ইমরান মাহমুদ : বিদায় দিনে কি ব্রান্ডন ম্যাককালাম স্মৃতির ভেলায় চড়ে ফিরে গিয়েছিলেন ৮ বছর আগে হ্যামিল্টনের ঠিক এই সিডন পার্ক স্টেডিয়ামে? দিনটা কি দুর্দান্তই না ছিল সেদিনের স্টেফেন ফ্লেমিংয়ের দলের জন্য। অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ৩৪৬ রান তাড়া করে সেদিন ম্যাচের সাথে চ্যাপেল-হ্যাডলি সিরিজটাও জিতেছিলেন ৩-০ ব্যবধানে। ম্যাককালাম খেলেছিলেন অপরাজিত ৮৬ রানের ইনিংস। এতদিন ধরে ওটিই ছিল অজিদের বিপক্ষে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে শেষ সিরিজ জয়। ৮ বছর পর কিউইরা আবার সিরিজ জয়ের শিরোপা উচিয়ে ধরলেন সেই হ্যামিল্টনের সিডন পার্ক স্টেডিয়ামে। কিন্তু এত মিলের মাঝেও সেই আর এই হ্যামিল্টনে আজ কত ফারাক! সেদিনের হ্যামিল্টনে ছিল না কোন বিদায়ের রাগিনী, যে রাগে গতকাল ভেসে গেল হ্যামিল্টন। শুধুই কি হ্যামিল্টন?, লক্ষ কোটি ক্রিকেট ভক্তদের হৃদয়ও নয় কি?
নাকি স্মৃতি এদিন ‘বাজ’কে নিয়ে গিয়েছিল আরো পিছনে? ২০০২ সালের ১৭ জানুয়ারির সেই সিডনিতে যেদিন এই প্রিয় প্রতিপক্ষের বিপক্ষেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হয়েছিল। না, ব্যাট হাতে সেদিন কিছু করে দেখাতে পারেননি। তার আগেই ব্রেটলির রান আউটের শিকার হয়ে ফেরেন ড্রেসিংরুমে। তাতে কি? ম্যাচ তো জিতেছিল তারা, সেই সাথে সিরিজও। ১৪ বছর পর একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে যাত্রার পরিসমাপ্তি। শেষ বেলাতেও ম্যাচের সাথে সিরিজ জয়ের সুখ- বেদনা। এমন সৌভাগ্য হয় ক’জনার?
একদিনের ক্রিকেট থেকে বিদায়ের ঘোষণাটা আগেই দিয়ে রেখেছিলেন ম্যাককালাম। সেই অনুযায়ী সদ্য সমাপ্ত চ্যাপেল-হ্যাডলি সিরিজেই নিউজিল্যান্ডের জার্সি গায়ে শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছেন তিনি। ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচেও ম্যাককালামের সেই চিরচেনা রূপ। ২৭ বলের মোকাবেলায় করেন ৪৭ রান। ৬টি চার ও ৩টি ছয় ছিল তাতে। টেস্ট ক্রিকেটে কিছুদিন আগেই দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ছুঁয়েছিলেন শততম ঝক্কা হাকানোর রেকর্ড। বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানের তকমা যার গায়ে বিদায়ী ম্যাচের ৩ ছক্কায় সেই তিনি ঢুকে গেলেন ওয়ানডেতে ২০০ ছক্কা হাকানো ব্যাটসম্যানের তালিকায়। তিনি নিজেও নাকি জানতেন রেকর্ড গড়তে তিনটি ছক্কার প্রয়োজন। ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে এসে সেটি করেই ছাড়লেন সময়ের ভয়ঙ্করতম এই ব্যাটসম্যান।
একদিনের ক্রিকেটে ম্যাচ ও রানের বিবেচনায় দেশের হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ ক্রিকেটার তিনি। তবে উইকেটের পিছনে তার কীর্তিটা নিয়ে গেছেন অন্য সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে (২৪২টি)। আর অধিনায়ক ম্যাককালামের তো ধারে কাছেও নেই কেউ। কিউইদের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক বলা হয় স্টেফেন ফ্লেমিংকে। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছরে দেশের ২১৮টি একদিনের ম্যাচে নেতৃত্ব দেন ফ্লেমিং। জয়ের হার ৪৮.০৪ শতাংশ। কিন্তু ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত ৬২ ম্যাচে (দেশের হয়ে ৩য় সর্বোচ্চ) ম্যাকের জয় ৬১.৮৬ শতাংশ। কমপক্ষে ১০ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছে এমন বিবেচনায় সবার ওপরে ম্যাক।
ক্রিকেটে সাবেক খেলোয়াড়দের তালিকা বলে দেয় তারা প্রায় সকলেই আগে অবসর নেন টেস্ট থেকে, এরপর ওয়ানডে, কিছুদিন টি-টোয়েন্টি দাপিয়ে বেড়ানোর পর তবেই শুধান সব সংস্করণে বিদায়ের বাণী। কিন্তু ম্যাককালামের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারেই উল্টো। আগেই ঘোষণা দেন টি-২০ ছাড়ার। অথচ বর্তমান সময়ে এই ভার্সনের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনের একজন হলেন ম্যাককালাম। সামনেই টি-২০ বিশ্বকাপের আসর। এছাড়া ম্যাক ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মেই ছিলেন বলা যায়। তা সত্ত্বেও ২০০৫ সালে অকল্যান্ডে অজিদের বিপক্ষে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল গেল বছর ইংল্যান্ড সফরেই শেষ হয় সেই যাত্রা। টি-২০’তে অবশ্য ওয়ানডের উল্টে চিত্র, শুরু (২৪ বলে ৩৬) আর শেষ (১৫ বলে ৩৫) দু’টোয় হার দিয়ে। এরপরই নিলেন একদিনের ক্রিকেট থেকে অবসর। গেল বার তার অধীনেই দল প্রথমবারের মত ওঠে বিশ্বকাপের ফাইনালে। এই মুহূর্তে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট সিরিজও খেলছেন বি-ম্যাক। সেখানেও এক অনন্য রেকর্ডের অধিকারী এই ডানহাতি স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান।
আন্তর্জাতিক টেস্টে ক্রিকেটে নূন্যতম একশ’টি ম্যাচ খেলার রেকর্ড আছে ৬৩ জনের। ১৯৬৮ সালে প্রথম এই মাইলফলকে পা রাখেন ইংলিশ ব্যাটসম্যান কলিন কাউড্রে। শেষ ব্যটসম্যান হিসেবে এবি ডি ভিলিয়ার্স। এতক্ষনে সেই সংখ্যাটি ৬৪ ছুঁয়েছে। শেষ ব্যাটসম্যানই হলেন ব্রান্ডন ম্যাককালাম। কিন্তু ম্যাককালাম যেটা করে দেখালেন সেটা করে দেখাতে পারিনি বাকি ৬৩ জনের কেউই। গতকাল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাঠে নামার সাথে সাথে গড়ে ফেলেছেন সেই রেকর্ড। সাদা জার্সি গায়ে চড়ানোর পর দেশের হয়ে কোন ম্যাচই অনুপস্থিত না থেকে টানা একশ’টি ম্যাচ খেললেন ম্যাককালাম। সাদা পোষাকে যাত্রার শুরুটা ২০০৪ সালের মার্চে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। এরপর থেকে নিউজিল্যান্ড যতগুলো টেস্ট ম্যাচ খেলেছে তার প্রত্যোকটিতে ছিল ম্যাককালামের নাম।
যে ক’জন খেলোয়াড়ের হাত ধরে ক্রিকেট আজ জনপ্রিয়তার বর্তমানে দাঁড়িয়ে, যারা ক্রিকেটকে দিয়েছেন সৌন্দর্যের নতুন রূপ তাদের তালিকার শীর্ষস্থনীয় একটি নাম ব্রান্ডন ম্যাককালাম। সর্বশেষ আইসিসি অ্যাওয়ার্ডে পেয়েছেন স্পিরিট অব ক্রিকেটের খেতাব। এমন একজনকে হারিয়ে কিছুটা হলেও কি রং হারাবে না ক্রিকেট?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন