বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মানবাধিকার, বঙ্গবন্ধু এবং মানবিক মূল্যবোধ

নাছিমা বেগম | প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০২১, ১:০৫ এএম

মানবাধিকার আসলে কী? বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি, মানবাধিকার একদিকে জীবনের অধিকার, অন্যদিকে স্বাধীনভাবে কথা বলার, চলাফেরা করার; অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদির অধিকার। কার্যত অধিকার ও দায়িত্ব একে অন্যের পরিপূরক। অধিকার পূরণের ক্ষেত্রে অধিকার প্রদানকারীর যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি অধিকার ভোগকারীরও দায়িত্ব রয়েছে। উভয়পক্ষের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন ছাড়া অধিকার বাস্তব রূপ পায় না।

মানবাধিকার একক ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি অনেক ব্যক্তির সমষ্টি জনগণের জন্যও সমানভাবে কার্যকর। উদাহরণ হিসেবে আমরা উল্লেখ করতে পারি যে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু নিজের কোনো সুবিধা আদায়ের জন্য কখনও সংগ্রাম করেননি। তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন সাধারণ জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য। কারা সদর দপ্তর থেকে প্রকাশিত ‘জাতির পিতার সমগ্র জেল জীবন- ৩০৫৩ দিন’ পাঠ করলে দেখা যায়, তিনি নিজের কোনো ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কখনও সংগ্রাম করেননি, সংগ্রাম করেছেন জনদাবি আদায়ের জন্য। জনস্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনের, বিশেষ করে যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো তাকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে। বাংলা ও বাঙালির অধিকার, বিশেষ করে জনদাবি আদায়ে বঙ্গবন্ধুর এই আত্মত্যাগের বিবরণ বঙ্গবন্ধু রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থ দুটির পরতে পরতে উল্লেখ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু জনদাবি আদায়ে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন এবং সফল হয়েছেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু অনশন শুরু করে যখন প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী, তখন পাকিস্তানের শাসকরা তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। জনদাবি ও মানবাধিকার সুরক্ষায় পাকিস্তান শাসনামলের অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদ এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার দাবিতে তার সংগ্রামের ঘটনাসমূহ বঙ্গবন্ধু সুনিপুণ লিখনির মাধ্যমে অজানাকে জানার সুযোগ রেখে গেছেন। বঙ্গবন্ধু রচিত এই গ্রন্থ দুটি বঙ্গবন্ধুর অসামান্য দেশপ্রেমের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

আমাদের প্রিয় স্বদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানবাধিকার সংগ্রামের ফসল হিসেবে। আর এই ফসল ফলিয়েছেন আমাদের জাতির পিতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক, উদ্দীপক ও মহানায়ক ছিলেন তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে, বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা, মানবসত্তার মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আর এগুলোর সমষ্টিই হলো মানবাধিকার। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পর মাত্র ১০ মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধু যে সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন, সেই সংবিধানে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত ৩০টি অনুচ্ছেদ সংবলিত সর্বজনীন মানবাধিকার দর্শনের পুরোপুরি প্রতিফলন রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে সম্পাদন না করলে অধিকার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবাইকে দায়িত্ব সম্পাদন করতে হবে। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা যদি একটু কষ্ট করি, একটু বেশি পরিশ্রম করি, সকলেই সৎপথে থেকে সাধ্যমতো নিজের দায়িত্ব পালন করি এবং সবচাইতে বড়ো কথা সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকি, তাহলে আমি বিনাদ্বিধায় বলতে পারি, ইনশাল্লাহ, কয়েক বছরেই আমাদের স্বপ্নের বাংলা আবার সোনার বাংলায় পরিণত হবে।’

বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। পাকিস্তান শাসনামলের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাক্কালে ও স্বাধীনতা-উত্তর দেশ গঠনে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তিনি যেসব বক্তৃতা দিয়েছেন, সেই বক্তব্যের নির্যাস থেকেই তা প্রতীয়মান হয়। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকেই বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ছিলেন। বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা স্থান পাবে না, এ বিষয়ে তার প্রত্যয় ছিল অবিচল। বঙ্গবন্ধু বলতেন, এই রাষ্ট্রের মানুষ হবে বাঙালি। তাদের মূলমন্ত্র হবে-সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে ব্যবহারের বিরুদ্ধে ছিলেন। তার দৃষ্টিতে সব ধর্মই সমান এবং সমঅধিকার দাবিদার। তাঁর চিন্তাচেতনায় মানবাধিকারের অন্যতম দর্শন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সবসময়ই সমুজ্জ্বল ছিল।

বঙ্গবন্ধু দুর্নীতিকে ঘৃণা করতেন। তিনি জানতেন, দেশের উন্নয়নের অন্যতম বাধা হলো দুর্নীতি। দুর্নীতিবাজ, মুনাফাখোররা অন্য মানুষের অধিকার হরণ করে নিজেরা মুনাফা লোটেন। তিনি তার বিভিন্ন বক্তৃতায় দুর্নীতিবাজ-মুনাফাখোর-চোরাকারবারিদের দমনে কঠোর মনোভাব পোষণ করেন। তাঁর সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পিতার মতোই দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষুষ্ণতা নীতি গ্রহণ করছেন। কার্যত বাংলাদেশের মাটি থেকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদককে রুখে দেওয়ার এখনই সময় এবং সবার সমবেত প্রচেষ্টায় তা প্রশমিত হবে বলে বিশ্বাস করি।

বঙ্গবন্ধু সারাজীবন অন্যের অধিকার সুরক্ষা করতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনের, নিজের আরাম ও আয়েশের কথা ভাবেননি। অথচ বাঙালি জাতির কী দুর্ভাগ্য যে, পাকিস্তানি হানাদাররা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাহস না করলেও এ দেশেরই একদল বিপথগামী সেনাসদস্য কল্পনাকেও হার মানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই হত্যাকা- ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম ঘটনা এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা কখনই পূরণযোগ্য নয়।

মানবাধিকার সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই এগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর শাসনামলেই প্রণীত হয় মানবাধিকার কমিশন আইন-২০০৯। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আইনের বিধান অনুযায়ী এর প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম স্বাধীনভাবে পরিচালিত করছে।
২০২১ সালের মানবাধিকার দিবসের প্রতিপদ্য হলো: ইংরেজিতে EQUALITY- Reducing inequalities, advancing human rights. বাংলায় এবারের প্রতিপাদ্য হলো ‘বৈষম্য ঘোচাও, সাম্য বাড়াও, মানবাধিকারের সুরক্ষা দাও।’ টেকসইই উন্নয়নের মূলমন্ত্রও হলো কাউকে পেছনে ফেলে নয়। কিন্তু নারী-পুরুষ, ধনী-গরিবের বৈষম্য সমাজে এখনো বিদ্যমান। নারীর ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সবার সেরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও মেয়েদের জীবনের অধিকার, সম্পত্তির মালিকানা, সম্ভ্রম-সুরক্ষা নিয়ে এখনো অনেক প্রশ্ন রয়েছে। কন্যাসন্তানকে এখনো অনেকেই পুত্র সন্তানের ন্যায় সমভাবে দেখেন না। যদিও আমাদের অনেক কন্যাই এখন শিক্ষা দিক্ষা, ক্রীড়া সংস্কৃতি এবং কর্মস্থলে সকল ক্ষেত্রেই পুরুষের চেয়ে যে, কম যোগ্য নন; তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। এরপরেও কোনো কোনো পরিবারে এখনো কন্যা শিশুর জন্ম দেওয়ার সুবাদে জন্মদাত্রী মাকে কতোইনা গঞ্জনা সহ্য করতে হয়।

গণমাধ্যম সূত্রে আমরা প্রায়শই দেখে থাকি নারীদের ধর্ষণের মতো ঘৃণ্যতম ঘটনার শিকার হতে। রাস্তাঘাটে, কর্মস্থলে এমনকি বাড়িতে পরিবারের নিকটতম স্বজনের দ্বারা। ৬ বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধাকেও ধর্ষণের শিকার হতে হয়। ধর্ষণের মতো ঘৃণ্যতম ঘটনার বিরুদ্ধে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বলেছেন ধর্ষকের কোনো দল নেই। আইন অনুযায়ী তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হবে। আইন সংশোধন করে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো ঘটছেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবাধ পর্নোগ্রাফি দেখার সুযোগ থাকায় ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে। এই ঘৃণ্যতম অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একত্রিত হয়ে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ তুলতে হবে; পরিবারে নারীকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পারিবারিক সহিংসতা বন্ধ করা এবং গৃহকর্মে নারীর অবদানের মূল্যায়ন এখন সময়ের দাবি।

এছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেও বর্তমানে সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা ও অনাচার তৈরি হয়েছে। অনেক সময় গুজবের মাধ্যমেও সমাজে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা হয়, যা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য একাধারে পারিবারিক মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতার বিকাশ সাধন যেমন প্রয়োজন, তেমনি তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত আজকের যারা কিশোর-কিশোরী তাদের মধ্যেও মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে হবে। তারাই আমাদের আগামী, তাদেরকে মানবাধিকারের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।

লেখক: চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন