শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ডিপিডিসির লোডশেডিং কমছে না

চৈত্রের দাপদাহকে হার মানাচ্ছে আশ্বিনের ভ্যাপসা গরম

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০২ এএম

আশ্বিন মাসের ৩০ তারিখ ছিল গতকাল। সাধারণত এ সময়ে শীতের আগমনের সঙ্কেত দিয়ে থাকে প্রকৃতিক রূপ। কিন্তু এবার তার উল্টো চিত্র। আশ্বিন মাসে দাপদাহ যেন চৈত্রের অসহনীয় গরমের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ট মানুষ। প্রচণ্ড গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে রাজধানীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা গরমে কাহিল হয়ে পড়েছেন। শিশু ও বৃদ্ধারা আবহাওয়াজনিত নানান রোগব্যাধিতে ভুগছেন। অথচ রেন্টাল, কুইক রেন্টালসহ নানাভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হলেও লোডশেডিংয়ে মানুষের ভোগান্তির সীমা নেই।

পরিবেশবিদরা বলছেন, জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে আশ্বিন মাসেও এমন ভ্যাপসা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। লোডশেডিং এ মানুষের হাঁসফাস অবস্থা। প্রতিদিন প্রতিটি এলাকায় কয়েক দফায় করে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। কোনোভাবেই কমছে না লোডশেডিং। অথচ আগামী ২০৩০ সালে ৪০ হাজার এবং ২০৪১ সালে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারি খাতায় দেখানো হয় প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ছে অথচ বিতরণ কোম্পানিগুলো যেন প্রতিযোগিতা করছে লোডশেডিংয়ের। বিদ্যুতের দাম গত ১১ বছরে ১০ দফা বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। গ্রাম এলাকায় আকাশে মেঘের গর্জন শোনা গেলেই চলে যায় বিদ্যুৎ, কখনও গাছ কাটার নামে, কখনও বৃষ্টি-বাদলের নামে আগাম কোনো ঘোষণা ছাড়াই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। রাজধানীর মতিঝিল- মিরপুর- শ্যামলী-কেরানীগঞ্জ, সাভার ও গাজীপুরে পল্লী এবং উত্তরা এলাকায় বিদ্যুতের ভেলিকিবাজিতে অতিষ্ঠ গ্রাহকরা। শরৎকালে প্রচন্ড তাপদাহের সময় মারাত্মক বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। রাজধানীর মতিঝিলে একদিনে ৩-৪বার বিদ্যুৎ থাকে না। ডিপিডিসির লোডশেডিং কমছে না। গতকাল রাজধানীর মতিঝিল ও মানিকনগর এলাকায় বিকেলে ৩-৪ বার লোডশোডিংয়ে পড়েছিল এলাকার বাসিন্দারা।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের ১৩ কোম্পানির কাছে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়েছে। এ কোম্পানিগুলো হচ্ছে, টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এসআরইডিএ), ডেসকো, ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি লিমিটেড, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লি. ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লি:, ওয়েষ্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড, পাওয়ার সেল, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিঃ, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোড, বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল (ইপিআরসি) এবং কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)।
এসব কোম্পানির কর্মকর্তাদের ফোন করলে বলেন, এখন লাইন সংস্কার করা হচ্ছে এজন্য লোডশেডিং হচ্ছে। গ্রাহকরা বলছেন, মূলত বিল বাড়লেও এসব কোম্পানির সেবার মান কমছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, শিল্প-কারখানাগুলো পঙ্গু করে দিয়ে চক্রটি মূলত সরকারের বিরুদ্ধে মরণ খেলায় মেতেছে। তাদের ভাষ্য সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি দেশব্যাপী বিদ্যুতের সাব স্টেশনগুলোও আপগ্রেড করছে। প্রতিটি প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। কিন্তু এর সুফল ঘরে তুলেতে পারছে না বিদ্যুতের বিতরণ কোম্পানিগুলোর দুর্নীতি, লুটপাট আর ষড়যন্ত্রের কারণে।
সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় পল্লী বিদ্যুতের বিভিন্ন সমিতিতে। এই অবস্থায় চরম বিপাকে পড়েছেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। রাজধানীতে বিদ্যুতের ভেলকিবাজি কিছুটা কম থাকলেও ভয়াবহ অবস্থা গ্রামে-গঞ্জে। বিশেষ করে শিল্প-কারখানা ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন হিসেবে পরিচিত এলাকায় এই লোডশেডিং সবচেয়ে বেশি। ডিপিডিসির আওতায়ীন এলাকাগুলোর মধ্যে, আদাবর, আজিমপুর, বাসাবো, বাংলাবাজার, বংশাল, ধানমন্ডি, ডেমরা শারুলিয়া বাজার, ফাতুল্লা পঞ্চবটি, জুরাইন ধোলিপাড়, আমির নিবাশ, জিগাতোলা, কামরাঙ্গীরচর কুরারঘাট, কাকরাইল, খিলগাঁও তালতলা জিলপার, কাজলা উত্তর কুতুবখালী, কাজলা, লালবাগ, মতিঝিল, মুগদাপাড়া, মগবাজার, মানিকনগর, মাতুয়াইল শাহজাহান, নারিন্দা.নারায়ণগঞ্জ, পরিবাগ ধানমন্ডি পাওয়ার হাউস, পোস্টোগোলা, রমনা, সাতমসজিদ হাউজ শ্যামলী, শেরেবাংলা নগর, শ্যামপুর এবং তেজগাঁও এলাকা সেখানেও থেমে নেই লোডশেডিং ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। ডিপিডিসর মোট আয়তন ২৫০ বর্গ কিমি. মোট সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন ৫৭৪১.১৬ কিমি. ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন ২৩৪.৩৬ কিমি. ৩৩ কেভি বিতরণ লাইন ৪৬০.৮২ কিমি. ৪ কেভি ১১ কেভি ১১/.৪ কেভি লাইন ৫০৪৫.৯৮ কিমি. সাবস্টেশন সংখ্যা ৭৩ টি, বিতরণ ট্রান্সফরমার ২০২৭০ টি, ৮ ৩৩/১১ কেভি পর্যায়ে ক্ষমতা ৩৬৫৪ এমভি ও সিস্টেম লস ৬.৫৮ % এবং গ্রাহক সংখ্যা ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৬১৫জন।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন ইনকিলাবকে বলেন, পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান-২০১৬ অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইনকিলাবকে বলেন, সারাদেশ থেকে বিদ্যুতের লোডশেডিং নিয়ে বিভিন্ন এলাকার মানুষের ফোনে অতিষ্ট করছে। আমরা এনিয়ে ভাবছি। তবে আগে ডিপিডিসি এমন ছিলো না। ইদানিং এমন হচ্ছে।
এ বিষয়ে ডিসিডিসির মতিঝিল এলাকার প্রকৌশলীকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, আসরের নামাজের আগে একটি বাড়িতে আগুল লেগেছিল। এ কারণে তিনবার বিদ্যুৎ বন্ধ করা হয়েছিল। লাইন ঠিক করার পরে আবার চালু করা হয়েছে। এখানে লোডশোডিং খুবই কম।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান ইনকিলাবকে বলেসন, ডিপিডিসির কোন প্রকার লোডশোডিং নেই। তবে কোন এলাকায় দুঘর্টনা ঘটলে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করা হয়।
সম্প্রতি ৮৭৯ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এখন ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে (ক্যাপটিভ বিদ্যুতসহ), যা ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও গতিশীল নেতৃত্বের কারণে আমরা প্রায় ৯৯.৫ শতাংশ জনসংখ্যাকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে পেরেছি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার গত ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে এই সেক্টরের গুরুত্ব বিবেচনায় অগ্রাধিকার দিয়েছে। সরকারের আন্তরিক ও নিরলস প্রচেষ্টায় মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫৬০ কিলোওয়াট-এ পৌঁছেছে। যা ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ২২০ কিলোওয়াট এবং সিস্টেম লস ১৪.৩৩ শতাংশ থেকে ৮.৪৯ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এখন ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে (ক্যাপটিভ বিদ্যুতসহ), যা ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও গতিশীল নেতৃত্বের কারণে আমরা প্রায় ৯৯.৫ শতাংশ জনসংখ্যাকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে পেরেছি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার গত ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে এই সেক্টরের গুরুত্ব বিবেচনায় অগ্রাধিকার দিয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল ২৭টি। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত তার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৪৬টি। ওই সময় দেশের ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ছিল আর এখন তা প্রায় শতভাগ অর্থাৎ ৯৯ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায়। ২০০৯ সালে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। ক্যাপটিভ ও নবায়ণযোগ্য জ্বালানি মিলিয়ে এখন তা বেড়ে হয়েছে ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। এই বছরে বিদ্যুতের গ্রাহক ১ কোটি ৮ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৯ লাখ। গ্রাহক যেমন বেড়েছে তেমনি কমেছে সিস্টেম লস। ১২ বছরে সিস্টেম লস ১৪ দশমিক ৩৩ থেকে কমে ৮ দশমিক ৪৮ হয়েছে।
রাজধানীর উত্তরা এলাকার বাসিন্দার গালীব হোসেন বলেন, প্রতিদিন যদি ১ মিনিট করে বিদ্যুৎ যায় তবে একটি কারখানায় মাসে ৩০ ঘণ্টা কাজ বন্ধ থাকে। কারণে একবার বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটলে ওই কারখানা চালু করতে কমপক্ষে এক ঘণ্টা সময় লাগে। আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অপরিসীম। অভিযোগ করলে মামলার ভয় দেখান। এদিকে কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সামান্য একটু বৃষ্টি হলে তিন দিন বিদ্যুৎ থাকে না বলে জানিয়েছেন মোহাতার আলী। তিনি বলেন, সরকার শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড গড়ে বাহবা নিতে চাইছে। কিন্তু আমাদের দিকে নজর নেই।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিদ্যুৎ বা জ্বালানি সঠিক দাম ও মানে পাওয়া জনগণের অধিকার। একই সঙ্গে পরিবেশ রক্ষার দিকটিও সংবিধান নিশ্চিত করেছে। জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের চেয়ে বিদ্যুতের মূল্য কম। রেগুলেটরি কমিশনের দায়িত্ব ছিল ভোক্তা অধিকার রক্ষা করা এবং বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসা। এখন দেখা যাচ্ছে, বিনিয়োগের লাভের হার এত বেশি রাখা হয়েছে যে, এখানে অর্থলগ্নিতে লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। দুর্নীতির জন্য প্রকৃত দামের চেয়ে দুই থেকে আড়াই গুণ দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের।
ক্যাবের সভাপতির গোলাম রহমান বলেন, জ্বালানি খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। যতক্ষণ না সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, ততক্ষণ সোচ্চার থাকতে হবে। অনিয়ম বন্ধ না হলে বিদ্যুৎ খাতে সুফল মিলবে না। অনিয়ম বন্ধ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পনাগুলোর সুফল মিলবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন