মেহরিন কুইন
খুব বেশি আগের কথা নয়Ñ যখন মায়েদের চোখে একজন সন্তান ছেলে না মেয়ে সে বিবেচনায় দেখা হত। মাছের মাথা বা মুরগির রান পাশে থাকা মেয়েটিকে না শুধু ছেলের জন্য বরাদ্দ থাকত। সংসারের কাজের ভাগাভাগি হিসেব করত মেয়েটির সাথে। বয়সে ছেলে সন্তানটি বড় হলেও মেয়েটির উপরেই দায়িত্ব পড়ত ভায়ের কাপড় পরিষ্কার রাখা এবং তার পড়ার টেবিল গোছান। খাটি গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে গরম গরম এক গ্লাস দুধ জুটতো ছেলেটির কপালে। শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের এখন আর ছেলের পাতে সব ভাল খাবার তুলে দেয়ার মাধ্যমে মেয়েকে বঞ্চিত করার রীতি হয়ত খানিকটা বদলেছে কিন্তু গ্রামগঞ্জে প্রকাশ্যে কন্য সন্তানের জন্ম নেয়ায় মুখ কালো করার রীতি এখনও আছে। সমাজের কোন কোন অংশে এখনও কন্যাশিশুর জন্মটাকে সমাদৃত হয় না ঘটা করে। আবার একাধিক কন্যাশিশু জন্ম দেয়ায় অনেক মাকে সতিনের ঘর করতেও বাধ্য করা হয়। কোথাও কোথাও কন্যাশিশুকে বোঝা মনে করে জন্মানোর সাথে সাথেই ডাস্টবিনে ফেলে দেয়ারও নজির আছে। শুধু কি তাই- শিক্ষার ক্ষেত্রেও অনেক বৈষম্য অহরহই দেখা যায়। উচ্চবিত্তের কথা আলাদা, মধ্যবিত্ত বা নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলেকে একটা ভাল স্কুলে পড়ালেও মেয়েটি পড়ার সুযোগ পায় নি¤œমানের স্কুলে। আবার উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ছেলেকে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে বা দেশের বাইরে পড়ার সুযোগ করে দিলেও মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অভিভাবক। অলিখিত একটা ব্যবধান সবখানেই।
‘শিক্ষা-পুষ্টি নিশ্চিত করি, শিশু বিয়ে বন্ধ করি’ এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে গত ৩০ সেপ্টেম্বর কন্যাশিশু দিবস পালিত হয়েছে। কন্যাশিশুর অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে ১৯৫৪ সালে জাতিসংঘে এক প্রস্তাবে প্রতি বছর ২৯ সেপ্টেম্বর শিশু অধিকার দিবস ঘোষণা করা হয়। শিশু অধিকার সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনে জাতীয়ভাবে কন্যাশিশু দিবস পালিত হয়। বিভিন্ন আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দেশে দিবসটি পালন করে। ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশেও সকল প্রকার বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে জাতীয়ভাবে পালিত হয়েছে কন্যাশিশু দিবস। দেশে মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু রয়েছে। তার মধ্যে ৪৮ শতাংশ কন্যাশিশু। অথচ দেশে এখনও কন্যাশিশুরা বঞ্চিত হয় যথাযথ মর্যাদা, পুষ্টি ও শিক্ষা থেকে। পুত্রসন্তান মানে বংশের বাতি, ভবিষ্যৎ বংশধর এবং সম্পত্তির রক্ষক সেভাবেই তাদের মর্যাদা দেয়া হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর ‘জাতীয় কন্যাশিশু’ দিসবটি পালন করে থাকে দেশের সরকারি পর্যায় থেকে বিভিন্ন সংগঠন। শিশুরা হচ্ছে জাতির ভবিষ্যৎ এবং একই সাথে সমাজের সবচেয়ে দুর্বল অংশ। কন্যাশিশুদের প্রতি বৈষম্য দেখানো চলবে না, তাদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে ইত্যাদি আহ্বান থাকে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায়। এসব ব্যবধান দূর করে শিশুর পরিচয় সে শুধুই শিশু। ছেলে শিশু নাকি মেয়ে শিশু সে দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের বের হয়ে আসা জরুরি। শিশুর প্রতি ব্যবহারে সর্তকতা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বিশ্বশিশু পরিস্থিতিতে পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থা বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও বর্তমান বিশ্ববাসীদের মধ্যে এক জায়গায় একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায় যা হচ্ছে শিশু অধিকার সম্পর্কে পূর্বেকার যে কোনো সময়ের চেয়ে আরো অনেক বেশি সচেতনতা। শিশুর প্রতি দায়িত্ববোধ এখন আর শুধু নীতিবোধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়-বরং তা ক্রমবর্ধমান হারে বৃহত্তর সামাজিক ও আইনানুগ বাধ্যবাধকতার আওতায় চলে আসছে।
শিশুরাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের কর্ণধার, শিশুদের হাতেই আগামীর পৃথিবীর ভার, শিশুরাই আমাদের অহংকার› এ ধরণের কথা শুনছি জ্ঞানী গুণীর মুখে ও পাঠ্য বইয়ে। প্রতি বছর শিশুদের নিয়ে আন্তর্জাতিক শিশু দিবস, কন্যাশিশু দিবস পালন করা হচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও টিভি বা খবরের কাগজের শিরোনাম হচ্ছে শিশু নির্যাতনের অনেক খবর। সমাজে অবহেলিত, নির্যাতিত, বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে অনেক শিশু। পারিবারিক ক্ষেত্রেও কন্যাশিশুর অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে না। শিশু সুরক্ষার জন্য শিশু নীতিমালা, শিশু অধিকার আইন ইত্যাদি করা হলেও এখনো রয়েছে কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্য। শিশুশ্রম রোধ ও তাদের সুরক্ষায় ঢাকঢোল পিটিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা। ভূরি ভূরি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে কাগজে-কলমে। তবু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ছে অহরহ। বিভিন্ন কলকারখানা, ইমারত নির্মাণ, দিনমজুরি, রিকশা, ঠেলা, ভ্যান চালানোসহ বিভিন্ন শ্রম কাজে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অর্থ সঙ্কটে পড়ে এমন অনেক শিশুকেই শ্রমে নিয়োজিত করছেন দরিদ্র অভিভাবকরা।
শিশুদের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রণীত হয় শিশু আইন-১৯৭৪ যা যুগোপযোগীকরণের মাধ্যমে শিশু আইন-২০১১ রূপে প্রণয়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ, ১৯৮৯-এ স্বাক্ষর ও অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এরপরেও শিশুর প্রতি বৈষম্য আর অধিকারের বিষয়টি আমরা ভুলে যাই। শিশু হল নরম কাদামাটির মত। কাদামাটিকে যেভাবে ইচ্ছে রূপ দেয়া যায় শিশুকেও ঠিক একইভাবে যতœ করে বড় করে তোলা যায়। শিশুর মানষিকতারও বিকাশ ঘটানো সম্ভব এবং এভাবেই বিকশিত হয়ে উঠতে পারে একজন শিশু। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা-এই পাঁচটি হল মানুষের মৌলিক অধিকার- এ বিষয়কে যদি আমরা পুরোপুরিভাবে শিশুদের জন্য নিশ্চিত করতে পারি তাহলে আগামী দিনের জন্য সুস্থ শিশু তথা সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন