বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খেলা ফিচার

অদম্য তারা

প্রকাশের সময় : ২২ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

‘প্রতিবন্ধী’ কথাটি শুনলেই বুকের ভেতরে আচমকা একটু ব্যথা অনুভব করি আমরা। যদিও এই শব্দটির ব্যবহার আমাকে ব্যথিত করছে; তারপরও শুধুমাত্র পরিচিতির প্রয়োজনেই, অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে এই কষ্টদায়ক শব্দটি ব্যবহার করতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত। তবে জানলে অবাক হবেন, পৃথিবী বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও লেখিকা হেলেন কেলার ছিলেন শ্রবণ, দৃষ্টি ও বাকপ্রতিবন্ধী। অথচ তিনি পৃথিবীকে শুনিয়েছেন মানবতার জয়গান। সুর¯্রষ্টা মোৎসার্ট ছিলেন শ্রবণ প্রতিবন্ধী। মহাকবি হোমার ছিলেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। বিখ্যাত গায়ক ও কবি সুরদাসও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিলেন। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন শৈশবে ছিলেন অটিস্টিক। বর্তমান পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংসও শারীরিক প্রতিবন্ধী। সুযোগ পেলে প্রতিবন্ধিতাকে অতিক্রম করে মানুষ কত এগিয়ে যেতে পারে তারাই তার প্রমাণ। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এগিয়ে যাবার প্রত্যয়ে বাংলাদেশও কিছুমাত্রায় পিছিয়ে নেই! শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্থাপত্যকলা, শিল্পকলা এমনকি চিকিৎসা সেবাতেও এগিয়ে যাচ্ছে পরিবারের অবহেলিত এই সদস্যটি। গর্বিত করছে পুরো পরিবারকে, পুরো সমাজকে, পুরো দেশকে! সম্প্রতি দু’টি ঘটনা আমাকে দৃষ্টি খুলে দিয়েছে, খুলে দিয়েছে জ্ঞানের দুয়ারও। স্পোর্টস রিপোর্টার হবার সুবাদে ব্লাইন্ড ক্রিকেটের সাথে আমি আগে থেকেই পরিচিত। এবার নতুন করে আবির্ভাব দেখলাম ‘হুইলচেয়ার’ ক্রিকেটারদের!

ইমরান মাহমুদ
ঘটনাচক্র এক.
ক্রিকেট দৌড়-ঝাঁপের খেলা। হাত-পা ছুড়ে, দ্রুতগতিতে শরীর নাড়িয়ে নিজের অবস্থার জানান দেয়ার নামই ক্রিকেট। তবে মতিঝিলের শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে গত মঙ্গলবার সকালের চিত্রটা ছিল একটু অন্যরকম। বাংলা একাডেমির উপ-পরিচালক ডক্টর আমিনুর রহমান সুলতান সপরিবারে এসেছেন প্রতিযোগিতামূলক এক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট দেখতে। নিজের একমাত্র সন্তান নাহিয়ান রাজধানীর ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি›র কম্পিউটার প্রকৌশলী বিভাগের শিক্ষার্থী। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় জটিল এভিএম রোগে আক্রান্ত হয় নাহিয়ান। মেরুদ-ের জমাট বাঁধা রক্ত কিশোর নাহিয়ানের পায়ে চলার শক্তি নষ্ট করে দেয়। কিন্তু তাতে ক্রিকেটের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা এতটুকু কমেনি। শারীরিক এই বাধাকে জয় করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন ঠিকই ব্যস্ত নগরীতে ক্রিকেটের ২২ গজে নাহিয়ানের সঙ্গী হয়নি কেউ।
সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা এসব অদম্য ক্রিকেট শক্তিদের এক সুতোয় গাঁথতে দিন কয়েক আগে প্রতিষ্ঠিত হয় হুইলচেয়ার ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ। যার মূল উদ্যোক্তা এদেশে ফিজিক্যাল চ্যালেঞ্জড ক্রিকেটের চেনা মুখ মোহাম্মদ মোহসিন। হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী এই ক্রিকেটারের নেতৃত্বে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ক্রিকেটারদের নিয়ে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো ‘পুরনাভা প্রথম জাতীয় হুইলচেয়ার ক্রিকেট টুর্নামেন্ট’। একই সঙ্গে আনুষ্ঠানিক এ দেশে পথচলা শুরু হলো হুইলচেয়ার ব্যবহকারীদের জন্য ক্রিকেট। পুরো আয়োজনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ইমেগো স্পোর্টস লিমিটেড।
হুইলচেয়ার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের আয়োজনে এই টুর্নামেন্টের পৃষ্ঠপোষক দেশের অন্যতম শীর্ষ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রেনেটার ব্র্যান্ড ‘পুরনাভা’। দিনব্যাপী এই টুর্নামেন্টে রাজশাহী ওয়ারিয়র্স, খুলনা সাইক্লোন, চিটাগং রাইডার্স ও ঢাকা জায়ান্টস এ চার দলে বিভক্ত হয়ে ক্রিকেটাররা অংশ নেন এই টুর্নামেন্টে। ফাইনালে চিটাগং রাইডার্সকে ৬ উইকেটে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে খুলনা সাইক্লোন। শিরোপা নিষ্পত্তির ম্যাচে টস জিতে চিটাগংকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় খুলনা। নির্ধারিত ৫ ওভারে ২ উইকেটে ৬৮ রান তুলে চিটাগং রাইডার্স। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৪২ রান করেন আবু বকর। ১ ওভার আর ৬ উইকেট হাতে রেখে লক্ষ্য টপকে যায় খুলনা সাইক্লোন। সর্বোচ্চ ২৮ করেন ইমাদুল আর ১৬ রান আসে হামিদুলের ব্যাট থেকে। ২ জনই অপরাজিত ছিলেন। রাউন্ড রবিন লিগের এই টুর্নামেন্টে ১০৭ রানের সঙ্গে ৪ উইকেট নিয়ে আসরের সেরা ক্রিকেটার হন রাজশাহী ওয়ারিয়র্সের জামাল।
শারীরিক প্রতিবন্ধী এসব ক্রিকেটারকে উৎসাহ জোগাতে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের কর্ণধার নাফিসা কামালসহ সাবেক ও বর্তমান ক্রিকেটার, ক্রিকেট সংগঠকসহ ক্রীড়া সংশ্লিষ্টরা। ফাইনাল শেষে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান রেনেটার ব্র্যান্ড পুরনাভার বিপণন বিভাগের প্রধান এইচ এস এম কামরুল আলম, উপস্থিত ছিলেন পুরনাভার সিনিয়র ডেপুটি ম্যানেজার মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান। ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ইমেগো স্পোর্টসের কো-ফাউন্ডার ও চিফ মার্কেটিং অফিসার তামজিদুল ইসলাম কানন এবং হুইলচেয়ার ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোহসিন।

ঘটনাচক্র দুই.
সাঁতারু অন্বেষণ প্রতিযোগিতা ‘সেরা সাঁতারুর খোঁজে বাংলাদেশ-২০১৬’-এর দ্বিতীয় পর্ব বাছাইয়ের গত বুধবার সকাল ৯টায় মিরপুরস্থ সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় সুইমিং কমপ্লেক্সে শুরু হয়। এর আগে সারাদেশের ৬৪ জেলায় অনুষ্ঠিত প্রাথমিক বাছাই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ১২৭৫ জন দ্বিতীয় পর্বে উন্নীত হয়। বয়সভিত্তিক চারটি ক্যাটাগরিতে ২৭৪ জন ছেলে এবং ৬৫ জন মেয়েসহ সর্বমোট ৩৩৯ জন সাঁতারু প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। এসময় বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের সভাপতি ও নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ ও সুইমিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মো: রফিজ উদ্দিন রফিজসহ নৌবাহিনীর অন্যান্য কর্মকর্তা ও বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ উপস্থিত ছিলেন ।
প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়াদের মধ্যে একটি ছেলের অংশগ্রহণ যেন হঠাৎ করেই মোহাচ্ছন্ন করল আগত সকলকে। পল্লব কুমার কর্মকার। বয়স ১১। সাঁতার প্রতিযোগিতায় নাম লেখানোর জন্য এই দু’টি বৈশিষ্ট্যই যথেষ্ট। তবে যেটি তাকে আলাদা করেছে আর হাজারো সাঁতারু থেকে তা হলো, সাঁতারের জন্য অপরিহার্য একটি পা-ই নেই তার! তবুও সেই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে, সুদূর চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় পর্বে অংশগ্রহণ করে তার বিভাগে সফলতার সাথে পরবর্তী পর্যায়ে উন্নীত হয়। শহরের শিবতলা গ্রামের বাবা কাজল কর্মকার ও মা শিউলী রানী কর্মকারের গর্ব এখন এই সন্তানটিই! পড়াশোনাতেও বেশ ভালো পল্লব। পড়ছে ফতেপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীতে।
দ্বিতীয় পর্বের বাছাইয়ে প্রতিযোগীদের শারীরিক কাঠামো, সাঁতারের স্টাইল এবং টাইমিং বিবেচনায় বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের নির্বাচন কমিটি তৃতীয় পর্বের জন্য বয়সভিত্তিক নারী ও পুরুষ মোট ১৬০ জন প্রতিযোগীকে মনোনীত করবে। তৃতীয় পর্বে মনোনীত এই ১৬০ জন প্রতিযোগীকে বিদেশী প্রশিক্ষকের মাধ্যমে ৩ মাসব্যাপী নিবিড় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। প্রশিক্ষণ শেষে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ১৬০ জন হতে সেরা ৬০ জন সাঁতারু নির্বাচন করা হবে। এই সেরা ৬০ জন সাঁতারুর প্রত্যেককে মেডেল, সার্টিফিকেট ও নগদ অর্থ পুরস্কার দেয়া হবে।
সেরা এই ৬০ জন সাঁতারু বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনে যোগ দেবেন এবং তাদের বিশ্বমানের সাঁতারু হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। প্রতিযোগিতায় বয়সভিত্তিক ৪টি ইভেন্টের চূড়ান্তভাবে বিজয়ী সেরা ৪ জন নারী এবং ৪ জন পুরুষ সাঁতারুকে ৫ লাখ করে টাকা প্রদান করা হবে। উল্লেখ্য, সেরা এই সাঁতারুদের লেখাপড়ার ব্যবস্থাসহ যাবতীয় ব্যয়ভার সুইমিং ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বহন করা হবে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রতিভাবান সাঁতারুদের তুলে আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশন ও নৌবাহিনীর যৌথ উদ্যোগে এ সাঁতারু অন্বেষণ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। পাঁচ মাসব্যাপী এর প্রাথমিক বাছাই কার্যক্রমে সারাদেশের ৬৪টি জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রতিভাবান সাঁতারুরা অংশগ্রহণ করে। তাদেরই এক বিস্ময় আবিষ্কার এই ‘এক পেয়ে সাঁতারু’ পল্লব। স্যালুট তোমাদের।
পরিশেষে
সমাজের এই অবহেলিত সদস্যদের কল্যাণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও প্রয়োজনের তুলনায় সেটি অপ্রতুল। দেশের প্রতিটি ভবন, রেলস্টেশন, বন্দর, বিমানবন্দর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধীদের চলাফেলার উপযোগী সুব্যবস্থাও অপর্যাপ্ত। আর গর্ভকালীন অপুষ্টি, অবহেলা ও অপচিকিৎসায় যেন কোনো শিশু প্রতিবন্ধী হয়ে না জন্মায়, সেদিকেও নজর দেয়া প্রয়োজন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুযোগ দিতে হবে বিকাশের। তাদেরও রয়েছে সুন্দরভাবের জীবনযাপনের অধিকার আছে। এই অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্রের তেমনি সমাজের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের। চলুন আমি, আপনি ও সকলে মিলে তাদের পাশে দাঁড়াই, তাদেরকে অনুপ্রেরণা যোগাই, তাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নেই।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন