তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বায়নের যুগে বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মহামারি আমাদের বিশ্বকে বহুলাংশে অবশ্যিকভাবেই ইন্টারনেট বা অনলাইন নির্ভরশীল করে তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি কেনাকাটা, ই-কমার্স, ব্যাংকিং, সরকারি-বেসরকারি পরিষেবা, ই-গভর্নেন্স, অনলাইন স্কুলিং বা ই-লার্নিং থেকে শুরু করে সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে অনলাইন মিডিয়ার সংযোগ বেড়েই চলেছে। অনলাইন বা সাইবার জগতের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংশ্রব বৃদ্ধির সাথে সাথে সাইবার অপরাধের মাত্রা ও সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অনলাইনে তথ্য চুরি, ব্যাংকিং সেক্টরে সুইফ্ট কোড হ্যাকিং, ই-কমার্সের প্রতারণা থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সব শ্রেণির মানুষের সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে সামাজিক সংকট সৃষ্টির ঘটনাগুলোকে এখন আর অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। দেশের মোবাইলফোন ও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারকারী জনসংখ্যা কমপক্ষে ১০ কোটি। অর্থাৎ দেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারই কোনো না কোনোভাবে এখন অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, গৃহবধু ও পেশাজাবী নারী, শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো ব্যক্তি সাইবার বুলিং বা সাইবার অপরাধীদের টার্গেট হতে পারেন। দেশে প্রতিদিন ঠিক কত সংখ্যক মানুষ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছেই নেই। এর কারণ হচ্ছে, যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন তাদের অনেকেই আইনের আশ্রয় নিতে চান না। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিটে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন বা মাসে ১২০০ জন সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে অভিযোগ করেছে। এ সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু সংখ্যক ই-কমার্স কোম্পানির প্রতারণা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের সংশ্লিষ্টদের তৎপর দেখা গেলেও সাইবার বুলিংয়ের কারণে অসংখ্য পরিবারে অশান্তি, দাম্পত্য কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদসহ নানাবিধ সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয় সচেতনতা ও নিরাপত্তা জোরদারের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়ার পেছনে এসব মাধ্যম ব্যবহারকারীদের অসচেতনতা এবং পারিবারিক নিয়ন্ত্রণহীনতা অনেকাংশে দায়ী। উঠতি বয়েসী তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে শিশু-কিশোর ও নারীরা বেশি সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়ার পেছনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী একশ্রেণির বখাটে তরুণ ও কিশোর অপরাধীদের তৎপরতা লক্ষনীয়। বুলিংয়ের শিকারে পরিণত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও পরিবারকে চাপে ফেলে স্বার্থ হাসিল বা ব্ল্যাকমেইল করে ভিকটিমের কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবির ঘটনাও বেড়ে চলেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি ও তথ্য পোষ্ট করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সচেতনতা ও পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার মাধ্যমে সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। ডিজিটাল ডিভাইস ও স্মার্টফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষত শিশু, কিশোর-কিশোরীসহ সবাইকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই।
ডিএমপি’র সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ফেইসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাইবার বুলিংয়ের ভিকটিমদের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগই ১৯ থেকে ৩৫ বছর বয়সী, তাদের বেশিরভাগই নারী। পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, র্যাবের বিশেষ টিমসহ সাইবার অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশকিছু ইউনিট সক্রিয় থাকলেও অপরাধের মাত্রা দিন দিন বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে ভিকটিমের সংখ্যা তুলনায় এ ক্ষেত্রে আইনগত প্রতিকার পাওয়ার সংখ্যা খুবই কম। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় যেসব মানুষকে মামলা ও গ্রেফতার করা হচ্ছে তার বেশিরভাগই রাজনৈতিক হয়রানিমূলক এবং বিরোধী মতের রাজনৈতিক কর্মী ও গণমাধ্যম কর্মীদের কণ্ঠরোধের উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা বাস্তবায়ন এবং ইন্টারনেট মাধ্যমকে জনবান্ধব ও অর্থনীতির জন্য সহায়ক মাধ্যম হিসেবে এর সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অনলাইন যোগাযোগ ও লেনদেন মাধ্যমকে রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে রেখে এর স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধের পাশাপাশি সাইবার-ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে নাগরিকের সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ নস্যাতের সাথে জড়িত অপরাধীদের তাৎক্ষণিকভাবে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার সক্ষমতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অর্জন করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতনতা সাইবার বুলিংয়ের সমস্যা কমিয়ে আনতে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন