষের বৈষম্য আছে, ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সাইবার দুনিয়ায় নারীরা নানাভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে, তাদের প্রতি নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে ও সকল নাগরিকের মানবাধিকার রক্ষায় বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির সংস্কার করে সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ হবে তিনি এমন প্রত্যাশা করেন।
সভায় বক্তারা বলেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮তে প্রণয়ন করা হয় কিন্তু ২০২১-এ এসে আইনটি অপরাধ দমনে বিস্তৃত ভূমিকা রাখছেনা, এর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আইনের অপপ্রয়োগ মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধসহ সকল অপরাধ দমন করতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। নারী, শিশু, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সহ সকল জনগণের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধে এবং মানবাধিকার রক্ষায় আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনসহ আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধের মাধ্যমে সংবিধানে প্রদত্ত বাক ও ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারের সুরক্ষা, মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে । আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধে আইন প্রয়োগকারীদের সচেতন হতে হবে, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। আইনের সাথে আইনী অবকাঠামোগুলো জেলাতে ও থানাগুলোতে স্থাপন করতে হবে। তারা আরো বলেন ডিজিটাল আইনের অপপ্রচার বন্ধে মহিলা পরিষদকে আরো বড় পরিসরে জনমত গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে হবে। সমাজ, রাষ্ট্র এবং আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ সকলকে এব্যপারে গুরুত্ব দিতে হবে। নারী –পুরুষের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে গোটা প্রশাসনকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রশিক্ষিত করতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন জোরালোভাবে গড়ে তুলতে হবে বলে তারা মন্তব্য করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, বাংলাদেশ কে ডিজিটাইজেশনের কথা বলা হলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিষয়ক কোনো আইন আইন ২০১৮ এর আগে হয়নি। তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ দমনে এবং দ্রুত বিচারের লক্ষ্যে গ্রেপ্তারের আদেশের আগে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়ে আইন পাশ হয় । ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ তে প্রণয়ন করা হয় কিন্তু ২০২১ এ এসে আইনটি অপরাধ দমনে বিস্তৃত ভূমিকা রাখছেনা, এর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে । আইনের অপপ্রয়োগ মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে । এমতাবস্থায় আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা সম্ভব। কিন্তু আইন প্রয়োগের দিকে নজর দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ সহ সকল অপরাধ দমন করতে হলে আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধে আইন প্রয়োগকারীদের সচেতন হতে হবে , দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে । অনলাইনে অপপ্রচার, সন্ত্রাস, রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের জিম্মি অবস্থা দূর করতে ফেসবুক ও ইউটিউব সোশাল মিডিয়া কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে আগের বিপন্ন অবস্থা থেকে কিছুটা উন্নতি হয়েছে, নিয়ম বহির্ভূত বিষয়গুলোর প্রচার বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। তিনি আরো বলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সোশাল মিডিয়া ব্যবহারে আইন থাকলেও এদেশে নাই। এসময় তিনি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আইনের সংশোধনে পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেন।
গেষ্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, নাছিমা বেগম, এনডিসি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ একটি সময় উপযোগী আলোচনার আয়োজন করেছে, এটি বর্তমান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত জরুরী। তিনি নারীদের প্রতি অবমাননাকর আচরণ বন্ধে মানবাধিকার কমিশন থেকে গৃহীত নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। তিনি আরো বলেন তিনি নারীর প্রতি চলমান সাইবার অপরাধ, সাইবার বুলিং বন্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব ব্যবহারে কিছু টুল ব্যবহার করে এর সহজলভ্যতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, সাংবাদিক, এবং লেখক শাহরিয়ার কবির বলেন, ডিজিটাল মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতামূলক, অশ্লীল , কদর্যমূলক বক্তব্য দেয়ার পর ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুসারে কাউকে গ্রেপ্তার করতে দেখা যায় নি। তিনি প্রশ্ন রাখেন কেন এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কেন হলোনা, কেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এখনো নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করা হয়নি। ফতোয়া বৈধ হয়ে আছে। এসময় তিনি সাম্প্রতিক সংঘটিত সাম্প্রদায়িক ঘটনার উল্লেখ করে বলেন মৌলবাদীতা, সাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং নারীবিদ্বেষী মনোভাব এখনও প্রশাসনের গভীরে আছে।
গাজী টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপ্রয়োগ হচ্ছে। যেকোনো ঘটনায় যদি নারী যুক্ত থাকেন তাতে প্রত্যেকের নেতিবাচক মনোভাবের দৃঢ় উপস্থিতি দেখা গেছে। ডিজিটাল মাধ্যমে সবচেয়ে ভুক্তভোগী হলেন নারী। সবকিছু মিলিয়ে এই ৫০ বছরে মানবিকতার অবক্ষয়, নারীদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব, উদারতার অবক্ষয় চরমভাবে ঘটেছে। বিচারিক প্রক্রিয়ায় নারীরা খুব কম পরিমাণে যাচ্ছেন, অনেকে সেখানে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, নিরাপত্তা বোধ করেন না। তিনি আরো বলেন নারীদের পরিবারে, সমাজে, কাজের জায়গায়, সাইবার দুনিয়ায় যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে সমাজের অগ্রগতি থমকে যাবে বলে। উদার, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মৌলিক জায়গা যারা নষ্ট করছে, নারীর প্রগতিতে বাধা তৈরি করছে তাদের প্রতিরোধে সরকার এগিয়ে আসবে এমন প্রত্যাশা করেন তিনি।
আইন ও বিচার বিভাগের (আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়) উপসচিব ( জেলা জজ) বেগম মাকসুদা পারভীন বলেন, তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নানা ধারা উপধারার উল্লেখ করে বলেন নারীর প্রতি সাইবার সহিংসতা দিন দিন বেড়ে গেছে । তিনি প্ল্যান ইন্টার ন্যাশনালের একটি জরিপের উল্লেখ করে বলেন ৫৩% নারী কোন না কোনভাবে সাইবার সহিংসতার শিকার । বাংলাদেশে মোট ৮টি সাইবার ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে ও আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ করতে হবে ।
সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, যেকোনো চলমান পরিস্থিতিতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার দায় থাকে সংগঠনের । তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে সামাজিক নিরাপত্তার কাজে লাগাতে হবে । সমাজ নারীর কথা বলছে কিন্তু নারীর উন্নয়ন ও অধিকারকে মূল্যায়ন করে না। মানবাধিকার আইন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সাংবিধানিক আইন, আন্তর্জাতিক নীতি, দেশীয় আইনের সমন্বয় করে আইন করতে হবে । ৫০ বছরে সমাজের ভিতরে এখনো পিছিয়ে নেয়ার জন্য যে চক্রান্ত গোণ্ঠী আছে তাদের প্রতিহত করতে এখনো পদক্ষেপ নেই। ডিজিটাল আইনে সংশোধনের জন্য রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা থেকে সামাজিক আন্দোলনকে সমন্বয় করে । মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে এদেশে নারী পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি, সাংবিধানিক নীতি অনুসারে রাষ্ট্রেকে আরো মানবিক, উদার এবং অসাম্প্রদায়িক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।
সভায় লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি রেখা চৌধুরী।তিনি সংশোধিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নানা ইতিবাচক দিকের উল্লেখ করে বলেন আইনটি প্রণয়ন করার সময় আইন মন্ত্রণালয় থেকে আইনটির মাধ্যমে কাউকে অযথা হয়রানি করা হবেনা উল্লেখ করে আশ্বস্ত করা হলেও এই আইনে মামলার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বাড়ছে। দেশের প্রায় ১১ কোটিরও বেশি মানুষ এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই নারী। তিনি সাইবার দুনিয়ায় নারীর সহিংসতার নানা ঘটনাও পরিসংখ্যানের উল্লেখ করে বলেন আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নারী, শিশু, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সহ সকল জনগণের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধে এবং মানবাধিকার রক্ষায় আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন সহ আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধের মাধ্যমে সংবিধানে প্রদত্ত বাক ও ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারের সুরক্ষা, মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে । জনগণের সাংবিধানিক অধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এই আইনটির ইতিবাচকভাবে ব্যবহারের লক্ষ্যে আরও আলোচনা, পরামর্শ, বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত সুপারিশগুলো বিবেচনা করে এই আইনের প্রায়োগিক বিষয়ে মতৈক্যে এসে আইনটির দ্রুত সংশোধন করার লক্ষ্যে সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবী জানান।
অনলাইন মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সহযোগী সংগঠন আইন ওসালিশ কেন্দ্র, ওয়াই ডব্লিউ সিএ, আওয়াজ ফাউন্ডেশন ,এসিড সার্ভাইবার ফাউন্ডেশন , এডাব, ব্রাক, টার্নিং পয়েন্ট এবং ইেএন উইমেন বাংলাদেশ এর প্রতিনিধি, এর প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক,সংগঠনের কর্মকর্তাসহ ৬০ জন উপস্থিত ছিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন