তালেবানের কাবুল জয়ের পর থেকে উদ্বেগ ছিল যে তারা মেয়েদের শিক্ষার অধিকার রুদ্ধ করে দেবে কিনা। কিন্তু না, সমস্ত উদ্বেগ দূর করে দিয়ে তারা পর্দাসাপেক্ষে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বহাল রাখার নীতি নিয়েছে। ইসলামিক মূলনীতি হিসেবে তারা সহশিক্ষা অনুমোদন করেনি; তবে ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্য আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠানে পড়ার নির্দেশ জারি করেছে। তারা বলেছে, মেয়েদের উচ্চশিক্ষা অর্জনে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এর আগে কাবুলে একটি সংবাদ সম্মেলনেও তারা বলেছিল, শরিয়া মোতাবেক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতসহ বিভিন্ন খাতে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হবে। নারীদের ব্যাপারে তালেবানের বর্তমান অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত বাস্তবমুখী বলে প্রতীয়মান হয়।
প্রধানত নারী ইস্যুতে পাশ্চাত্য মিডিয়া অব্যাহত প্রপাগান্ডা চালিয়ে তালেবানকে সবসময় ডিহিউম্যানাইজ ও ভিলিফাই করার চেষ্টা করে গেছে। সেই নিরবচ্ছিন্ন প্রপাগান্ডা অনেককে প্রভাবিত করেছে। অনেকেই সেসব প্রপাগান্ডা বিশ্বাস করে এসেছে। কিন্তু তালেবান তাদের বিগত শাসনামলে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া এবং ঘর থেকে বেরুনোর ক্ষেত্রে কেন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, সেটা অনেকেই গভীরভাবে চিন্তা করেনি। বরং পাশ্চাত্য মিডিয়া যেভাবে প্রচার করেছে, অনেকেই সেভাবে তা সোজাসাপ্টা গ্রহণ করেছে।
পরাজিত দখলদার সোভিয়েতরা ভেগে যাওয়ার পর আফগানিস্তানে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এরমধ্যে তালেবান আফগানিস্তানের ৮৫ ভাগ ভূমির নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং সেটার ওপরই ইসলামিক আমিরাত গঠন করে। আর বাকি অংশের নিয়ন্ত্রণ থাকে তালেবানের প্রতিপক্ষ নর্দার্ন এলায়েন্সের হাতে। নর্দার্ন এলায়েন্স তালেবানের বিরুদ্ধে তখন সশস্ত্র যুদ্ধ করছিল। ঠিক এরকম অস্থির গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিতে মেয়েদের সম্ভ্রম ও সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থেই তাদের স্কুলে যাওয়া ও ঘর থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ওই সময়ের তালেবান শাসিত ইসলামিক আমিরাত। অথচ, পাশ্চাত্য মিডিয়া একদিকে তালেবানকে ভয়েসলেস করে রাখলো, অন্যদিকে অব্যাহত প্রপাগান্ডার মাধ্যমে বিশ্বের কাছে তালেবানকে বর্বররূপে উপস্থাপন করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য শক্তির সামরিক আগ্রাসনকে জায়েজ করতে থাকলো।
২০১০ সালে ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্র নেদারল্যান্ড আফগানিস্তান থেকে তার সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট হোঁচট খায়। এর ফলে ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্রও নেদারল্যান্ডকে অনুসরণ করতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে আফগান নারীদের ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করার উদ্যোগ নেয় সিআইএ। উদ্দেশ্য হলো, আফগানিস্তানের মেয়েরা অরক্ষিত এবং তালেবান ক্ষমতায় এলে তারা আবারও নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হবে- এমন মানবিক আবেদন ন্যাটো’র অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরা, যাতে তাদের আর কেউ আফগান যুদ্ধ থেকে সরে না পড়ে। উইকিলিক্সে ফাঁস হওয়া সিআইএ’র ক্লাসিফায়েড নথি থেকে সংস্থাটির এ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানা যায়। এ বিষয়ে জার্মানির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে’র এক রিপোর্টে বলা হয়েছে:A leaked CIA document suggests recruiting Afghan women to help drum up support for the war in Afghanistan. The intelligence agency is concerned about waning enthusiasm for the NATO effort, especially in Europe. (27 March 2010).
আমেরিকা তালেবানকে ‘নারীবিদ্বেষী’ হিসেবে তুলে ধরার শত চেষ্টা করলেও নারীর প্রতি খোদ আমেরিকার আচরণ কেমন তা অবশ্যই দেখার বিষয়। কারণ, আমেরিকার হাতে বন্দি একজন মুসলিম নারী স্নায়ুবিজ্ঞানী ড. আফিয়া সিদ্দিকা জেলে মার্কিন সৈন্যদের দ্বারা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে (১৯ জুন ২০১৮, দ্যা এক্সপ্রেস ট্রিবিউন)। অথচ, ইভান রিডলে নামে এক ব্রিটিশ নারী সাংবাদিক তালেবানের হাতে বন্দি অবস্থায় কেমন আচরণ পেয়েছিলেন তা আমরা জানি। একজন অসহায় বন্দি নারী সত্ত্বেও তালেবানের সম্মানজনক সদ্ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তিনি এমনকি পরে স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণও করেন; তার নতুন নাম মরিয়ম রিডলে। মুক্তির পর তাকে তার বন্দিদশা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, They (the Taliban) treated me with respect and courtesy. (8 Oct. 2001, CNN)। এছাড়া মুক্তির পর তাকে বিধ্বস্ত নয়, বরং বেশ খোশমেজাজেই দেখা গিয়েছিল বলে সংবাদমাধ্যমে জানা যায়। তবুও পাশ্চাত্য মিডিয়ার প্রপাগান্ডায় তাড়িত হয়ে অবলীলায় তালেবানকে সাব-হিউম্যান বা হাফ-হিউম্যান বলে অবজ্ঞা করতে অনেকের দ্বিধা হয় না।
আফগান যুদ্ধে ‘জঙ্গি’ নির্মূলের নামে আমেরিকা যে নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক হত্যা করেছে এবং এ যুদ্ধের ফলে আফগানিস্তানে কর্মরত অসংখ্য আমেরিকান সৈন্য ও বিশেষজ্ঞ যে মানসিক পীড়ার কারণে আত্মহত্যা করেছে, সেসব বিষয়ে পাশ্চাত্য মিডিয়ায় এখন কোনো উচ্চবাচ্য হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল এন্ড পাবলিক এফেয়ার্সের একটি অনুসন্ধানী রিপোর্টে জানা যায়, আফগান যুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা মোট ২ লাখ ৪১ হাজার, যার মধ্যে নিহত বেসামরিক নাগরিকদের সংখ্যা ৭১ হাজার (চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত)। এছাড়া ৯/১১-পরবর্তী মার্কিন যুদ্ধগুলোতে অংশগ্রহণকারী আমেরিকান সৈন্য ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে শুধু মানসিক পীড়াজনিত কারণে আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা ৩০ হাজারেরও বেশি। অথচ, বর্তমানে পাশ্চাত্য মিডিয়ায় এসব একেবারেই আলোচনায় আনা হচ্ছে না। কারণ, সেসব নিহতরা এডওয়ার্ড হারম্যান ও নোয়াম চমস্কির ভাষায় ‘মূল্যহীন ভিকটিম’ (unworthy victims)- যারা আমেরিকার রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মিডিয়ায় খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না।
অপরদিকে, পাশ্চাত্য মিডিয়ার কাছে আফগান মেয়েরা হলো মূল্যবান ভিকটিম (worthy victims)। কারণ, সাধারণত যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে বা সমাজে প্রধানত মেয়েরা নানা দিক থেকে বঞ্চনার শিকার হয়। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। তাই তালেবানকে ডেমোনাইজ করার আমেরিকার রাষ্ট্রীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে ‘মূল্যবান ভিকটিম’ হিসেবে আফগান মেয়েদের বঞ্চনাগুলোকে পশ্চিমা মিডিয়ায় অতিরিক্ত সংবেদনশীলভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। আর এটি তালেবানের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রপাগান্ডা ক্যাম্পেইনে রূপ নিয়েছে। চমস্কি ও হারম্যান প্রপাগান্ডা ক্যাম্পেইনকে ‘রাষ্ট্র ও মিডিয়ার যৌথ প্রযোজিত’ বলে উল্লেখ করে লিখেছেন: Some propaganda campaigns are jointly initiated by government and media; all of them require the collaboration of the mass media. ...A propaganda approach to media coverage suggests a systematic and highly political dichotomization in news coverage based on serviceability to important domestic power interests. Such dichotomization in the mass media is massive and systematic: not only are choices for publicity and suppression comprehensible in terms of system advantage, but the modes of handling favored and inconvenient materials (placement, tone, context, fullness of treatment) differ in ways that serve political ends. (Page: 34-35, Section: 1.6, Manufacturing Consent: The Political Economy of the Mass Media).
সুতরাং, নারী ইস্যুতে তালেবানের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা ক্যাম্পেইন পরিচালনার ক্ষেত্রে মার্কিন গণমাধ্যমগুলোই যে একা ভূমিকা পালন করছে তা নয়, মার্কিন রাষ্ট্রও তার স্বীয় স্বার্থে এতে সম্পৃক্ত। চমস্কি ও হারম্যানের মতে, মার্কিন গণমাধ্যমগুলোতে প্রধানত সংবাদ পরিবেশন করা হয় আমেরিকান রাষ্ট্রক্ষমতার স্বার্থোপযোগী একটি কাঠামোগত রাজনৈতিক বৈপরীত্যের ভিত্তিতে-অর্থাৎ কোনো সংবাদ আমেরিকার রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পক্ষে গেলে ব্যাপক প্রচার করা আর বিপক্ষে গেলে চেপে রাখা বা কম গুরুত্ব দেয়ার নীতির ভিত্তিতে (dichotomization)। এছাড়া উইলিয়াম আর্কিন নামে ইউএস আর্মির একজন সাবেক ইন্টেলিজেন্স বিশেষজ্ঞ একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমেরিকা এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য মিডিয়া যুদ্ধক্ষেত্রের তথ্যের জন্য মিলিটারির ওপর নির্ভর করে থাকে। কারণ, রিপোর্টাররা যুদ্ধক্ষেত্রে ভ্রমণ করতে পারে না বলে তারা মিলিটারি থেকে যেমন সংবাদ পায়, তেমনটাই তারা রিপোর্ট করে। আর যখন মিলিটারি অফিসাররা মিডিয়ার মাধ্যমে পাবলিককে এমন তথ্য দেয় যেটা প্রপাগান্ডা উৎপাদন করে এবং প্রতারণা, ধোঁকা ও প্রত্যাখ্যানকে উচ্চমূল্য দেয়, তখন আসলে সর্বাগ্রে সত্যের মৃত্যু ঘটে।’ (১৩ নভে. ২০০২, লস এঞ্জেলস টাইমস)।
যাহোক, তালেবান বাহিনী সুদীর্ঘ দুই দশক যুদ্ধ করে দেশ দখলমুক্ত করার পর এখন পর্যন্ত আমেরিকার একটা কোলাবোরেটরকেও হেনস্তা করেনি। বরং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে। কাউকে শাস্তির কোনো হুমকিও দেয়নি। কাবুলের কোনো সাধারণ নাগরিকের ঘর-বাড়িতেও হানা দেয়নি। জ্বালাও-পোড়াও করেনি। তবুও কাবুলের এক শ্রেণীর নাগরিকের আফগানিস্তান ত্যাগ করতে চাওয়ার কারণ মূলত দুটি: সুযোগে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর লোভ, আর নয়তো অতীত কৃতকর্মের শাস্তির ভয়।
ইতিহাসে দেখা যায়, বিজয়ীরা কীভাবে পরাজিতের ওপর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে প্রতিশোধ নেয়। ফরাসি বিপ্লবের পর বিজয়ী বিপ্লবীরা তাদের প্রতিপক্ষের ওপর নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায়। গিলোটিনের কোপে বিরোধীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো বিনা বিচারে। এই নির্মম সময়কে ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্ব বা রেইন অব টেরর বলে অভিহিত করা হয়। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়ে জার্মানির বার্লিন দখল করার পর সোভিয়েত, আমেরিকান, ব্রিটিশ, ফরাসি ও পোলিশ সৈন্যরা ২০-২৫ লক্ষ জার্মান নারীকে গণধর্ষণ করে। এমন অনেক ইতিহাস আছে। অথচ, এখন পর্যন্ত মুসলিম শাসকদের যুদ্ধজয়ের ইতিহাসে এ ধরনের কোনো কলঙ্ক নেই। এমনকি সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ বিজয়পূর্বক ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করার পর যখন পরাজিত ভূমির অধিবাসী খ্রিস্টানরা ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল, ছোটাছুটি করছিল এবং দিকবিদিক পালাচ্ছিল, তখন তিনি তাদের সবার প্রতি ক্ষমা, সহানুভূতি ও নিরাপত্তা প্রদান করেন। নিজ সৈন্যদের তিনি কোনো লুটপাট ও অরাজকতা করা থেকে বিরত থাকার কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ঠিক একইভাবে তালেবানের কাবুল দখলে নেয়ার পর আমেরিকার দোসররা আতঙ্কিত হয়ে দিকবিদিক পালাতে থাকলে তালেবান তাদের মুজাহিদিনদের নির্দেশ দিয়েছে, বিনা অনুমতিতে কারো ঘরে প্রবেশ না করতে এবং নাগরিকদের সম্মান ও সহায়-সম্পত্তি রক্ষা করতে। তারা সবার প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে এবং সবার জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
মিডিয়া যেভাবে তালেবানকে এত বছর ডেমোনাইজ করেছে, সেই তালেবানই আমেরিকার দালালদের প্রতি এমন মহানুভবতা ও ক্ষমাশীলতা প্রদর্শন করবে, তা ছিল ভাবনাতীত। কিন্তু তারা তো শুধু রুক্ষ পাহাড়ি যোদ্ধা মাত্র নয়, তারা একই সাথে তালেবুল ইলমও। ইলমের চর্চার মধ্যদিয়ে তারা রাসূল (সা.)-এর মহানুভবতা ও ক্ষমাশীলতার শিক্ষা লাভ করেছে। ফলে তাদের কাছ থেকে এমন মহানুভবতা পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন