দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম আকাশছোঁয়া। পেঁয়াজ, মরিচ, ভোজ্য তেলের দামের সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সকল অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। তেমন বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই কিছুদিন পরপর সকল জিনিসের দামের এমন ঊর্ধ্বগতি প্রায়ই দেখা যায়। বিশ্বের অনেক দেশে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মাঝেমধ্যে ঘটে যাওয়া নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার খবর চোখে পড়ে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারো সবকিছু পূর্বের জায়গায় চলে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো কারণ ছাড়াই নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিতিশীলতা লক্ষ্য করা যায় এবং সেটা একরকম স্থায়ী রূপেই রয়ে যায়। বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ব্যতীত নিন্মগতির কোনো খবর আমাদের দেশে।
বাজারের উপর সরকারের তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ইস্যু, যেমন বাজেট, হরতাল, ঈদ, পূজা, প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সামনে রেখে ইচ্ছামত নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায়। একদিকে, ব্যবসায়ী মহল সবসময় সরবরাহে ঘাটতি ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কথা বলে, অপরদিকে দেশের একদল অসাধু ব্যবসায়ী নিজেদের সুবিধামত বিপুল পরিমান পণ্য গুদামজাত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। ব্যবসায়ী মহলের মধ্যে সিন্ডিকেট গঠন করে ইচ্ছামত পণ্যের মূল্য হাঁকিয়ে বসে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির অজুহাত ও ব্যবসায়ীদের আচরণ একটা কমন রীতিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের কথার কোন সত্যতা যাচাই না করে তাদের মনগড়া আরোপিত বর্ধিত মূল্যই বাজারে থেকে যায়। একরকম ইচ্ছামত নিত্যপণ্যের উপর আরোপিত বর্ধিত মূল্যের জন্য যেসব দাবি করা হয় সেগুলো ভিত্তিহীন। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বর্ধিত মূল্য আদৌ যুক্তিযুক্ত কিনা সেটা যাচাই করার মতো কোন মনিটরিং টিম কখনো দেখা যায় না। এহেন পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগী ক্রেতারা ব্যবসায়ীদের কাছে একরকম জিম্মি। কিভাবে জিম্মি তার একটি ছোট্ট উদাহরণ তুলে ধরলাম। মানুষের নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় ডিম একটি খাবার। সেটিও দিন দিন মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। সম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার অন্যতম বৃহৎ ডিম সমিতি ‘তেজগাঁও ডিম সমিতি’র এক সদস্য বলেছেন তারা নাকি প্রতিদিন সকালে সেদিনের ডিমের দাম নির্ধারণ করেন। ওই সদস্য বলেন, সারা বাংলাদেশের পাইকারি পর্যায়ে মোবাইলে এসএমএস দিয়ে সেদিনের মানুষের চাহিদা দেখে ডিমের দাম জানিয়ে দেন। বাজারে চাহিদা বাড়লে দাম বেশি আবার চাহিদা কমলে দাম একটু কমে।
ডিম সমিতির ওই সদস্য’র কথা শুনে মনে হয়েছে দেশের ডিম খাওয়া মানুষ তাদের হাতে বন্দি। তারা ইচ্ছামত দাম নির্ধারণ করবেন আর ভুক্তভোগী ক্রেতারা একরকম নিরুপায় হয়ে সেটা ক্রয় করবেন। এখানে উদাহরণটা ডিম সমতির সদস্য’র কথা উল্লেখ করলেও সকল ক্ষেত্রে একই চিত্র লক্ষ্য করা যায়। কেননা, আমাদের দেশে এধরনের এত সমিতি বা সংগঠন আছে যে, তা হাতে গুনে শেষ করা যাবেনা। আমার কাছে মনে হয়েছে, দেশের সকল বাজারে এই ব্যবসায়িক সমিতির নামে যেসকল সমিতি আছে তারাই বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। তারাই সিন্ডিকেট করে বাজারে জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয়। এ সকল সমিতির কার্যকলাপ যদি মানুষের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে এসকল সমিতি বা সংগঠন বিলুপ্ত করাটাই শ্রেয়।
কৃত্রিম সংকট আর এক উদ্ভট জিনিস। বিগত দিনের মহামারি গুলো এমনই ইঙ্গিত বহন করে যে, খ্যাদ্যের অভাবে বিশ্বে কখনো খাবারের দাম বাড়েনি। কখনো নিত্যপণ্যের বাজারে সংকট লাগেনি। সংকট লাগে অসৎ ও অসাধু ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের পণ্য মজুদের কারণে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে আমরা দেখেছি পৃথিবীজুড়ে মানুষ একদিকে খাবারের অভাবে দুর্ভিক্ষ লেগে মরেছে, অন্যদিকে মজুতদার কোম্পানিগুলো তাঁদের মজুতকৃত পণ্য সমুদ্রে নিক্ষেপ করেছে। ৪৩ ও ৭৪ এর সংকটময় পরিস্থিতিতেও আমরা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি খেয়াল করেছি। ঠিক একই ঘটনার দেখা গেছে, করোনা পূর্ববর্তী সময়ে বাজারে লবনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়। কোনরকম কানাঘুষা শোনাগেলেই ব্যবসায়ীমহল নড়েচড়ে বসে। সিন্ডিকেট করে সজাগ থাকে কিভাবে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা যায়। মাঝে মধ্যেই খেয়াল করি, পেঁয়াজের বাজারেও একই কারণে অস্থিরতা তৈরি করা হয়। শুধুমাত্র কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে অরাজকতা সৃষ্টির এই ইতিহাস নতুন কিছু নয়। অথচ কৃষিপ্রধান আমাদের দেশে এরকম কৃত্রিম সংকট অনেক বেশী বেমানান। সাধারণ মানুষের এসব অহেতুক হয়রানি রোধ করার জন্য প্রশাসনের তেমন কোন তৎপরতা চোখে পড়ে না।
একদিকে মহামারী করোনা অপরদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দিনমজুর থেকে মধ্যবিত্তের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে করোনা মহামারিতে প্রায় ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমেছে, যেটি আগের হিসেবের সাথে যোগ হয়ে দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ কোটির বেশি। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে অর্থাৎ করোনার যখন পিক টাইম চলছিল তখন এক বছরে দেশে এক কোটি টাকার বেশি আছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার বেড়েছে।
পরস্পর বিপরীতমুখী দুই সূচকের এই বৃদ্ধির হিসাব এমনটা ইঙ্গিত বহন করে যে, মহামারী অধিকাংশ মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে এলেও কিছু মানুষের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ আবির্ভূত হয়েছে, যার কারণে মহামারী চলাকালীন সময়েও কিছু মানুষ নতুন করে ধনী হয়েছে, যদিও এই ধনী হওয়া মানুষের সংখ্যা থেকে গরিব হওয়া মানুষের সংখ্যা ঢের বেশি। করোনার সময়ে এই ধনী বনে যাওয়া মানুষদের অধিকাংশই দেশের বড় বড় বিজনেস ম্যান থেকে শুরু করে নানান পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গই হবেন, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারীর ভিতরেও কিছু মানুষের ধনী হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকলেও আমার কাছে উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে মানুষের ভোগবিলাসতা ও দেশ-বিদেশে ভ্রমণ বন্ধ থাকা, যার কারণে কোটি টাকার হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়েছে। বাজারে নিত্য পণ্যের দাম বাড়লে এসব মানুষের উপর কোন প্রভাব পড়েনা। যেখানে কোটি টাকার বিষয় জড়িত সেখানে তাদের কাছে ১০০-২০০ টাকা কোন বিষয়ই না। কিন্তু দেশে যে ৫ কোটির বেশী দরিদ্র মানুষ আছে তাদের কাছে এই ১০০-২০০ টাকার বিষয়টি অনেক উদ্বেগের। সেইসাথে দেশের অন্যান্য সকল পেশাজীবীর জন্য অনেক বড় উদ্বেগের বিষয়। কেননা প্রতিমাসে নির্ধারিত আয়ের সাথে যদি বাড়তি ব্যয় একের পর এক যোগ হতে থাকে তাহলে তাদের মাস চালাতে হিমশিম খেতে হয়। আর দিনমজুর বা খেঁটে খাওয়া মানুষদের ক্ষেত্রে তো মরার উপর খাঁড়ার ঘা।
পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় ধনীরা দিন দিন ধনী হবে এবং গরীবেরা আরও গরিব হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোন মানুষ যেন অনাহারে না থাকে সেদিকে অবশ্যই দেশের নীতি নির্ধারকদের সজাগ দৃষ্টি দেওয়া উচিৎ। সকল বিষয়াদি চিন্তা করে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারকে প্রয়োজনে অনেক বেশি কঠোর হতে হবে। অতিলোভী অসাধু আড়ৎদার ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। মজুতদারদের মজুতদারি শক্ত হাতে দমন করতে হবে। প্রতিটি বাজারে নিত্যপ্রয়জনীয় জিনিসপত্রের মূল্য তালিকা টাঙানোর ব্যাপারে মালিক সমিতি বা বনিক সমিতির প্রতি কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। মূল্য তালিকায় নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে কি না, সেটি পর্যবেক্ষণের জন্য সকল বাজারে দ্রব্যমূল্য মনিটরিং কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিতভাবে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে বাজার মনিটরিং করতে হবে।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), বাংলাদেশের একটি রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক সংস্থা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আপদকালীন মজুদ গড়ে তুলে প্রয়োজনীয় সময়ে ভোক্তা সাধারণের নিকট সরবরাহ করার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক ভুমিকা রাখতে টিসিবি’র যাত্রা। কিন্তু, টিসিবির মাধ্যমে গরিব মানুষের জন্য যে খাদ্যপণ্য বিক্রি করা হয়, তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল, যার কারণে কতিপয় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার মূল্য স্থিতিশীল রাখতে প্রতিষ্ঠানটি হিমশিম খায়। এই টিসিবি পণ্যের সহজলভ্যতা এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সহজলভ্যতা ও সরবরাহ নিশ্চিত করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
আমাদের দেশের কৃষকদের কখনো নায্যমূল্য দেওয়া হয়না। তারা সর্বক্ষেত্রেই শোষিত ও নিপীড়িত। অথচ, কৃষকরাই আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। একদিকে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য অন্যদিকে মালিকপক্ষের বিভিন্ন সিন্ডিকেট, সবসময় কৃষকদের নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে আসছে। কৃষি প্রধান দেশে খাদ্যের সংকটে কেন পড়তে হবে? কেন অন্য দেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে হবে? ভরা মৌসুমে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের মজুদের অভাবে নামে মাত্র মূল্যে বিক্রি করে। অন্য সময়ে আবার সেই একই পণ্য বিদেশ থেকে বাড়তি দামে আমদানির জন্য তীর্থের কাকের মত চেয়ে থাকতে হয়। বিদেশীদের কাছে ধরনা দিয়ে বসে থাকার চেয়ে কৃষকদের পণ্য নায্যমূল্যে কিনে সংরক্ষণ করলে একদিকে যেমন কৃষকরা বেঁচে যাবে, অন্যদিকে নিজেরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। কৃষকদের বাঁচিয়ে তাদের নায্য পাওনা দিলে যেমন, খাদ্যে জোগান আসবে, আবার ঠিক তেমনি অর্থনৈতিক সংকটজনিত সামঞ্জস্যহীনতা দূর হবে।
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে দেশের মানুষ দিনের পর দিন সরকারের প্রতি বিরাগ ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে ঘুষ, কালোবাজারি, দুর্নীতি। সমাজের ভিতরে মানুষে মানুষে বাড়বে হানাহানি। বর্তমানে অধিকাংশ মানুষের ভিতরে অসৎ উপায়ে ও স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার প্রবণতা অধিক হারে দেখা যাচ্ছে। আর এই ধনী হওয়ার খেলায় মেতেছে অনেকেই, যার ফলে সমাজে দেখা দিচ্ছে নানান অসংগতি। বৃদ্ধি পাচ্ছে ধনী গরিবের মধ্যে বিস্তর ফারাক। এ ফারাকের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ভবিষ্যৎ আরও খারাপের দিকে যাবে।
লেখক: গবেষক, ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি,ফুজো, ফুজিয়ান, চীন।
ajoymondal325@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন