মুহাম্মদ আলতাফ হোসেন খান
আত্মশুদ্ধি ও সংযমের মাস পবিত্র মাহে রমজান। বিশ্ব মুসলিম আত্মার পরিশুদ্ধিতে আত্মনিয়োগ করে এ পবিত্র মাসে। মাহে রমজান বিশ্বমানবতার কল্যাণে এক বিশাল নিয়ামত। তাইতো বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসের আগমনের পূর্বে রজবের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে এ দোয়া পড়তেন, ‘হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাসকে বরকত দ্বারা পরিপূর্ণ করো এবং রমজান পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দাও।’
মহিমান্বিত এ মাস পাওয়ার জন্য বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায় উদগ্রীব থাকেন। গোটা মানবতা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে যারপরনাই আত্মনিমগ্ন থাকে এবং যাবতীয় অকল্যাণ দূরীভূত করে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের অনুপম আদর্শ প্রতিষ্ঠায় কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে জীবনযাপন করার জন্য এ মাসেই আকুতি পেশ করে থাকে। বিশ্ব মুসলিমের মতো আমাদের দেশেও সে উপলব্ধি থেকেই পবিত্র মাহে রমজানকে স্বাগত জানায় এবং আলাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য নিজেদের সঁপে দেয় কোরআন নির্দেশিত হেদায়েত লাভে। সেই পবিত্র মাসকেই উদযাপনের জন্য দেশের সরকারসহ সব জনগণ বা ঈমানদার মুসলমানের দৃষ্টি থাকে পবিত্র রমজানের পরিবেশ নিয়ে এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনে ঘটনা প্রবাহ নিয়ে। বিশেষ করে আমাদের পবিত্র রমজান যাতে সুষ্ঠুভাবে এবং পবিত্রতার সঙ্গে পালন করা যায়, দৈনন্দিন খাবার-দাবার ও বাজার দ্রব্যাদি সহজ লভ্যতা যাতে ক্রয় ক্ষমতার ভেতরে থাকে, সে বিষয়টি নিয়ে সবাইকে ভাবতে হয়।
এ মাসে কিছু পণ্যের ব্যবহার বেড়ে যায়। বিশেষত ছোলাবুট, মশুর ও খেসারির ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন আদাসহ বিভিন্ন মসলার ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এসবের দামও বৃদ্ধি পায়। বিশ্বের অনেক দেশে রোযা-রমযানে ভোগ্যপণ্যের মূল্য হ্রাস পেলেও আমাদের মুসলিম প্রধান এ দেশটিতে প্রায় সব রকম পণ্যের দাম বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। অনেক অমুসলিম প্রধান দেশেও মুসলমানদের সিয়াম সাধনার মাসে ভোগ্যপণ্যের দাম কিছুটা কমানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে হয় তার উল্টো। রমযান শুরুর আগেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে। শুরু হয়ে গেলে বাড়ানো হয় আরেক দফা। আবার রমযান শেষে যখন ঈদ আসে তার আগে বাড়ে আরেকবার। অর্থাৎ দফায় দফায় বাড়তে থাকে ভোগ্যপণ্যের মূল্য। এবার আমাদের দেশে আরেকটি অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে। এই ঈদের আগে আগে পাস হবে নতুন বাজেট। এ বাজেটের প্রভাবে প্রতিবছরই নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। এবারও বাড়বে নিশ্চয়ই। এর লক্ষণ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আর আমাদের দেশে কোনো জিনিসের দাম একবার বাড়লে তা আর কখনও কমে না। তবে এবার জ্বালানি তেলের দাম সামান্য কমলেও জনগণের কোনো লাভ হয়নি। সরকারের ঘোষণা মোতাবেক যানবাহনের ভাড়া সামান্য কমবার কথা হলেও তা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কমেনি। তাছাড়া জ্বালানি তেলের দাম ও ভাড়া কমানোর যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে সেটাকে প্রহসন বললেও অত্যুক্তি হয় না। এদেশের জনগণের পকেটের টাকা কীভাবে হাতিয়ে নেয়া যায় তার সবরকম ফন্দিফিকির করেই দেয়া হয় বলতে গেলে।
আমাদের দেশের বাজার ব্যবস্থা রমজানের পূর্বে যে অবস্থা বা মূল্যমান থাকে, তা যেন রমজান আসার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়, যা রোজাদারদের জন্য কষ্টকর ও নিপীড়নমূলক। বাজার ব্যবস্থার এ চিত্র কোনোভাবেই কাম্য নয়। অথচ বহির্বিশ্বে পবিত্র দিনগুলোতে ব্যবসায়ীরা দ্রব্যাদির মূল্য কমিয়ে দেয় এবং সবকিছুই সহজ লভ্যতায় সকলের উৎসব আনন্দ ভোগে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এমনকি বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে দেয়া হয় বা কমিশনে বিক্রি করা হয়। অথচ আমরা যারা ঈমানদার বলে দাবি করি, তাদের ব্যবহারিক জীবনের আমলের অবস্থা কী! রাত-দিন তফাৎ।
রমজান আসলেই দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এতে করে রোজাদার ঈমানদারদের কষ্ট ও দুর্ভোগ চরমভাবে বেড়ে যায়। নিত্য দ্রব্যগুলোর মধ্যে সাধারণত পেঁয়াজ, মরিচ, ডাল, গরম মসলা, চিনি এবং রমজানে যেসব শাকসবজি ও তরিতরকারি বেশি পরিমাণে খাওয়া হয়, সেগুলোর আকাশচুম্বী দাম বেড়ে গিয়ে সাহরি ও ইফতার করতে গিয়ে বিশেষ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। রমজানে যেসব দ্রব্যাদির বেশি প্রয়োজন সেসব দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি করে রোজাদারদের কষ্ট দেয়ার মধ্যে একশ্রেণীর নামধারী মুসলমানের যেন সুখ উপচে পড়ে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এমনও দেখা যায়, রমজানের সময় অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় মজুদদারদের বিশেষ গ্রুপ কৃত্রিম বাজার সংকট সৃষ্টি করে বাজারদরকে ঊর্ধ্বমুখী করে তুলে এবং এতে জনগণের নাভিশ্বাস ছুটে। অথচ রোজাদারদের কষ্ট দেয়ার মধ্যে কঠিন গুনাহ হয়। সে বিষয়টি উপলব্ধিতেই আসে না।
অথচ রমজান মাস হচ্ছে আত্মশুদ্ধির মাস, অশেষ কল্যাণ লাভের মাস এবং মুসলিম সমাজে এ মাসের গুরুত্ব ও প্রভাব এতই বেশি যে, বাকি ১১ মাসের জীবনযাপনের প্রভাব এ মাস থেকেই হাসিল হয় এবং এর প্রভাব ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজ জীবন, রাজনৈতিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবনসহ সর্বক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয় এবং এর পূর্ব পরিকল্পনা স্বরূপ রমজানের শুরুতেই জনগণ এবং সরকারের উদ্দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন ও সংস্থা থেকে নানা ধরনের ব্যানার-ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ডসহ বিশাল বিশাল র্যালি বের করে অভিবাদন ও সতর্ক করে দেয়া হয় এবং বিজ্ঞপ্তি আকারে থাকে ‘আহলান-সাহলান মাহে রমজান’ রমজানের পবিত্রতা বজায় রাখুন, অন্যায়, ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ রাখুন ‘পবিত্র রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং দিনের বেলা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ রাখুন’ ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রকৃত অর্থে এ মাসে মানুষের নৈতিক চরিত্রের উত্থান ঘটানো মূল লক্ষ্য। স্বভাব-চরিত্র, ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবনসহ সব বিভাগে মানুষের নৈতিক মান বৃদ্ধি করা পবিত্র মাহে রমজানের মূল শিক্ষা। আমরা যদি রমজান পেয়েও সেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হই, তবে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ বলেন, যে বান্দা আমার জন্য রোজা রাখল, আমি নিজেই তার প্রতিদান দেব’ এর চেয়ে উত্তম পাওয়া আর কী হতে পারে এবং নিশ্চয়ই সেই রোজা রাখতে হবে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই। আর বাস্তবিক অর্থে এই নিয়তে যারা রোজা রাখবে নিশ্চয় তারা কোনো বান্দাকে কষ্ট দিতে পারে না। তাই ব্যবসায়ী রোজাদাররা এ মাসের গুরুত্ব উপলব্ধি করে নিশ্চয়ই কোনো মুসলমানকে কষ্ট দিতে চাইবেন না। আর হাদিসের ভাষা অনুযায়ী আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না করে বরং কমিয়ে আনা এবং স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে প্রতিটি রোজাদারই সস্তিতে দ্রব্যমূল্য কিনতে পারবেন এবং সঠিকভাবে রোজা রাখার ক্ষেত্রে কেউই কষ্ট পাবেন না। এভাবে যদি আমরা ব্যবসায়ী বন্ধুরা রোজাদারদের পাশে দাঁড়াতে পারি, তবে নিশ্চয়ই ইহকাল এবং পরকালে প্রভূত কল্যাণ লাভ করতে পারব- ইনশাআল্লাহ।
তাই আসুন, পবিত্র রমজান মাসকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করি এবং এ মাসের মর্যাদা বজায় রেখে বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বের ঐক্য ও সংহতি স্থাপনে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ হই। অতএব, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে সব ক্ষেত্রে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নৈতিকতার উৎকর্ষতায় মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জন হোক আমাদের মূল লক্ষ্য।
ষ লেখক : প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন