করোনা মহামারীর দ্বিতীয় বার্ষিকী ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে, এর আরেকটি ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের আবির্ভাব বিশ্ব বাজারে এই আশঙ্কার ঢেউ তুলেছে, যে এর উচ্চ সংক্রমণযোগ্য স্ট্রেন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে পিছিয়ে দিতে পারে এবং বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও বিপর্যয়ে ঠেলে দিকে পারে। ওমিক্রন যদি নিয়ন্ত্রণযোগ্য প্রমাণিত হয়ও, ২০২২ সম্ভবত অর্থনৈতিকভাবে একটি টানাপোড়েনের সাল হবে। কারণ বিশ্বের দেশগুলি করোনা জনিত কঠোর মার্কিন মুদ্রানীতি এবং চীনের মন্থর প্রবৃদ্ধিতে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হবে।
আমেরিকা এবং চীন বিশ্বব্যাপী জিডিপির ৪০ শতাংশের নিয়ন্ত্রক। এই দুটি দেশের অর্থনীতি অন্যান্য অর্থনীতিকে বিভিন্ন উপায়ে প্রভাবিত করে। কঠোর আমেরিকান মুদ্রানীতি প্রায়শই বিশ্বব্যাপী ঝুঁকির সাথে যুক্ত, যা উদীয়মান বাজারে পুঁজির প্রবাহ কমিয়ে দেয় এবং বাণিজ্য প্রবাহ হ্রাস করে। বিশ্ব বাজারে চীনের প্রভাব আরও স্পষ্ট। দেশটি অন্যান্য পণ্যগুলির মধ্যে অ্যালুমিনিয়াম, কয়লা, তুলা এবং সয়াবিনের বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তা এবং মূলধনী সরঞ্জাম থেকে ওয়াইন পর্যন্ত পণ্যগুলির একটি প্রধান আমদানিকারক। সেকারণে, বানিজ্যে চীনের ধীর গতি সারা বিশ্বের রপ্তানিকারকদের জন্য একটি বিশাল আঘাত। চীন ব্যতীত উদীয়মান বিশ^ বাজারের প্রবৃদ্ধি ২০১১ সালের ৫.৩ শতাংশ থেকে ২০১৫ সালে মাত্র ৩.২ শতাংশে নেমে এসেছে। ওমিক্রনের কারণে এবারের মন্দা আরও বেদনাদায়ক হতে পারে। যদিও আইএমএফ এখনও বলছে যে, ২০২২ সালে চীনের প্রবৃদ্ধি ৫.৬ শতাংশ বাড়বে, তারপরেও ২০২০ সাল বাদ দিয়ে ১৯৯০ সালের পর থেকে তা সর্বনিম্ন হার হবে।
কোভিড-১৯-এর ক্রমাগত বিস্তার সরকারগুলিকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কড়াকড়ির অতীত পর্বগুলির বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে, শক্তিশালী মার্কিন চাহিদার কারণে সুদের হার বৃদ্ধি একটি শক্তিশালী সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভিত্তিতে উদীয়মান অর্থনীতির জন্য উপকারী। কিন্তু আরও ভঙ্গুর অর্থনীতিগুলির জন্য এটি অস্থিতিশীলতা ডেকে আনবে। কঠোর মার্কিন মুদ্রানীতির কারণে কোন দেশগুলি সবচেয়ে বেশি চাপের সম্মুখীন হয়েছে, তা মূল্যায়ন করার জন্য দ্য ইকোনোমিস্ট ধনী এবং উন্নয়নশীল ৬০টি বড় অর্থনীতির তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং একটি ‘ভালনারেবিলিটি ইনডেক্স’ তৈরি করেছে। এই সূচকগুলিতে উচ্চ হার আরও ভঙ্গুর অর্থনীতির প্রতিনিধিত্ব করে। বিশাল চলতি হিসাব, উচ্চ মাত্রার ঋণ (বিশেষ করে বিদেশীদের কাছে স্বল্পমেয়াদী ঋণ), ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি এবং অপর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আমেরিকান নীতি কঠোর হওয়ার সাথে সাথে অস্থির পুঁজি প্রবাহ এই অর্থনীতিগুলির জন্য ব্যাপক সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
কিছু জায়গায় ইতিমধ্যেই চাপ চলছে। ভালনারেবিলিটি ইনডেক্সের শীর্ষে থাকা আর্জেন্টিনার মূল্যস্ফীতির হার ৫০ শতাংশের উপরে এবং দেশটি গভীরতর অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। তুরস্কের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো দেখালেও, ঊর্ধ্বমুখী দামের মুখে সুদের হার কমানোর জন্য সরকারের একগুঁয়েমি দেশটির অর্থনীতিকে বিপদে ফেলেছে। ২০২১ সালে ডলারের বিপরীতে তুর্কি লিরার মূর্য প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যাওয়ায় তুর্কিদের মজুরি এবং পেনশনের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। অর্থবাজারগুলি সাধারণত ধনী বিশ্বকে আরও নিশ্চয়তা প্রদান করে, তবে যদি বিশ্বব্যাপী আর্থিক পরিস্থিতি যথেষ্ট নেতিবাচক হতে শুরু করে, তাহলে গ্রিসকে গুরুতর সমস্যায় পড়তে দেওয়া যাবে না, এটা নীতি নির্ধারকদের বোঝানোর জন্য ইউরোপীয় নেতাদের আরও বেশি ঘাম ঝরাতে হবে। বড় উদীয়মান অর্থনীতিগুলির মধ্যে বর্তমানে ব্রাজিলকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপ‚র্ণ মনে হচ্ছে। চীনে রপ্তানিকারক ৬০টি অর্থনীতি অন্যতম দেশটি তার নিজস্ব জিডিপি হ্রাসের একটি স‚চক অবলোকন করছে।
চীনে সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারকদের মধ্যে সিঙ্গাপুর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো আরও অনেক দেশ চীনের উৎপাদন সরবরাহ চেইনের গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্ক। চীনের নিম্ন প্রবৃদ্ধি অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতে আঘাত করতে পারে, যা চীনে সম্পদ রপ্তানি করে এবং জার্মানি, যার শিল্প-সরঞ্জাম সংস্থাগুলি চীনা গ্রাহকদের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। তবে আরও ঝুঁকিতে রয়েছে দরিদ্র পণ্য রপ্তানিকারকরা যারা চীনের জনসংখ্যাকে খাদ্য এবং বাসস্থান সম্পর্কিত পণ্য সরবরাহে সহায়তা করেছে। এর মধ্যে, ওমিক্রনের এর উত্থান নতুন অনিশ্চয়তা যোগ করেছে। ভ্যারিয়্যান্টটি যে কি পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি করতে পারে, তা এখনও ধারনার বাইরে। ইতিমধ্যেই, ডলারের বিপরীতে অনেক মুদ্রার দর পড়ে গেছে। যদি এটি অব্যাহত থাকে, তাহলে এর ফল দীর্ঘস্থায়ী কঠোর মার্কিন মুদ্রনীতির প্রভাবের থেকে ভিন্ন হবে না। যদি ওমিক্রনের আবির্ভাবে বাণিজ্য ও প্রবৃদ্ধিকে হ্রাস পায়, তাহলে এর বিস্তার দুর্বল অর্থনীতিগুলিকে আরও বিপর্যস্ত করে দেবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন