আমাদের দেশে ঋতু বৈচিত্র্যের খেলায় প্রকৃতিতে হঠাৎ বৃষ্টি হঠাৎ গরম। বর্ষার বৃষ্টি ধারা এখনও শেষ হয়নি। হঠাৎ বৃষ্টির পরে দেখা দেয় ভ্যাপসা গরম। এই সুযোগে রোগ জীবাণু ছড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়। গরমের এ সময়ে জন্ডিস রোগটির প্রদুর্ভাব দেখা দেয়। তবে বছরের যেকোন সময়ে হতে পারে জন্ডিস। আসলে জন্ডিস কোন রোগ নয়, এটি রোগের লক্ষণ মাত্র। শরীরে বিলিরুবিন নামে হলুদ রঞ্জক পদার্থের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে চোখের সাদা অংশ ও চামড়ায় হলুদাভাব দেখা দেয়। সময় মতো চিকিৎসা না করালে তা ভয়াবহ হয়ে মৃত্যুর কারণও হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সচেতন ও সতর্কতা খুবই প্রয়োজন।
জন্ডিস কী? : জন্ডিস কোন রোগ নয় এটি রোগের একটি উপসর্গ মাত্র। আমাদের শরীরে প্রতিদিন শতকরা ১% পুরানো লোহিত রক্ত কণিকার স্থলে নতুন লোহিত রক্ত কণিকা স্থানান্তরিত হয়। পুরানো লোহিত রক্ত কণিকাগুলো ভেঙ্গে বিলিরুবিন উৎপন্ন করে। যা পায়খানার মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। কোন কারণে এ বিলিরুবিন শরীর থেকে বের হতে না পারলে বা বেশী বেশী তৈরী হলে রক্তে বিলিরুবিন নামক এক ধরণের রঞ্জক পদার্থের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন চোখ, চামড়া ও নখ হলুদ হয়ে যায়। এ অবস্থাকে বলা হয় জন্ডিস। আমাদের শরীরের বিলিরুবিনের মাত্রা ১.৫ মি.গ্রা./ডিসিলিটার এর নিচে। এর দ্বিগুণ বা আরো বেশি হলে জন্ডিসের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
কারণ ঃ আমাদের দেহে যকৃতের নিচেই পিত্তথলি অবস্থান করে। পিত্ত থলি হতে পিত্তনালী দিয়ে পিত্তরস পাকস্থলীর ডিওডেনামের ভিতর দিয়ে এসে খাদ্য বস্তুর সাথে মিশ্রিত হয়। যদি কোনো কারণে পিত্ত বাধা প্রাপ্ত হয় তাহলে পিত্তরস পিত্তথলিতে জমে বৃদ্ধি পায় এবং এক সময় শরীরে প্রবাহমান রক্তের সাথে মিশে যায়। অন্ত্র হতে বিলিরুবিন পায়খানা, প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর হতে বেরিয়ে যায়। বিলিরুবিন তৈরী ও বেরিয়ে যাওয়ার নানা প্রক্রিয়ায় কোনো অসুবিধা দেখা দিলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়, আর দেখা দেয় জন্ডিস। এছাড়া লিভার বা যকৃতের রোগে জন্ডিস এবং হেপাটাইটিস ভাইরাস এ, বি, সি, ই জন্ডিস সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া বেশি মাত্রাসায় চা-পান, বিড়ি সিগারেট, জর্দ্দা, তামাক ও মদ জাতীয় পানীয় খেলে এবং নেশাকর ঔষধের প্রতিক্রিয়ায় যকৃত আক্রান্ত হলে জন্ডিসের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে।
জন্ডিস দেখা দিলে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেহে প্রকাশ পায়ঃ * চোখের সাদা হলুদ হয়। * চামড়া ও জিহবা হলুদ হয়। * মলে পিত্ত থাকে না ফলে মল ফ্যাকাশে হয়। * প্রস্রাব হলুদ বর্ণের হয়। * পেট ফাঁপা পাতলা পায়খানা ও অরুচি দেখা দেয়। * ঠিকমত ঘুম হয় না। * রোগাীর নাড়ী ধীর গতি হয় এবং রক্তচাপ কমে যায়। * ডান পাশের পেটে ধাক্কা দিলে লিভার শক্ত ও কঠিন বোঝা যায় এবং পেটে ব্যথা হয়। হেপাটাইটিস রোগে জন্ডিসের সাথে ক্ষুধামান্দা, অরুচি, বমিভাব, জ্বর জ্বর ভাব, কাপুনি দিয়ে জ্বর আসা। তীব্র পেট ব্যথা হতে পারে। * শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
কখন ডাক্তার দেখাবেন ঃ ছোট বড় সকলের চামড়া, চোখ, মূত্র হলুদ হলে, খাওয়ার রুচি কমে গেলে সবসময় জ্বর জ্বর ভাব দেখা দিলে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করবেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিবেন। তবে আর তার জন্য একজন লিভার বিশেষজ্ঞ বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিলে ভালো। কোনো অবস্থায়ই কোনো হাতুড়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন না। কোনো প্রকার ঝাড় ফুঁক, মালা, পানি পড়া, গাছের শিকড় ইত্যাদি দিয়ে কোনো চিকিৎসা করাবেন না, এগুলো ভুল, এসব যকৃতকে আরও দূর্বল করে অকেজো করে দিতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ মতে ঔষধ খাবেন এবং প্রচুর পরিমাণে বিশ্রাম নিবেন।
কোথায় চিকিৎসা পাবেন ঃ * উপজেলা হাসপাতাল। * জেলা সদর হাসপাতাল। * ভালো মানের ক্লিনিক। * মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। * বেসরকারি হাসপাতাল। * অনেক সময় কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে এজন্য আপনার চিকিৎসকই প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাবেন। নিজের ইচ্ছা মাফিক কোন ঔষধ খাবেন না। নিজের চিকিৎসা নিজে করবেন না।
বাঁচার উপায় ঃ * সর্বদাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা। * জীবাণুমুক্ত খাবার ও পানীয় পান করা। * বাহিরের খোলামেলা বাসি খাবার না খাওয়া। * সময় মতো হেপাটাইটিস ভাইরাসের টিকা নেওয়া। * পরিমাণ মতো শর্করা জাতীয় ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া। * অসুস্থ হলে-গুকোজ, আখের রস, আনারস খাওয়া খুবই উপকারি। * জন্ডিস অবস্থায় প্যারাসিটামল অ্যাসপিরিন বা ঘুমের ঔষধ খাওয়া যাবে না। * প্রতিনিদ নিয়মিত পায়খানা করতে হবে। নিয়মিত পায়খানা না হলে পরিপাকতন্ত্রে মল জমে থাকা জীবাণুগুলো প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। * প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। * টাটকা ফলমুল খেতে হবে। * হাতের নখ কেটে ছোট রাখতে হবে। * বাড়িতে রোগীকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিতে হবে। * খাবার দাবার সবসময় ঢেকে রাখতে হবে। * স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা ব্যবহার করতে হবে এবং পায়খানা থেকে ফিরে এসে হাত ভালোভাবে ধুতে হবে। * নরম ও সহজ প্রাচ্য খাদ্য খেতে হবে। * বেশি তৈলাক্ত বা বেশি ঝাল ও মসলাযুক্ত খাদ্য বা ভুনা খাবার খাবেন না। * রোগীর থুথু, মল, কফ মাটিতে গর্ত করে পুতে ফেলতে হবে।
শেষ কথা ঃ উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে জন্ডিস হলে অনেক ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই বাঁচতে হলে নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যতবান হতে হবে। জন্ডিস সম্পর্কে সবাইকে জানতে হবে এবং সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। শারীরিক যেকোন সমস্যা হলেই ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন এবং নিয়মিত ঔষধ সেবন করবেন। কোন অবস্থাই নিজের চিকিৎসা নিজে করবেন না। নিজের ঔষধ নিজে বানাবেন না।
মোঃ জহিরুল আলম শাহীন
শিক্ষক ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কলাম লেখক
ফুলসাইন্দ দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ
গোলাপগঞ্জ, সিলেট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন