ডিজেলচালিত গণপরিবহনে ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণায় রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচল করা এবং দূরপাল্লার সব ধরনের বাসে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়ের ধুম পড়েছে। যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কারণে বিভিন্ন বাসে বিতণ্ডা ও হাতাহাতি হচ্ছে। বাস মালিকরা যাত্রীরা যাতে অতিরিক্ত ভাড়া দিতে বাধ্য হয় সে লক্ষ্যে পোষা গুণ্ডা বাহিনী লেলিয়ে দিচ্ছে। কোনো বাসে বিক্ষুদ্ধ যাত্রীর সঙ্গে কন্ডাক্টরের ঝগড়া হলেই কয়েক মিনিটের মধ্যেই গুণ্ডাবাহিনী হাজির হয়। তারা যাত্রীদের হুমকি ভয়ভীতি দেখিয়ে বেশি ভাড়া আদায়ে বাধ্য করছে।
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন রুটে চলাচল করা সিটি পরিবহনের মতো দূরপাল্লায় আন্তঃজেলা বাস সার্ভিসগুলোতেও মানা হচ্ছে না নির্ধারিত নিয়ম-নীতি। ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ানোয় গণপরিবহনেও ভাড়া বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংস্থাটি বলছে, এ বর্ধিত ভাড়া সিএনজিচালিত গণপরিবহনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। যদিও মাঠ পর্যায়ে তা কার্যকর হচ্ছে না। গত দু’দিন ডিজেলচালিত গণপরিবহনের পাশাপাশি সিএনজিচালিত গণপরিবহনেও যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। এমনকি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার অভিযোগ যাত্রীদের। বুয়েটের গবেষক ও যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে রাজধানীতে ৯৫ ভাগ গাড়ি সিএনজিতে চলে। অথচ এখন মালিক পক্ষ দাবি করছে বর্তমানে সিএনজিচালিত গাড়ির সংখ্যা বড়জোর ১ থেকে ২ শতাংশ হতে পারে। যাত্রীদের জিম্মি করে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। গণপরিবহনে যাচ্ছেতাই ভাড়া আদায় শুরুর দু’দিন পর বিআরটিএ’র ১৩টি মোবাইল কোর্ট মাঠে নেমেছে। তবে ভুক্তোভোগী যাত্রীদের দাবি এসব লোক দেখানো।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেছেন, সিএনজিচালিত গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় হচ্ছে কি না, এ বিষয়টি বিআরটিএ মনিটরিং করবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? ভাড়া বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারির পর এখন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি বলছে, সিএনজিচালিত গাড়িরও খরচ বেড়েছে। তাদের শুধু সিএনজির দাম বাড়েনি, বাকি সব খরচই বেড়েছে। এছাড়া সড়কে এখন মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ গাড়ি সিএনজিচালিত। বেশিরভাগ গাড়িই এখন তেলে কনভার্ট হচ্ছে। তবে কত সংখ্যক গাড়ি তেলে আর কতগুলো গ্যাসে চলে, এর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই বলে জানিয়েছে বিআরটিএ।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণার পর বস্তুত সড়কে সব গাড়িই যাত্রীদের কাছ থেকে বর্ধিত ভাড়া আদায় করছে। এমনকি সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে গত দু’দিন বিআরটিএ তদারকি করছে বলে দাবি করলেও প্রয়োজনের তুলনায় সে মনিটরিং অনেক কম। সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগ, ভাড়া সমন্বয়ের ঘোষণার পরই বাসগুলো যাচ্ছেতাই স্টাইলে পকেট কাটছে।
জানতে চাইলে বিআরটিএ পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) সারওয়ার আলম বলেন, আমাদের মনিটরিং টিম ৮ নভেম্বর থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে কাজ করছে। এর বাইরে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনও তদারকি করছে।
দূরপাল্লার বাস গলা কাটছে : ২৭ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়ার পর কোনো ধরনের হিসেব ছাড়াই দূরপাল্লার বাসগুলোতে যাত্রীদের কাছ থেকে গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এ নিয়ে বাস কাউন্টারগুলোতে টিকিট বিক্রেতাদের সঙ্গে যাত্রীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডার ঘটনা ঘটছে। এরপরেও বাধ্য হয়ে বাড়তি ভাড়াতেই গন্তব্যে রওনা হচ্ছেন সবাই। নির্ধারিত বাড়তি ভাড়ার হারের নিয়ম না মানার বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিতে পারছেন না কাউন্টারের দায়িত্বরতরা। তাদের বক্তব্য, মালিকের নির্দেশ মতো বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে, এর বেশি তারা কিছু জানে না।
ভুক্তভোগী যাত্রীদের অভিযোগ, বাড়তি ভাড়ার ঘোষণা দিয়ে সবকিছু জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সংশ্লিষ্টরা চুপ করে বসে আছেন। কোন রুটে কোন পরিবহনে কতো টাকা বাড়তি আদায় করবে এর কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। নজরদারির অভাবে পরিবহনগুলো সুযোগ বুঝে যেমন খুশি তেমন ভাড়া আদায় শুরু করেছে।
রাজধানীর অন্যতম বাসস্ট্যান্ড গাবতলী, মহাখালি, সায়েদাবাদ, কল্যাণপুর এলাকার কাউন্টার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। কল্যাণপুরে হানিফ বাস কাউন্টারে চট্টগ্রাম পর্যন্ত টিকিটের দাম রাখা হচ্ছে ৬০০ টাকা। আগে এ রুটে ৪৮০ টাকা ভাড়া থাকলেও এক লাফে টিকিটপ্রতি ১২০ টাকা বাড়তি আদায় করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম যেতে ইচ্ছুক হুমায়ুন খন্দকার নামে এক যাত্রী বলেন, তেলের দাম বাড়ানো হলো, এরপর ধর্মঘটের নাটক চললো। আসলে ধর্মঘট তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে হয়নি, এটা ভাড়া বাড়ানোর ধান্দা। এখন ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা পেয়ে যেমন খুশি তেমন ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই, এটা দেখারও যেন কেউ নেই।
একইভাবে গাবতলীতে সৌখিন পরিবহনে ফরিদপুরগামী ৩০০ টাকার টিকিট বিক্রি হচ্ছে এখন ৫৫০ টাকায়। এ নিয়ে টিকিট ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে বাগবিতণ্ডা দেখা গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০-৫০ টাকা কম রাখা হচ্ছে, যেন কারো কোনো নিয়ম মানার বালাই নেই।
শ্যামলী পরিবহনে কুষ্টিয়াগামী বাসের টিকিট বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা দামে, যা আগে ছিল ৪০০ টাকা। কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতা হাসান বলেন, সরকার নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ীই বাড়তি ভাড়া রাখা হচ্ছে। এর বেশি বা কম রাখা হচ্ছে না। কিলোমিটারপ্রতি বাড়তি ভাড়ার হিসেবে কুষ্টিয়া পর্যন্ত কতো হয়, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এতো হিসেব আমরা বলতে পারব না। মালিকপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী ভাড়া রাখা হচ্ছে।
একইভাবে নতুন ভাড়া অনুযায়ী রংপুরে ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৭০০ টাকা, বগুড়ায় ৩৫০ টাকার বদলে ৪৫০ টাকা, নওগাঁয় ৪০০ টাকার পরিবর্তে ৫৫০ টাকা, জয়পুরহাটে ৪৫০ টাকার টিকিট ৬০০ টাকা, ফরিদপুর পর্যন্ত ৩০০ টাকার পরিবর্তে ৫০০ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
ভ্রাম্যমাণ আদালত : সরকার নির্ধারিত নতুন ভাড়ার অতিরিক্ত আদায়ের অভিযোগে বিভিন্ন রুটের বাসে জরিমানা করছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালত। বাস ভাড়া বাড়ার দুদিন পর তৎপর হলো সংস্থাটি। মঙ্গলবার থেকে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে বিআরটিএ ১৩টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ২২০টি গাড়ি মনিটরিং করেছে। এর মধ্যে ৫৯টি সিএনজিচালিত পরিবহন ছিল। ডিজেলচালিত ৩৮টি গাড়ি ও ২৯টি সিএনজিচালিত গাড়িকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের দায়ে জরিমানা করা হয়েছে। ওইদিন মোট আদায় করা জরিমানার পরিমাণ ১ লাখ ৫৪ হাজার ১০০ টাকা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটিএর একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, আসলে শুধু ডিজেলের দাম বাড়ানোর জন্য ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, তা নয়। ডিজেল বড় একটা কারণ। গত ৬ থেকে ৭ বছরে পরিবহনে নানাবিধ ব্যয় বাড়লেও ভাড়া বাড়ানো হয়নি। সড়ক পরিবহন মালিকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সব বিষয় বিশ্লেষণ করেই ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে খরচ কিন্তু সিএনজিচালিত গাড়িরও বেড়েছে। তাদের শুধু সিএনজির দাম বাড়েনি, বাকি সব খরচই বেড়েছে।
বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) সরোয়ার আলম বলেন, যাত্রীদের কাছ থেকে যে পরিমাণ অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে তা ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাড়তি আদায়ের বিষয়ে প্রয়োজনে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হচ্ছে। নির্ধারিত ‘ওয়ে বিলের’ নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় চলবে না। অভিযান চলমান রয়েছে পরবর্তীতে মামলা কিংবা জরিমানার সবশেষ বিষয়টি জানানো সম্ভব হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন