শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

‘তওবাকারীকে আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন’

সৈয়দ আহমাদ উল্লাহ কামালী | প্রকাশের সময় : ১১ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

পৃথিবীতে আমরা কেউ এমন নই যে, গুনাহ, কিংবা ভুলের উর্ধ্বে। আমরা সকলেই পাপী একমাত্র নবী ও রাসুলগণ ব্যতিত সকল মানব জাতী-ই গুনাহগার। হাদীস শরীফে রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, প্রত্যেক আদম সন্তান-ই পাপী, আর পাপীদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম যে (আল্লাহর নিকট নিজ পাপের জন্য) তওবা করে। মিশকাত শরীফ। মূলত তওবা হচ্ছে-বান্দাহ তার কৃত গুনাহের জন্য মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা চেয়ে সেই গুনাহ থেকে ফিরে আসা। অর্থাৎ গুনাহ থেকে এমন ভাবে ফিরে আসা যে, ভবিষ্যতে আর সেই গুনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প করার নামই তওবা। রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা বান্দার তওবা কবুল করে থাকেন। মিশকাত শরীফ।

তওবার পরিচয়: তওবা আরবী শব্দ। এর অর্থ ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা। মানুষ শয়তানের কুমন্ত্রণায় আল্লাহর পথ থেকে বিপথে চলে গেলে তার জন্য পূণরায় আল্লাহর দিকে ফিরে আসার সুযোগ রয়েছে। সেই সুযোগের নাম-ই হলো তওবা। অর্থাৎ মহান আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতা থেকে তাঁর আনুগত্যে ফিরে আসার নাম-ই হলো তওবা। তওবা কুফর ও শিরক এর জন্যও হতে পারে আবার কবীরা গুনাহ ও সগীরা গুনাহ এর জন্যও তাওবা হতে পারে।

০১। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর, খাঁটি তওবা। আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত হতে থাকবে। সূরা তাহরিম, আয়াত-৮। উক্ত আয়াতে তওবাতুন নাসুহা বলতে খাটি তওবার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ- গুনাহ থেকে এমনভাবে ফিরে আসা যেন আর কখনো সেদিকে ফিরে না যায়। যেমনিভাবে দুধ দোহন করার পর তা আর ফিরিয়ে দেয়া যায় না। [বান্দাহ তার গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ বিরত হয়ে তার জন্য লজ্জিত হয়ে ভবিষ্যতে আর গুনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প করে যে তওবা করা হয় তাকেই তওবাতান নাসূহা বা সত্যিকারের তওবা অথবা খাঁটি তওবা বলা হয়]। [তওবাকারী তওবা করার পর বান্দা এমন অবস্থায় পৌঁছে যায়, যেন সে কোন গুনাহ-ই করেনি অর্থাৎ সত্যিকার অর্থে তওবাকারী নিষ্পাপ হয়ে যায়]। যেমন, রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, গুনাহ থেকে তওবাকারী সেই ব্যক্তির মতন, যার কোন গুনাহ-ই নেই। সুনান ইবনু মাজাহ। রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, আর যে তওবা করে, আল্লাহ তায়ালা তার তওবা গ্রহণ করেন। বুখারী ও মুসলিম।

রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা রাতের বেলা নিজ হাত প্রসারিত করেন, যেন দিনে পাপকারী (রাতে) তওবা করে। এবং দিনের বেলা তাঁর হাত প্রসারিত করেন, যেন রাতে পাপকারী (দিনে) তওবা করে। যে পর্যন্ত পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় না হবে, সে পর্যন্ত এই রীতি চালু থাকবে। মুসলিম শরীফ। অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত তওবার দরজা খোলা থাকবে।

বান্দার তওবা দ্বারা আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত খুশী হন। কোন বান্দাহ গুনাহ করার পর যখন তওবা করে তখন আল্লাহ তায়ালা কতটা আনন্দিত হন তার উদাহরণ দিয়ে রাসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা নিজ বান্দার তওবা করার জন্য ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বেশী আনন্দিত হন, যে তার উট মরুভূমিতে হারিয়ে ফেলার পর পুনরায় ফিরে পায়। বুখারী ও মুসলিম।

সহীহ মুসলিম-এর অন্য বর্ণনায় এভাবে এসেছে যে, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দার তওবায় যখন সে তওবা করে তোমাদের সেই ব্যক্তির চেয়ে বেশী খুশি হন, যে তার বাহন (উট)-এর উপর চড়ে কোন মরুভূমি বা জন-মানবহীন প্রান্তর অতিক্রমকালে বাহনটি তার নিকট থেকে পালিয়ে যায়। আর খাদ্য ও পানীয় সব ওর বাহনের পিঠের উপর থাকে। বহু খোঁজাখুঁজির পর নিরাশ হয়ে সে একটি গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ে। হটাৎ বাহনটি (উটটি) হঠাৎ তার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। সে তার লাগাম ধরে খুশির আতিসয্যে বলে ওঠে, হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা, আর আমি তোমার রব! সীমাহীন খুশির কারণে সে ভুল করে ফেলে। মুসলিম শরীফ। প্রশ্ন হতে পারে যে, সকল পাপ-ই ক্ষমার যোগ্য কিনা? হ্যাঁ সকল পাপ-ই ক্ষমার যোগ্য। মহান আল্লাহ তায়ালা চাইলে সকল গুনাহ-ই মাফ করতে পারেন।

০২। কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা’র সাথে শিরক বা অংশি স্থাপন করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য সকল অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। সূরা নিসা, আয়াত-১১৬। শিরক ছাড়া অন্যান্য সকল কবীরা গুনাহগুলো মাফ পেতে সাধারণত তওবা করার দরকার হয়। কিন্তু সগীরা গুনাহ মাফের জন্য সবসময় তওবার প্রয়োজন হয় না।

০৩। কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, (হযরত নূহ (আ:) তার জাতিকে বলেছিলেন), আর আমি বলেছি, তোমরা তোমাদের রব-এর কাছে ক্ষমা চাও, নিশ্চয় তিনি অতীব ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, আর তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের জন্য বাগ-বাগিচা দেবেন আর দেবেন নদী-নালা। সূরা নূহ, আয়াত-১০-১২। প্রখ্যাত ফকীহ তাবিঈ বাকরা ইবনে আবদুল্লাহ আল মুযানী একদিন হেটে যাওয়ার পথে দেখলেন, তাঁর সামনে এক কাঠুরে আল হামদুলিল্লাহ ও আসতাগফিরুল্লাহ বলতে বলতে পথ চলছিল। তিনি তাকে বললেন, তুমি কি এ ছাড়া অন্য কিছু জান না? কাঠুরে বলল, অবশ্যই জানি। আমি কুরআনের হাফিয এবং অনেক দুআ-জিকিরও জানি। কিন্তু মানুষ সর্বদা পাপে নিমজ্জিত ও নিয়ামতে ডুবে থাকে। তাই আমি পাপ থেকে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তাঁর দেয়া নিয়ামতের জন্য প্রশংসা আদায় করি। এ কথা শুনে বাকরা আল মুযানী বললেন, বাকরা হল অজ্ঞ, আর কাঠুরে হল বিজ্ঞ।

০৪। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- হে নবী! আপনি বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছো তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। সূরা যুমার, আয়াত-৫৩।

যেমন এ ব্যাপারে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। বনী ইসরাঈলের এক জন লোক একশো জন লোককে হত্যা করেছিল। তারপর সেই হত্যাকারী ব্যক্তি মহান আল্লাহর দরবারে খাঁটি তওবা করেছিল। যার কারণে আল্লাহ তায়ালা তার মতো এত বড় পাপীকেও ক্ষমা করে দিয়েছেন। যেমন বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে- হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) থেকে বর্ণিত। নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তোমাদের পূর্বে (বনী ইসরাইলের যুগে) এক ব্যক্তি ছিল যে ৯৯ জন মানুষকে হত্যা করেছিল। অত:পর সেই ব্যক্তি লোকেদেরকে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জ্ঞানী ব্যক্তি কে? এ সম্পর্কে জানতে চাইলো। তখন তাকে লোকেরা একজন জ্ঞানী ব্যক্তির সন্ধান দিল। সে তার কাছে এসে বলল যে, সে ৯৯ জন মানুষকে হত্যা করেছে। এখন কি তার তওবার কোন সুযোগ আছে কিনা? জ্ঞানী লোকটি বলল, না, এতবড় পাপীর কোন তওবা নেই। সুতরাং সে ব্যক্তি (রাগান্বিত হয়ে) তাকেও হত্যা করে একশো পূরণ করল। পুনরায় সে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জ্ঞানী ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে লাগল। এবার তাকে এক জ্ঞানীর খোঁজ দেয়া হল। সে তার নিকট এসে বলল যে, সে একশো মানুষ খুন করেছে। সুতরাং তার কি তওবার কোন সুযোগ আছে কিনা? সে বলল, হ্যাঁ! আছে। তার ও তওবার মধ্যে কে বাধা সৃষ্টি করবে? তুমি অমুক স্থানে চলে যাও। সেখানে কিছু এমন লোক আছে যারা আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করে। তুমিও তাদের সাথে আল্লাহর ইবাদত কর। আর তোমার নিজ আবাসস্থলে আর ফিরে যেও না। কারণ সে স্থানটি পাপের স্থান।

অত:পর সে ব্যক্তি ঐ স্থানের দিকে যেতে আরম্ভ করল। যখন সে মধ্য রাস্তায় পৌঁছল, তখন তার মৃত্যু এসে গেল। (তার রূহ নেওয়ার জন্য) রহমত ও আযাবের ফেরেশতা উপস্থিত হলেন। ফেরেশতাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক আরম্ভ হল। (চলবে)

লেখক: বর্তমান কর্মরত-স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন