শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

বরিশালে ‘ব্রি’ উদ্ভাবিত প্রযুক্তি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যাবহার হ্রাস করছে বাঁচবে কৃষকের জীবন ও কয়েক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা

বরিশাল ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ২০ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:৪৫ পিএম

বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইন্সটিটিউট উদ্ভাবিত বিভিন্ন লাগসই প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে কৃষকের মাঝে প্রচলন করলে দেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার বাহুলাংশে হ্রাস করা সম্ভব। এতেকরে দেশের লক্ষ লক্ষ কৃষকের স্বাস্থ্য ঝুকি হ্রাস সহ কয়েক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রারও সাশ্রয় সম্ভব বলে ‘বাংলাদেশ গবেষনা ইন্সটিটিউট-ব্রি’র কৃষি বিজ্ঞানীগন জানিয়েছেন। বরিশালে ব্রি’র আঞ্চলিক কেন্দ্রের বিজ্ঞানীগন গত কয়েক বছর ধরে তাদের নিজস্ব দুটি কৃষি খামারের প্রায় ১শ একর জমিতে কোন ধরনের কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়াই অত্যন্ত সফলতার সাথে আমন, আউশ ও বোরো ধান উৎপাদন করে আসছেন।
ব্রি’র বিজ্ঞানীদের দেখান পথ ধরে ‘হাত জাল’, ‘আলোকফাঁদ’ ও ‘পার্চিং পদ্ধতি’র মত দেশীয় লাগসই প্রযুক্তিতে ক্ষতিকর কীট পতঙ্গ ধংশ করে কীটনাশকমুক্ত ধান চাষে ব্যাপক সফলতা অর্জন করছেন দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকরা। ফলে প্রতি একর জমিতে ধানের উৎপাদন ব্যায় প্রায় ৫ হাজার টাকা হ্রাস পাওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটছে। এতদিনকার কীটনাশক ব্যবহার রোধ করে কৃষকদের প্রকৃতিকভাবে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফিরিয়ে আনছে ‘ব্রি’ । ব্রি বরিশালের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলমগীর ও কীটতত্ত্ববিদ মনিরুজ্জামান কবির-এর এ প্রচেষ্টা কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুকিও অনেকাংশেই হ্রাস পাচ্ছে।
বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন এসোসিয়েশনের তথ্য মতে ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের সাথে দেশে ধান চাষে কীটনাশকের ব্যবহারও আশংকাজনহারে হারে বাড়তে থাকে। ১৯৫৬ সালে দেশে সর্বপ্রথম ফসলের পোকামাকড় দমনে ৩ টন কীটনাশক আমদানি হলেও ২০২০ সালে আমদানির পরিমাণ ৩৭ হাজার ৫৬৩ মেট্টিক টন ছিল বলে ব্রি’র দায়িত্বশীল সূত্রে বলা হয়েছে। কিন্তু এসব কীটনাশক সাময়িকভাবে কীটপতঙ্গ ধংশ করলেও ক্ষতিকর পোকামাকড়ের আক্রমণেই দেশে আউশ মৌসুমে ২৪%, আমনে ১৮% এবং বোরোতে ১৩% ধানের ফলন কমে যায়। উপরন্তু এসব কীটনাশক পরিবেশের ওপরও মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ঝুকিতে ফেলছে কীটনাশক প্রয়োগকারী কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের জীবন। ত্বকের ক্ষত, জ¦ালাপোড়া ও ক্যানসার সহ কিডনী বিনষ্ট এবং অন্যান্য জটিল রোগের ঝুকিতে ফেলছে কৃষক সহ কীটনাশক প্রয়োগকারীদের। এমনকি অনেক কীটনাশক কৃষকদের অন্ধত্বেরও অন্যতম কারণ বলে জানিয়ে তা মানবদেহের জন্য দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ঝুকি তৈরী করছে বলেও মনে করছেন ব্রি’র বিজ্ঞানীগন।
ব্রি’র বিজ্ঞানী ড. আলমগীরের মতে, ‘সাইফার মেট্রিন’ নামের এক ধরনের কীটনাশক জলজ প্রাণির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এরফলে মাছ সহ বিভিন্ন জলজ প্রাণি ধংশ হচ্ছে। খালি গায়ে ও খালি চোখে কীটনাশক স্প্রে করায় কৃষকদের চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা জানিয়ে ড. মুনিরুজ্জামান বলেন, কীটনাশক স্প্রে করার সময় কৃষকদের অব্যশই পুরাতন কাপড়ে শরিরে আবরন তৈরী সহ নাক-মুখে পুরাতন গামছা পেচিয়ে ও চোখে চশমা ব্যবহার করতে হবে।
বরিশালে ব্রি’র দুটি খামারের প্রায় ১শ একর জমিতে ২০১৯ সালের বোরো মৌসুমে মাজরা পোকার আক্রমনে তিনবার কীটনাশক স্প্রে করেও পোকা দমন করা সম্ভব হয়নি। কীটত্ত্ববিদ মনিরুজ্জামান কবির, মাজরা পোকায় খাওয়া সাদা শীষ সংগ্রহ করে গাছের কান্ডের ভেতর কালো মাথার পোকার উপস্থিতি লক্ষ্য করেন। পরবর্তীতে কারটাপ গ্রুপের কীটনাশক স্প্রে করে মাজরা পোকা দমন করা হয়।
কিন্তু একই বছরের আমন মৌসুমের ব্রি’র বরিশালের খামারের জমিতে চারা রোপন থেকে গাছে ফুল আসার আগ পর্যন্ত হাতজাল দিয়ে মাজরা পোকা ধরে মেড়ে ফেলা হয়। সেইসাথে হাতজালে কোন উপকারী পোকা আসলে তা পুনরায় ধানের জমিতে ছেড়ে দেয়া হয়। ক্ষতিকর পোকার সিংহভাগই বাদামি রঙের আর উপকারি পোকাগুলো রঙ্গিন হয়ে থাকে। হাতজাল দিয়ে হেঁটে হেঁটে মাজরা পোকা ধরার সময় ধান গাছের পাতা থেকে ডিমের গাদা সংগ্রহ করে ধ্বংস করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্রি’র চরবদনা খামারে দুজন ও সাগরদী খামারে একজনকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন এ কীটতত্ববিদ।
এ পদ্ধতিতে ২০১৯ এর আমন এবং ২০২০ ও ’২১ সালে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে কোন প্রকার কীটনাশক ছাড়াই ধান উৎপাদিত হয়েছে ব্রী’র দুটি খামারে ।
ব্রি’র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান সাংবাদিকদের জানান, দেশে ধানের জমিতে ২৬৬ প্রজাতির ক্ষতিকর পোকা ও ৩৪৬ প্রজাতির উপকারী পোকা রয়েছে। চারা রোপনের শুরুতেই কীটনাশক প্রয়োগ করলে উপকারী ও ক্ষতিকর উভয় পোকাই মারা যায়। পরবর্তীতে ক্ষতিকর পোকা দমন করা যায়না। তাই চারা রোপনের পর থেকে ফুল আসা পর্যন্ত হাতজাল দিয়ে মাজরা পোকা ও তার ডিম সংগ্রহ করে ধ্বংস করলে কীটনাশক প্রয়োগের দরকার হয়না। তার মতে, ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত মাজরা পোকা গাছের পাতায় বসে থাকে। তখন হাতজাল দিয়ে হেঁটে হেঁটে পোকটি সহজেই ধরা যায়। সেইসাথে ধানের জমিতে চারা রোপনের পরপরই গাছের ডাল পুতে পোকাখেকো পাখি বসার ব্যবস্থা- ‘পার্চিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করলেও আশাতীত ফল পাওয়া যায় বলে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলমগীর জানিয়েছেন। একইভাবে ধানের জমিতে সন্ধার পরে ‘আলোক ফাঁদ’ বসালেও বেশীরভাগ ক্ষতিকর পোকা আলোর টানে কাছে এসে ফাঁদের কোরোশিন ও পানিতে ডুবে মারা যায়।
ডিএই’র দায়িত্বশীল সূত্রের মতে সদ্য সমাপ্ত আমন মৌসুমে বরিশাল অঞ্চলে প্রায় ৮ হাজার আলোক ফাঁদ ও ৪ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে পার্চিং পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে কীটনাশকের ব্যাবহার অনেকাই হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। এসময় বৃহত্বর ফরিদপুরের ৫টি জেলাতেও ৮ হাজার ৬৪৫টি আলোক ফাঁদ ও প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে পার্চিং পদ্ধতি ব্যাবহার ছাড়াও বিপুল সংখ্যক হাত জাল দিয়ে পোকা ধংশ করা হয়েছে। ভবষ্যিতে সোলারের মাধ্যমে আলোক ফাঁদের চিন্তা করা হচ্ছে বলেও ডিএই’র বরিশাল অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক জানিয়েছেন।
ব্রি বরিশালের প্রযুক্তিটি সফল হবার পর ডিএই’র সহযোগিতায় বরগুনার আমতলীর রাওঘা ব্লকে ১০ একর জমিতে আমন মৌসুমে ধানের প্রদর্শনী প্লট করা হয়। প্রদর্শনীতে কৃষকদের ‘ব্রি ধান ৭৬’ এর বীজ দেয়ার পাশাপাশি হাতজাল বিতরন করা হয়। প্রদর্শনীতে কৃষকদের হাতজাল দিয়ে ক্ষতিকর পোকা ধরে ধ্বংশ করা ও উপকারী রঙিন পোকা আবার জমিতে ছেড়ে দেওয়ার পদ্ধতি হাতে কলমে শেখান হয়েছে। গত ২৫ নভেম্বর প্রদর্শনীটির মাঠ দিবসে দেড় শতাধিক কৃষক বিষমুক্ত ধান চাষে উপস্থিত হন।
ব্রি’র কীটতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শেখ শামিউল হক সাংবাদিকদের বলেন, চারা রোপনের পর মাজরা পোকা কিছু গাছের কান্ড কেটে দিলেও ফলনের কোন ক্ষতি হয়না। কারন হিসেবে পরবর্তীতে যে কুশিগুলো জন্মে সেগুলো থেকে ভাল ফলন পাওয়া যায় বলে জানান তিনি। কিন্তু কৃষকরা ১/২টি পোকা দেখলেই কীটনাশক প্রয়োগ শুরু করেন। তার মতে, ধানের জমি চারা রোপনের প্রথম ৩০ থেকে ৪০দিন কীটনাশক মুক্ত রাখতে হবে।
বিষমুক্ত ধান চাষের এসব প্রযুক্তির ব্যাপারে ব্রি বরিশালের প্রধান ও মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলমগীর হোসেন জানান, পর্যায়ক্রমে এ পদ্ধতি সম্পর্কে দক্ষিণাঞ্চলের সব জেলার কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন