রোববার বিকেলে বৃষ্টিভেজা শ্রীনগর শেখ-উল-আলম এয়ারপোর্ট। টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের গা ঘেঁষে ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের টিকিট অফিসের সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিলেন একদল শ্রমিক। পরনে মলিন পোশাক, চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়ের আভাস। এবং চেহারা দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যায়, স্থানীয় কাশ্মীরিদের সঙ্গে দূরতম সম্পর্কও নেই তাদের, এরা এসেছেন সুদূর বিহার, উত্তরপ্রদেশ বা ঝাড়খন্ড থেকে।
তারা কোনওভাবে পাঁচ-সাত হাজার রুপির সঞ্চয় জড়ো করে তারা দিল্লির যে কোনও একটা প্লেনের টিকিট কাটতে বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে বিমানবন্দরে চলে এসেছেন। আর যাদের হাতে অতটাও পয়সা নেই, তারা যাচ্ছেন জম্মুগামী বাসের টার্মিনাসে বা শেয়ারের ট্যাক্সি ধরতে - যে কোনওভাবে ভ্যালি থেকে পালানোই তাদের লক্ষ্য। আসলে গোটা কাশ্মীর উপত্যকা জুড়েই বিহার, উত্তরপ্রদেশের মতো নানা রাজ্য থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা আসেন একটু বেশি উপার্জনের আশায় - কারণ সেখানে নির্মাণ শিল্পের মজুর হিসেবে বা ছোটখাটো জিনিসপত্র বেচে রোজগারের সুযোগ বাকি দেশের চেয়ে অনেক বেশি।
ভোরবেলায় তারা অনেকেই জড়ো হয়ে যান শ্রীনগর, অনন্তনাগ, বারামুলার ‘লেবার চক’গুলোতে - যেখান থেকে ঠিকাদাররা তাদের সঙ্গে মজুরি নিয়ে দরাদরি করে নিয়ে যান কাজের সাইটে। কেউ আবার রাস্তার মোড়ে মোড়ে বেচেন রোস্টেড হ্যাজেলনাট বা আখরোট, কেউ বসেন জ্যাকেট-জাম্পার-স্কার্ফের পসরা সাজিয়ে। কিন্তু অক্টোবরের শুরু থেকেই কাশ্মীরের এই ছবিটা আমূল বদলে গেছে - অজ্ঞাতনামা সশস্ত্র ব্যক্তিদের হামলায় একের পর এক বেসামরিক মানুষ ও অভিবাসী শ্রমিক নিহত হওয়ার পর তারাই এখন উপত্যকা ছেড়ে পালাতে মরিয়া।
রোববারও কুলগাম জেলার ভানপো-তে বিহারের দু’জন নির্মাণ শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, আরও একজন মজদুর আহত হয়েছেন - এবং এই নিয়ে চলতি মাসে মোট ১১জন বেসামরিক মানুষ কাশ্মীরে প্রাণ হারিয়েছেন। এর আগে বিহারি পানিপুরি বিক্রেতা অরবিন্দ শাহ-কে শ্রীনগরে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মারা হয়, আর পুলওয়ামাতে গুলিতে মারা যান উত্তরপ্রদেশ থেকে কাশ্মীরে কাঠের মিস্ত্রির কাজ করতে আসা সাগির আহমেদ।
বিহারের সাসারাম থেকে আসা রূপেশ কুমার শ্রীনগরে আখরোট বেচছিলেন গত কয়েক মাস ধরে, তিনি জানাচ্ছেন, ‘এই পরিবেশে আমার আর কাশ্মীরে থাকার সাহস নেই, হাতের মালটুকু বেচেই আমি গাঁয়ে ফিরে যাব।’ গয়া জেলার মুরারি কিষেণও আগামী সপ্তাহেই শ্রীনগর ছাড়বেন। তিনি পাশ থেকে যোগ করেন, ‘প্রশাসনের পক্ষে তো সবাইকে সুরক্ষা দেয়া সম্ভব নয় ... কাশ্মীর ছেড়ে যেতই হবে, কারণ রোজগারের চেয়ে জীবনের দাম অনেক বেশি!’
রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ফারুক আবদুল্লা বলছেন, কাশ্মীরিদের বদনাম করতেই ষড়যন্ত্র করে এই সব খুনখারাপি চালানো হচ্ছে - যদিও দেশে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতৃত্ব দাবি করছে এই সব হত্যাকান্ডের পেছনে পাকিস্তানের মদত আছে। ফারুক আবদুল্লার কথায়, ‘নিরপরাধ মানুষদের এভাবে মারা খুবই অনুতাপের বিষয় এবং আমার ধারণা একটা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই করা হচ্ছে। আমি নিশ্চিত যে কাশ্মীরিদের এই সব হত্যাকান্ডে কোনও হাত নেই - বরং আমাদের, অর্থাৎ কাশ্মীরিদের বদনাম করতেই এগুলো করা হচ্ছে।’
এই সব হত্যার পেছনে যারাই থাকুক, কাশ্মীরের অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক যে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে কোনও ভুল নেই। এ মাসের গোড়ার দিকে শ্রীনগরে গুলি করে হত্যা করা হয় ফিরিওলা বীরেন্দ্র পাসোয়ানকে - যিনি বিহারের ভাগলপুর থেকে এসে কাশ্মীরে রুটিরুজি কামাচ্ছিলেন। ভাগলপুরে তার স্ত্রী বলছিলেন, মারা যাওয়ার ঠিক আগেও তার সঙ্গে ফোনে স্বামীর লম্বা কথা হয়েছিল - আর তিনিও ধারদেনা সব চুকিয়ে দিনকয়েকের মধ্যেই দেশে ফেরার পরিকল্পনা করছিলেন।
বীরেন্দ্র পাসোয়ানের সে স্বপ্ন সত্যি হয়নি, আর এখন একের পর এক হত্যাকান্ডের জেরে কাশ্মীরে বসবাসরত বেশ কয়েক হাজার অভিবাসী শ্রমিক ও কাশ্মীরি হিন্দু পন্ডিত পরিবার ভ্যালি থেকে পালিয়ে আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। অক্টোবরের গোড়াতেই শ্রীনগরে গুলি করে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয় হিন্দু পন্ডিত সমাজের সুপরিচিত ও প্রবীণ সদস্য মাখনলাল বিন্দ্রুকে, যিনি শহরে ‘বিন্দ্রু মেডিকেয়ার’ নামে একটি বড় ওষুধের দোকান চালাতেন। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় হিন্দু পন্ডিতরা যখন হাজারে হাজারে উপত্যকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, মাখনলাল বিন্দ্রু তখনও শ্রীনগর ছেড়ে যাননি। গত পঞ্চাশ বছর ধরে তার দোকান চালু থেকেছে একটানা।
সেই মাখনলাল বিন্দ্রুকেও যখন নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হয়েছে, তার জেরে উপত্যকায় টিঁকে থাকা কয়েকশো হিন্দু পন্ডিত পরিবারের মধ্যেও নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ফলে বিহার-উত্তরপ্রদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের পাশাপাশি তুলনায় বেশ কিছুটা সম্পন্ন হিন্দু পন্ডিতরাও এখন দিল্লি বা জম্মুর প্লেনের টিকিট কাটতে উঠেপড়ে লেগেছেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন