শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রহ:)-এর অমর কীর্তি কী

আবুল কাসেম হায়দার | প্রকাশের সময় : ২ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

“এ যুগের দুশমনেরা আমাদের ঈমানে হাত দিয়েছে। এ যুগের দুশমনদের সাফল্য দেখলে যেকোন সচেতন মুসলমানের কান্না পাওয়ার কথা! আমাদের এ যুগের শোচনীয় ব্যর্থতার ইতিহাস বিশেষতঃ ঈমান অনুভূতির ক্ষেত্রে এই প্রজন্মের লজ্জাজনক পরাজয় কাহিনী অবশ্যই পরবর্তীরা চিহ্নিত করবে! কি ভয়বহই না এই পরাজয়! আর প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি গ্রাম-মহল্লা বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন শয়তানী-বদমায়েশী জাতীয় বোধ-বিশ^াসের গোড়া কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা মুজাদ্দেদে আলফেসানী, জামালুদ্দীন আফগানী, মুফতি মাহমুদ, আল্লামা ইকবাল, আল্লামা আবুল হাসান নদভী, হাজী শরীয়তউল্লাহ, মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ প্রমুখ কালজয়ী মনীষীদের উত্তরাধিকারী হওয়ার দাবীদাররা একের পর এক বাতিলের নিকট আত্মসমর্পণ করে গা বাঁচানোর চেষ্টা করছে।”

“জীবনের খেলাঘরে” নামক বিখ্যাত আত্মজৈবনিক গ্রন্থে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রাহ.) উপরের কথাগুলো বলেছেন।

বিংশ শতকে বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চলে যে ক’জন খ্যাতনামা মণীষী জ্ঞান, গবেষণা ও লেখনির সাহায্যে ইসলামকে জীবন ঘনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য একটি কালজয়ী জীবন দর্শন হিসাবে তুলে ধরতে সচেষ্ট হন, মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রাহঃ) ছিলেন তাদের অন্যতম। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চিন্তা-দর্শনের সফল উপস্থাপন, ইসলামের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে মৌলিক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা, আরবী ও উর্দু ভাষার উৎকৃষ্ট ইসলামী রচনাবলীর বাংলায় ভাষান্তর ও বাংলায় ইসলামী সাহিত্যের অগ্রপথিক ‘মাসিক’ মদীনার’ তিনি ছিলেন রূপকার এবং বিংশ শতব্দীর এক অনন্য সাধারণ ইসলামী প্রতিভা। জীবনের প্রায় সবটুকু সময় তিনি এ মহৎ কাজের ব্যয় করে বিপুল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে সক্ষম হন।

মাওলানা মহিউদ্দীন খানের জন্ম বৃটিশ শাসন আমলে ১৯৫৬ সালের জেলায়। মৃত্যুবরণ করেছেন ২০১৬ সালের ২ রা জুন, ঢাকায়।

১৯৫১ সালে আলীম, ১৯৫৩ সালে ফাজিল মাদ্রাসা থেকে পাশ করেন। ১৯৫৬ সালে ঢাকার আলীয় মাদ্রাসা থেকে হাদিসে কামিল ডিগ্রী লাভ করেন। এবং একই সময় তিনি কামিল ডিগ্রি ফিকাহ বিষয়ে- অর্জন পর কর্মজীবন শুরু করেন। মাওলানা মহিউদ্দীন খান জীবন যুদ্ধ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেনঃ

“একটু বয়স হওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম যে, কিশোর বয়সে যে শোষক অপশক্তির বিরুদ্ধে চাকু হাতে লড়াই করার জন্য আমি সংকল্পবব্ধ হয়েছিলাম ওরা সংখ্যায় এক দুটি নয়, অগণিত। আর চাকু নিয়ে ওদের মোকাবেলা আমার দ্বারা অন্ততঃ সম্ভব নয়। চাকু চাইতে অনেক বেশী ধারালো ও কার্যকর অস্ত্রের অনুশীলন আমাকে করতে হবে। কর্মজীবনের শুরুতেই কলম হাতে সংবাদপত্রের জগতে প্রবেশ করার প্রেরণা, আমি কৈশোরের সেই অনুভূতি থেকেই লাভ করেছিলাম।

তাই দেখা যায় মাওলানা মহিউদ্দীন খান ছাত্র জীবন থেকেই সাংবাদিকতা ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ‘সাপ্তাহিক নয়া জামানা’ সম্পাদনা করেন। ১৯৬০ মাসিক দিশারী পত্রিকাও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। মাত্র ২৬ বছর বয়স ১৯৬১ সাল থেকে ‘মাসিক মদীনা’ সম্পাদনার গুরু দায়িত্ব আমৃত্যু পালন করে গিয়েছেন।

অনন্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব, সমকালীন চিন্তার নন্দিত নায়ক মাওলানা মহিউদ্দীন খান। দীর্ঘদেহী, মধ্যম গড়ন শরীর, শশ্রুমন্ডিত, কেতাদুরস্ত পায়জামা পাঞ্জাবী ও শেরওয়ানী অঙ্গে এবং জিন্নাহ টুপি বা চিন্তি টুপি শোভা পেতো মাথায়। হাতে ষষ্টি, পায়ে নাগরা বা চপ্পল। খান্দানী ভাব, মার্জিত রুচি ও পরিশিলীত বাচনভঙ্গী সবসময় অসাধারণ করে রাখতো তাকে। নজরকাড়া দ্যুতিময় নূরানী চেহারা, অনুসস্বর, আবেগময় ভাষা, সুস্পষ্ট বক্তব্য, সহজ সাবলীল প্রকাশভঙ্গি, অত্যন্ত গোছানো কথা, আন্তরিক ও বিনয়ীভাব, পরিপাটি চালচলন অনন্য অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও অকৃত্রিম ভালোবাসা সহজেই আপন করে নিতো সবাইকে।

মাওলানা মহিউদ্দীন খানের ক্ষুরধার কলম এটি তার হাতের একটি কুড়ালের ন্যায় ছিল। কুড়াল দিয়ে যেমন বন-জঙ্গল, ঝাড়-ঝোপ কেটে পরিস্কার করা হয়, তেমনি তিনি তার লেখনির মাধ্যমে সবধরনের আবিলতা, পঙ্কিলতা, বাতিল শক্তির চিন্তাধারা, বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্র, ইজম-মতবাদের আগাছা পরগাছা নিড়িয়ে ফেলতেন। শুধু তাই নয়, ইসলামী সাহিত্য রচনায় মাওলানা আবদুর রহীম (রহঃ) পর তিনিই ইসলামের সঠিকরূপ বাংলা ভাষাভাষিদের কাছে তুলে ধরতের সক্ষম হয়েছেন। তিনি দ্বীনের প্রত্যেক শাখায় তার কলম চালিয়েছেন। তাফসীর, হাদীস, ইতিহাস, সীরাত, ফিকহ কোন দিক বাদ দেননি। তার মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। তার ভাষা ছিল সাবলীল, বর্ণনা গতিময় এবং বিষয়বস্তু সুসস্পষ্টভাবে ও বৈশিষ্ট্যে তিনি ছিলেন অনন্য অসাধারণ।

বাংলা ভাষায় অনুবাদ জগতে তিনি এককভাবে এমন উচ্চতায় আরোহন করেছেন যা কল্পনার অতীত। ইমাম আবু হামেদ আল গাযযালীর কালজয়ী গ্রন্থ ইহইয়াউ উলুমমিদ্দীন, কিমিয়ায়ে সাআদাত, আলমুরশিদুল আমীন, ইমাম অয়ুতীর খাসায়েসুল কুবরা, আল্লামা শিবলী নোমানীর সীরাতুন নবী (সাঃ) ও আল ফারুক ইত্যাদি বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ তার শ্রেষ্ঠ অনুবাদ কর্ম। (চলবে)

লেখক: সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন