দেশে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক প্রবাসী আয়। যার সিংহভাগই আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। কিন্তু গত চার মাস ধরে আরব দেশগুলো থেকে ধারাবাহিকভাবে কমছে প্রবাসীদের এ আয়। তবে এ অবস্থার মধ্যেও বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স আহরণ বেড়েছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ৭০৫ কোটি ৫২ লাখ (৭ দশমিক ০৫ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এরমধ্যে ৫৪ দশমিক ৪২ শতাংশ বা ৩৮৩ কোটি ৮৮ লাখ ডলার এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। আমেরিকা ইউরোপসহ অন্যান্য দেশ থেকে এসেছে ৩২১ কোটি ৬৩ লাখ ডলার বা ৪৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এক কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আহরণে বেশি ভূমিকা পালন করছেন মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা ও ইউরোপে থাকা প্রবাসীরা।
বাংলাদেশের প্রবাসীদের বড় শ্রম বাজার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর সময়ে ধারাবাহিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে প্রবাসী আয় কমছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ১০৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলার, আগস্টে ১০১ কোটি ২২ লাখ ডলার, সেপ্টেম্বরে ৯১ কোটি ৭০ লাখ ডলার এবং সর্বশেষ অক্টোবরে এসেছে ৮৬ কোটি ২১ লাখ ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, রেমিট্যান্সের সিংহভাগ আসছে শীর্ষ ১০ দেশ থেকে। দেশগুলো হলো- বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সউদী আরব, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কুয়েত, আরব আমিরাত, কাতার, মালয়েশিয়া, ওমান, ইতালি ও বাহরাইন।
একক দেশে হিসেবে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সউদী আরবে। বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ২২ লাখের মত বাংলাদেশি অভিবাসী সউদীতে কর্মরত আছেন। তথ্য বলছে, গত চার মাসে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে দেশটি থেকে। দেশটি থেকে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১৭০ কোটি ডলার। যা মোট আহরিত রেমিট্যান্সের ২৪ শতাংশ। তবে চলতি অর্থবছরে এই দেশ থেকেও ধারাবাহিক রেমিট্যান্স কমছে। সউদী থেকে জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ৪৬ কোটি ডলার, আগস্টে ৪৩ কোটি ডলার, সেপ্টেম্বরে ৪০ কোটি ডলার এবং সর্বশেষ অক্টোবরে এসেছে ৩৯ কোটি ডলার।
এদিকে আগের বছরগুলোতে সবসময় রেমিট্যান্স পাঠানোর দিক থেকে সউদী আরবের পরই দ্বিতীয় অবস্থানে থাকত সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই)। তবে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে গেল অর্থবছরে আমিরাতকে ডিঙ্গিয়ে দ্বিতীয়তে আসে যুক্তরাষ্ট্র। এ অবস্থান চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ধরে রেখেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহামারির বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর অবৈধ চ্যানেলগুলোতে অর্থাৎ হুন্ডিতে অর্থ লেনদেনের বেড়েছে। এছাড়া মহামারিতে যে হারে প্রবাসীরা চাকরি হারিয়েছে সেই ভাবে নতুন বৈদেশিক নিয়োগ হয়নি। এসব কারণে প্রবাসীদের আয় কমছে। অন্যদিকে আগের তুলনায় এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে টাকা পাঠানো সহজ হয়েছে। এছাড়া বৈধ পথে প্রণোদনা পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি মহামারিতে দেশে স্বজনদের কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রবাসীরা আগের তুলনায় বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন। এছাড়া ব্যাংকিং চ্যানেলে বেশি অর্থ আসছে।
চলতি অর্থবছরে চার মাসে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা মোট ১১৫ কোটি ২১ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন, সেখানে আমিরাত প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন মাত্র ৫৬ কোটি ৮৮ ডলার। আমিরাতের প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় যুক্তরাজ্যের চেয়েও নিচে নেমে গেছে। জুলাই-অক্টোবর সময়ে যুক্তরাজ্য থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৯ কোটি ৫৩ লাখ ডলার।
আলোচিত সময়ে কুয়েতে থাকা বাংলাদেশি প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ৫৭ কোটি ৩২ লাখ ডলার, কাতার থেকে এসেছে ৪৬ কোটি ৩২ লাখ ডলার, মালয়েশিয়া ৩৭ কোটি ২০ লাখ ডলার, ওমান ৩৫ কোটি ৬৫ লাখ, ইতালি থেকে ৩৪ কোটি ২০ লাখ ডলার এবং বাহরাইন থেকে এসেছে ১৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গেল অক্টোবর মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১৬৪ কোটি ৬৮ লাখ ডলার (১ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এ অঙ্ক আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ৪৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার বা ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ কম। ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল ২১০ কোটি ২১ লাখ ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসে। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। এর আগে কোনো অর্থবছরে এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি বাংলাদেশে। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৮২০ কোটি ডলার বা ১৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। অর্থবছর হিসাবে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ। তারও আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আহরণের রেকর্ড হয়। ওই সময় এক হাজার ৬৪২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসে দেশে।
২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে আরও ২ টাকা যোগ করে মোট ১০২ টাকা পাচ্ছেন সুবিধাভোগী।##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন