আফ্রো-এশিয়ার অবিসম্বাদিত নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৭৬ সালের এইদিনে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দিবসটি পালনে দেশের ডান-বাম-মধ্যপস্থিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন নানান কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। টাঙ্গাইলের সন্তোষে মরহুমের কবরে ফাতেহা পাঠ, মিলাদ মাহফিল ও ঢাকায় আলোচনার সভার আয়োজন করা হবে। রাজধানী ঢাকা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মজলুম জননেতা ভাসানীর ভক্ত, অনুরারিরা টাঙ্গাইলের সন্তোষের মাজারে শ্রদ্ধা জানাবেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাগপা, ন্যাপ, গণদলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এ ছাড়াও মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সকালে মরহুমের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও জিয়ারতের মধ্যদিয়ে কর্মসূচির সুচনা করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং ক্যাম্পাসে অবস্থিত শাহ্ নাসিরউদ্দিন বোগদাদী এতিমখানায় কোরআন খতম ও এতিমদের জন্য খাবার পরিবেশন এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
মওলানা ভাসানীকে বলা হয়ে থাকে আফ্রো-এশিয়ার নেতা। সারাজীবন তিনি গণমানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে নিপীড়িত-নির্যাতিতদের পক্ষ্যে কথা বলেছেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের এই প্রতিষ্ঠাতা ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামের জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাকনাম চেগা মিয়া। মাত্র ৫ বছর বয়সে মক্তবে ওস্তাদের কাছে তার পড়ালেখায় হাতেখড়ি। ৬ বছর বয়সে পিতৃহীন হন এবং ১২ বছর বয়সে মাকে হারান। ভাসানী ওস্তাদের কাছে মক্তবের পাঠ সমাপ্ত করেন এবং নিজ প্রচেষ্টায় উর্দু, ফার্সি, হিন্দি, অসমিয়া, আরবি ও ইংরেজি ভাষা শেখেন।
ময়মনসিংহের পীর সৈয়দ নাসিরউদ্দিন বোগদাদীর সংস্পর্শে তিনি দীর্ঘদিন ছিলেন। পরবর্তীতে আসান গমন করেন এবং ১৯০৮ সালে আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি হন। ১৯১৫ সালে তিনি আসাম আঞ্জুমান ওলামার সভাপতি এবং ১৯১৬ সালে আসাম কংগ্রেসের সভাপতি হন। তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মাওলানা আজাদ সুবহানী ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে রাজনীতি করেন। ২৪ বছর বয়সের তরুণ মওলানা আসামে বাস্তুহারা বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রিয় হয়ে উঠেন। ব্রিটিশ সরকার ঘোষিত কুখ্যাত ‘লাইন প্রথার’ বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৩১ সালের এই সময়ে তিনি ব্রহ্মপুত্রের ভাসানচরে বসবাস করতেন। অসামান্য নেতৃত্বে মুগ্ধ হয়ে জনগণ তাকে ‘ভাসানী’ উপাধি দেন।
মওলানা ভাসানী ১৯৩৭ সালে বন্যাপ্লাবিত টাঙ্গাইলে আসেন। আস্তানা স্থাপন করেন কাগমারীতে। তার আসামের ১৩ বছরের জীবনে ৮ বছরই কারাগারে কেটেছে। বাঙালিদের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি আসাম আইনসভার সদস্য ছিলেন ১১ বছর। ১৯৪৬ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে টাঙ্গাইল মহকুমায় মওলানা ভাসানী নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পক্ষে যে গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তার ফলে মুসলিম লীগের পক্ষে বিপুল ভোট পড়ে। ১৯৪৮ সালে আসামের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন।
আপসহীন সংগ্রামী নেতা ভাসানী রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা সফরে এলে মওলানা ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হলে তিনি দলের সভাপতি হন। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি কেটে দেয়া এবং সম্রাজ্যবাদের পক্ষ্যে বিপক্ষ্যে অবস্থান নেয় নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার মতবিরোধ ঘটে। তিনি দল ত্যাগ করে কৃষক সমিতি গঠন করেন। ১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সংগ্রামের ডাক দেন। তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠন করেন। মওলানা ভাসানী ১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৮ সালের আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মওলানা ভাসানী ভারতে চলে যান এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টামন্ডলীর সভাপতি হন। ১৯৭২ সালের ২ এপ্রিল ঢাকায় পল্টনের জনসভায় চোরাচালানের বিরুদ্ধে এবং ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের প্রতিবাদে অনশন ধর্মঘট করেন। ১৯৭৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি একতরফাভাবে ভারতের প্রত্যাহার এবং ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে সে বছর ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিলের নেতৃত্ব দেন। ###
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন