পূর্ব প্রকাশিতের পর
এছাড়া তার বিখ্যাত গ্রন্থ সমূহ হচ্ছেঃ ইসলাম ও আমাদের জীবন, সিরাতুল মুস্তাকীম, মারেফুল কোরআন বাংলা অনুবাদ, জান্নাতের অমীয় ধারা জমজম, তজীদুল বোখারী, আযাদী আন্দোলন ১৮৫৭, মুমিনের জীবন যাপন পদ্ধতি, ও সহজ আরবী ব্যাকরণ, আল কাউসার, জীবনের খেলাঘরে প্রভৃতি।
মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রহঃ) এর মৌলিক ও অমর কীর্তিগাঁথার নাম মাসিক মদীনা। একটি বাংলা মাসিক পত্রিকা লক্ষাধিক সার্কুলেশন নিয়ে অর্ধশতাব্দীর চেয়ে বেশী সম ধরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা, নির্ভরতা ও বিশ^াসযোগ্যতার মানদন্ডে টিকে থাকতে পারে, তার নজীর দুই বাংলার কোথাও নাই। এ পত্রিকার মাধ্যমে মাওলানা মহিউদ্দীন খান যুগ যুগ ধরে লাখ লাখ মানুষের ধর্ম, জীবন ও আশা-আকাঙ্খার সাথে সম্পৃক্ত শত সহ¯্র প্রশ্নের যে জবাব দিয়েছেন, তা অনাগত দিনে মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি উত্তম ফিকহ শাস্ত্রের দলিল হয়ে থাকবে।
মাওলানা মহিউদ্দীন খান শুধু একজন ইসলামি সাহিত্য রচনায় পারদর্শী নন, তিনি সমাজ সংস্কারক ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি তার জীবনবোধ সম্পর্কে অতিশয় সচেতন ছিলেন। জীবন সম্পর্কে তার উপলব্ধি আমাদেরকে উৎসাহিত করে। তার কাছে কেউ কোন ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে গেলে, নীরব শ্রোতা হয়ে মনোযোগ সহকারে শোনতেন এবং কোরআন ও হাদীসের আলোকে সমাধান দেয়ার চেষ্টা করতেন। তিনি বলতেনঃ “সংসারে বেশীর ভাগ সময় নির্বিকার থাকতে চেষ্টা করবে, বুঝতেই তো পারছোÑ ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির নামে বর্তমানে সমাজ-সংসারে যা চলেছে, এত রঙ তামাশার জন্য আল্লাহ পাক আমাদেরকে সৃষ্টি করেননি। সৃষ্টির মূল লক্ষ্য হলো সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য করা। সুতরাং নিজের কর্মের প্রতি মনোযোগী হও। সব সময় লক্ষ্যের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখ। কখনো লক্ষ্যচুত হয়ো না।”
মাওলানা মহিউদ্দীন খান সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তার যোগ্য সন্তান আহম্মদ বদরুদ্দীন খান “আমার বাবা মহিউদ্দীন খান কেমন মানুষ ছিলেন” শিরোনামে লিখেনঃ
“তিনি সব সময় এ কথা অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতেন যে, মদীনা নামের বরকতেই আল্লাহপাক আমাকে একেবারে শূন্য থেকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। এ কথা কয়টি উচ্চারণ করার সময় ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতায় তার চোখে অশ্রু টলমল করত।
সীরাত সাহিত্য অধ্যয়ন ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বিনোদন। কর্ম জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় তিনি সীরাতে রাসূল (সাঃ) এর বিভিন্ন দিকের উপর রচনা, অনুবাদ ও গবেষনায় ব্যয় করেছেন। বিশ^বিখ্যাত কালজয়ী সীরাত গ্রন্থসমূহ মাতৃভাষা বাংলায় অনুবাদ, ও প্রকাশ করার জন্য তিনি ‘মদীনা পাবলিকেশন নামক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের কর্ম জীবনে আরবী, উর্দু ও ইংরেজী ভাষায় লিখিত প্রায় ত্রিশ হাজার গ্রন্থ আমার বাবা মাওলানা মহিউদ্দীন খান তার ব্যক্তিগত পাঠাগারের জন্য সংগ্রহ করেছেন, যার মধ্যে বিষয়বন্তুর দিক থেকে সত্তর শতাংশ গ্রন্থই হচ্ছে সীরাত বিষয়ক।
তিনি বলতেন এবং বিশ^াস করতেন যে, লেখালেখির ক্ষেত্রে সীরাতে রাসূল (সাঃ) এর চেয়ে উত্তম কোন বিষয় হতে পারে না। ”
মাওলানা মহিউদ্দীন খান সম্পর্কে বিশিষ্ট্য লেখক, গবেষক শামসুদ্দীন আহমদ এক প্রবন্ধে বলেন, “মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রাহঃ) ছিলেন একজন মহান দায়ী ও চিন্তক। শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর যে গুরু দায়িত্ব আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পণ করা হয়েছে তা পালন, উম্মাহর মন-মানস গঠন, তাদের মধ্যে ‘ঈমানী জাগরণ’ সৃষ্টি ও তাদেরকে নব চেতনায় উদ্দীপ্ত করার ক্ষেত্রে মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রাহ) এর রয়েছে এক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী এই মনীষী আমৃত্যু দেশ, জাতি ও ইসলামের বহুমুখী খেদমত করে গেছেন। তিনি সব শ্রেণীর আলেমদের নিকট ছিলেন সমাদৃত। আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ে ও দেওবন্দী আদর্শের অধিকারী এই মহৎ মানুষটি সর্বমহলের শ্রদ্ধা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন।”
মাওলানা মহিউদ্দীন খান একজন রাজনৈতিক সচেতন ইসলামী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন ইসলামী রাজনীতির প্রাণ পুরুষ। কিন্তু তিনি কখনো নেতৃত্বের জন্য রাজনীতি করেন নাই। ইসলামের বৃহৎ স্বার্থে তিনি জমিয়ত ছাড়াও বহু সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতীয় সীরাত কমিটি বাংলাদেশের তিনি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইসলামী ঐক্যজোটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা, ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চার সভাপতি, ভারতীয় নদী আগ্রাসন প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির আহবায়কসহ আরও অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন মাওলানা মহিউদ্দীন খান। তিনি ময়মনসিংহ জেলা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি বহুবার জেল খেটেছেন। মসলিম বিরোধী আন্দোলন, বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে আন্দোলন, কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলন, ফতোয়া রক্ষার আন্দোলনসহ নাস্তিক-মুরতাদ প্রতিরোধ আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।
শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ ইসলামী চিন্তানায়ক। তিনি রাবেতা আলম ইসলামীর স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি হুতামার আল আলম আল ইসলামীরও স্থায়ী কমিটির সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন।
মাওলানা মহিউদ্দীন খান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ এক প্রবন্ধে বলেনঃ
“মাওলা মহিউদ্দীন খানের অবদান রয়েছে দেশ-জাতি, ইসলাম-মুসলমান, শিক্ষা সাহিত্য, তাহযীব তামাদ্দুন, আন্দোলন সংগ্রাম, রাজনীতি অর্থনীতি ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায়। তিনি ছিলেন এদেশের রত্ন, এ দেশের সম্পদ, সমকালীন বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় ব্যক্তিত্ব, ইসলামী চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবী। তিনি বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্যের এক সফল রূপকার জীবন্ত মহীরুহ ও কিংবদন্তী পুরুষ হিসাবে সকলের নিকট সমাদৃত। এদেশের মাটি ও মানুষ তার কাছে ঋণী। দেশ ও জাতির খেমতে তার অবদান ইতিহাসের পাতায় চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে।”
মাওলানা মহিউদ্দীন খান ছিলেন অত্যন্ত উচু মাপের আলেম। নিরংহকার এই মানুষটি সাধারণ ও সাদামাটা জীবন যাপনকারী অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তার সম্পর্কে অধ্যক্ষ মুফতী শাঈখ মুহাম্মদ উছমান গণী ‘জ্ঞানের বাতিঘর মাওলানা মুহউদ্দীন খান শিরোনামে লিখেনঃ
“তিনি ছিলেন একাধারে বিদগ্ধ আলেম, সুলেখক, সাংবাদিক, পন্ডিত মনীষী, মুফাসসির, ফকীহ ও সমাজ বিজ্ঞানী। কিংবদন্তির প্রবদ পুরুষ ছিলেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন, ছিলেন দক্ষ আলেম ও সুবক্তা ছিলেন নির্মোহ গবেষক, লেখক ও দার্শনিক। অত্যন্ত দানশীল ছিলেন তিনি; যা তার কাছের লোকের সকলেই জানতেন, তিনি তার উপার্জনের সিংহভগই ব্যয় করতেন সেবামূলক কাজে। তার বাড়ী দিনের সকলের জন্য ‘আস দস্তরখান’।
সমাজ, সংস্কৃতি ও সমাজের নানা অনিয়ম নিয়ে তিনি সব সময় ভাবতেন। সমাজ পরিবর্তনের জন্য তিনি নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। সমাজের উন্নতি, ইসলামী মূল্যবোধের বাস্তবায়ন, ইসলামী সমাজ গঠনের জন্য তার ছিল ধ্যান চিন্তা প্রচেষ্টা ও লেখনি।
বর্তমান সমাজ, চার পাশের পরিবেশ আর অত্যাচার-অনাচারে রূপ-দর্শনে তিনি তার গ্রন্থ ‘জীবনের খেলাঘর’ উল্লেখ করেনঃ
“এখনও স্বঘোষিত বহু মোজাদ্দেদে হামানের প্রাদুর্ভাব অহরহই দেখতে পাই। এদের সাথে আমার মরহুম আব্বা ও তার বন্ধু-বান্ধবের জীবনখাতা, চিন্তা চেতনা, আমল আখলাকের তুলনা করলে শুধু হতাশাই বাড়ে। মনে হয় সিংহের খান্দান ক্রমেই যেন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আর তার পরিত্যাক্ত স্থানে এসে ভিড় করছে ফেউ জাতীয় মেরুদন্ডহীন ধূর্ত কিছু ইতর প্রাণী। বাংলার মুসলমান আজ নানামুখী বিজাতীয় আগ্রাসনের করুণ শিকার। কিন্তু এ মহা দুদিনে তাদের পাশে একজন মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ বা নিদানপক্ষে একজন মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীও নেই। এটা কিসের আলামত? সম্পূর্ণ ধ্বসের না অন্য কিছু? তা একমাত্র রাব্বুল আলামিনই বলতে পারেন‼”
মাওলানা মহিউদ্দীন খানে লেখার বদৌলতে, বিশেষ করে ‘মাসিক মদীনা’ বাংলাদেশে একটি ইসলামী চিন্তা চেতনার লেখক বলয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। (চলবে)
লেখক: সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন