দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বদ্ধ জলাশয়, পুকুর ও হ্রদে বিষ প্রয়োগে মাছ ধরার প্রবণতা চলছে। এখন সুন্দরবনের উন্মুক্ত জলাশয়ে বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরা চলছে। নদী, খাল, হাওড়, সুন্দরবন বা যেকোনো উন্মুক্ত জলাশয়ের সাথে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ, খাদ্যচক্র ও জীববৈচিত্র্যের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাধারণ মানুষ, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের নীরব ভূমিকা পালনের কোনো সুযোগ নেই। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, জেলে নামধারী সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তরা দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকা ও বিভিন্ন খালে পানিতে কীটনাশক মিশিয়ে মাছ ধরছে। উন্মুক্ত জলাশয়ে কীটনাশক প্রয়োগ করলে ছোটবড় মাছ, মাছের পোনা, রেণুপোনা, সব ধরণের প্রাণী, অনুজীব এবং জলজ উদ্ভিদেরও বিনাশ ঘটে। বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ধরা মাছ খাওয়া জনস্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। দেশে কিডনী রোগ, ক্যান্সারসহ নানা ধরণের স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য ভেজাল খাদ্য অনেকাংশে দায়ী। বিষ প্রয়োগে ধরা মাছ খেলে মানব শরীরে বিষক্রিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সৃষ্টি করে। সুন্দরবনে বনবিভাগের একশ্রেণীর কর্মকর্তার যোগসাজসে দুর্বৃত্তরা বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে সাধারণ জেলেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকারের অপতৎপরতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে সুন্দরবনের জলাশয়গুলো মৎস্যশন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সুন্দরবন বিশ্বের অন্যতম প্রধান ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ও ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত বিশ্ব ঐতিহ্য। শুধু ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট হিসেবেই নয়, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, নানা ধরণের পাখি, ইরাবতি ডলফিনসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজ ও উভচর প্রাণীরও অভয়ারণ্য হিসেবে সুন্দরবনের বিশেষত্ব রয়েছে। যেখানে জীব বৈচিত্র ও পরিবেশের জন্য হুমকির থাকায় তেল ও বর্জ্য ফেলার কারণে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত রাখা হচ্ছে, সেখানে একশ্রেণীর দুবৃর্ত্ত অবাধে বিষ প্রয়োগে মৎস্য শিকারের মতো বেপরোয়া কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে। বিষ মিশ্রিত পানি যেমন সব ধরনের জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, একইভাবে বাঘ, হরিণসহ সব ধরণের প্রাণী স্বাস্থ্যেও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে কীটনাশক প্রয়োগের কারণে সুন্দরবনের মাটির স্বাভাবিক জৈব গুণাগুণও নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিবেশবিদরা সুন্দরবন রক্ষায় সেখানে ভারি শিল্পের অনুমোদন বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। দেশের জনমত এখনো সুন্দরবন এলাকায় রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র বাস্তবায়নের বিপক্ষে। তারপরও সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে এর ক্ষতিসাধনের নানা ধরনের অপকর্ম চলছে। বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী এই প্রাকৃতিক বনকে ধ্বংস করার এসব অপকর্ম বন্ধ করা যাচ্ছে না। আশার কথা, নিরাপত্তা বাহিনী ইতিমধ্যে সুন্দরবন থেকে বনদস্যু দমনে যথেষ্ট সফল হয়েছে। এখন মৎস্য ধরার নামে নির্বিচার বিষ প্রয়োগ করে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসকারিদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে।
বিশ্বের উষ্ণায়ণ ও জলবায়ুর পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ফসিল জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সবুজ বনায়ন ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা এই উদ্যোগের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত। সামুদ্রিক ঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় সুন্দরবন আমাদের জন্য বার বার নিরাপত্তা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাজার হাজার জেলে পরিবারের কর্মসংস্থান, মৌয়ালদের মুধু সংগ্রহ, কাঠ ও গোলপাতা সংগ্রহসহ সুন্দরবন আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অন্যদিকে, বনদস্যুদের অপতৎপরতা, অবাধে গাছ কেটে চুরি করা, অতিমাত্রায় মৎস্য শিকার এবং বাণিজ্যিক জ্বালানি ট্যাঙ্কার ও রাসায়নিকবাহী জাহাজ ডুবির মত ঘটনায় সুন্দরবনের যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে মাছ শিকারিরা সাধারণ জেলে নয়। এরা ধ্বংসাত্মক উপায়ে মাছ শিকার করে। এই অপকর্মের সাথে বনবিভাগের একশ্রেণীর টহল ফাঁড়ির কর্মকর্তারাও জড়িত হয়ে পড়েছে। অর্থের বিনিময়ে এদেরকে ম্যানেজ করেই অবৈধভাবে কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরে বাজারজাত করছে তারা। বিষ প্রয়োগে মাছ ধরা চক্রের সাথে আঁতাত করার পাশাপাশি সাধারণ জেলেদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ নানাভাবে হয়রাণির অভিযোগও পাওয়া গেছে। সুন্দরবন রক্ষার সাথে জীববৈচিত্র্য, খাদ্যচক্র ও জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থেই এই দৃর্বৃত্তদের কঠোর হাতে দমন করার বিকল্প নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন