আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও আহার জোগানোর জন্য দিন-রাত কঠিন পরিশ্রম করতে হয় কৃষকদের। অনেক ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা রয়েছে কৃষির উৎপাদনে। বন্যা কিংবা খরায় ফসল নষ্ট হলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হয় কৃষক। তাছাড়া ক্রমাগতভাবে উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষিকাজে মুনাফা হ্রাস পাচ্ছে। অনেক সময় উৎপাদন খরচটুকুও উঠে আসছে না। ফলে কৃষি ছেড়ে ভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছে অনেকে। ফসলের ভর-মৌসুমে দেখা যাচ্ছে শ্রমিক সংকট। দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে কৃষি শ্রমিকের মজুরি। অপরদিকে কৃষি থেকে সম্পদ ও পুঁজি চলে যাচ্ছে আধুনিক খাতসমূহে। তাতে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে কৃষির বিনিয়োগে। এমতাবস্থায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষিতে সহায়তা প্রদান ও মূল্য সমর্থন দেয়া এখন একান্ত অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষি খাতে সহায়তা দেয়া যায় সরকারি বাজেটের মাধ্যমে। সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ বা সংকোচনের মাধ্যমেও সহায়তা দেয়া যায়। কৃষিকে সহায়তা প্রদানের সময় একটি বড় কৌশল হচ্ছে পণ্যের মূল্য সমর্থন। এ ক্ষেত্রে প্রণয়ন করা হয় কৃষিপণ্যের মূল্যনীতি। কৃষিপ্রধান উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উল্লিখিত সব সহায়তা ও সমর্থনই কম-বেশি বিদ্যমান।
প্রশ্ন উঠছে, সহায়তা ও সমর্থনের মাত্রা নিয়ে। বাজেট সহায়তার ক্ষেত্রে আমাদের কৃষিতে ব্যয়ের পরিমাণ দিনের পর দিন টাকার অঙ্কে বাড়ছে; কিন্তু হ্রাস পাচ্ছে আপেক্ষিক অর্থে। কৃষিতে প্রণোদনা জোগানোর জন্য প্রদত্ত ভর্তুকির পরিমাণও আপেক্ষিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ছয় বছর আগে মোট বাজেটের ৬ শতাংশেরও বেশি ব্যয় করা হয়েছিল কৃষিভর্তুকি খাতে। এখন তা নেমে এসেছে ২ শতাংশেরও নিচে।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে কৃষি খাতে সহায়তা ও সমর্থন প্রদানের কোনো সীমারেখা বাংলাদেশের জন্য নির্ধারণ করা নেই। অর্থাৎ কৃষিতে সহায়তা হ্রাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে পুরোপুরি ছাড় দেয়া হয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিমালায়। ২০২৪ সালের পর উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান নিশ্চিত হলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী মোট কৃষি উৎপাদনের ১০ শতাংশ পর্যন্ত কৃষি ভর্তুকি খাতে ব্যয় করা যাবে। তাতে বর্তমান বাজারদরে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা যাবে কৃষি ভর্তুকি খাতে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ এর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অর্থ ব্যয় করছে।
কৃষিতে সহায়তা প্রদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হচ্ছে পণ্যের মূল্য সমর্থন। এর জন্য দরকার একটি মূল্যনীতি। এর মাধ্যমে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায়। অপরদিকে ন্যায়সঙ্গত মূল্যে পণ্য ক্রয়ের নিশ্চয়তা পায় ভোক্তা। এ দেশের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ গ্রামীণ জীবন কৃষিকর্মের ওপর নির্ভরশীল। পক্ষান্তরে গরিব মানুষের শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগ পারিবারিক ব্যয় নিয়োজিত হয় খাদ্য কেনার জন্য। এমতাবস্থায় উৎপাদনকারী কৃষক ও পণ্য গ্রহণকারী ভোক্তা উভয়ের জন্যই একটি ইতিবাচক মূল্যনীতি প্রয়োজন। এর মাধ্যমে কৃষকের আয় স্থিতিশীল রাখা যায়, কৃষিপণ্যের মূল্য ওঠানামার মাত্রা সংযত করা যায় এবং পণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে রফতানি বৃদ্ধি ও আমদানি হ্রাস করা যায়। ভারতসহ পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এবং ইউরোপীয় দেশসমূহে অত্যন্ত কৃষকবান্ধব মূল্যনীতি বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশে এর প্রয়োগ ও বিস্তার তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।
কৃষি মূল্যনীতির অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে পণ্যের ন্যূনতম সমর্থনমূল্য নির্ধারণ করা। এটা প্রতি বছরই নির্ধারণ করা হয় সরকারিভাবে। কৃষকের জন্য উৎপাদিত পণ্যের ন্যূনতম মুনাফা নিশ্চিত করা এর উদ্দেশ্য। ভারতে বর্তমানে ২৩টি কৃষিপণ্যের সমর্থনমূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। নির্ধারিত মূল্যের নিচে যাতে বাজারদর নেমে না যায় সে জন্য সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করে নেয় সরকার।
২০১৮-১৯ সালের বাজেটে ভারত সরকার বিভিন্ন কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেছে উৎপাদন খরচের ওপর শতকরা ৫০ শতাংশ মুনাফা হিসাব করে। মোট উৎপাদিত পণ্যের শতকরা ১৫ শতাংশ ক্রয় করা হচ্ছে এরূপ পূর্বনির্ধারিত মূল্যে। বাংলাদেশে ন্যূনতম সমর্থনমূল্য নির্ধারণের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে প্রচলন আছে ধান-চাল ও গমের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণের। এটা সাধারণত উৎপাদন খরচের ওপর ৬ থেকে ১০ শতাংশ মুনাফা দেখিয়ে নির্ধারণ করা হয়। এর পরিধিও সীমিত। মোট উৎপাদনের মাত্র ৪/৫ শতাংশ খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হয় উৎপাদন মৌসুমে। তাও ক্রয় করা হয় ব্যবসায়ী ও চাতালের মালিকদের কাছ থেকে। কৃষক তাতে সরাসরিভাবে লাভবান হয় না। ফলে আমাদের দেশে প্রচলিত উৎপাদিত পণ্যের সংগ্রহমূল্য স্থানীয় বাজারে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তাতে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয় কৃষক। অনেক সময় উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে কৃষক তার উৎপাদন খরচটুকুও ঘরে নিয়ে আসতে পারে না।
কৃষিপণ্যের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণের জন্য কিছু নিয়ম প্রচলিত আছে। সেক্ষেত্রে আগের বছরের পণ্যমূল্য, উৎপাদন খরচ, খোলা বাজারে পণ্যমূল্যের চালচিত্র, আন্তর্জাতিক বাজারদর, সরকারি মজুদ ও মূল্যস্ফীতির হার ইত্যাদি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। আমাদের দেশে বর্তমানে ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয় মূলত উৎপাদন খরচের ওপর ভিত্তি করে। তাও সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে নয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালের আমন মৌসুমে উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করা হয় প্রতি কেজি চাল ৩৪ টাকা। অনেকের মতে, তা ৩৮ টাকা। আগের বছর সরকারিভাবে তা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৭ টাকা। প্রতি বছর যেহেতু উপকরণ খরচ বাড়ছে সেহেতু উৎপাদন খরচ হ্রাসের কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এটা স্পষ্টই অসঙ্গতি। এবার আমন চালের সংগ্রহ মূল্যও গত বছরের তুলনায় ৩ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬ টাকা। গত মৌসুমের বোরো চাল সংগ্রহ মূল্যের চেয়েও তা ২ টাকা কম। এ নিয়ে উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসন্তোষ আছে।
জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে উৎপাদন খরচ নির্ধারণের জন্য তিনটি সংস্থা নিয়োজিত রয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে যে হিসাব উপস্থাপন করা হয় তাতে ফারাক থাকে অনেক। স্বাভাবিকভাবেই পণ্যের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ ও সংগ্রহমূল্য নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন দেশে রয়েছে ‘এগ্রিকালচারাল প্রাইস কমিশন’। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে এখন কৃষিমূল্য কমিশন কার্যকর রয়েছে।
কমিশনের কাজ হল পণ্যের উৎপাদন খরচ নির্ণয় করা, ন্যূনতম সমর্থন মূল্য নির্ধারণ করা এবং কৃষিপণ্যের রফতানি মূল্য নির্ধারণ ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ পেশ করা। মাঠের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং কৃষি উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন তাদের সুপারিশ পেশ করে থাকে। তাদের সুপারিশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাই মেনে নেয়। বাংলাদেশে এরূপ একটি প্রাইস কমিশন গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের। আমাদের জাতীয় কৃষিনীতিতেও একটি প্রাইস কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয়নি। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য বিশ্বের প্রতিটি দেশেই বিভিন্ন সহায়তা ও সমর্থন প্রদানের দৃষ্টান্ত রয়েছে। এর মধ্যে উপকরণ ভর্তুকি ও পণ্যের মূল্য সমর্থন অন্যতম। বাংলাদেশে উপকরণ ভর্তুকি প্রদানের বিষয়টি বহুল আলোচিত হলেও পণ্যের মূল্যসমর্থনের বিষয়ে তেমন গুরুত্বসহ আলোচনা হয় না। ফলে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে প্রতিনিয়তই কৃষক বঞ্চিত হলেও তা সমাধানের জন্য তেমন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। এ দিকে বর্তমান সরকার আশু দৃষ্টি দিতে পারে।
লেখক: উপ-পরিচালক, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন