মোহাম্মদ খায়রুল বাশার
আহলে জান্নাতের যুবকদের দুই সাইয়্যেদ বা নেতার মধ্যে একজন হলেন হযরত হাসান ইবনে আলী ইবনে আবি তালিব (রা.), যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমরা উল্লেখ করেছি। আর দ্বিতীয়জন হলেন হযরত হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)। তিনি হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) ও খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা (রা.)-এর দ্বিতীয় পুত্র। হিজরি চার কিংবা পাঁচ সালে তিনি মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হযরত হাসান (রা.)সহ এই দুই ভ্রাতা একত্রে আল হাসানান (দুই হাসান) বলে সমাধিক প্রসিদ্ধ। পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের সময় হযরত হুসাইন (রা.)-এর বয়স হয়েছিল ছয় অথবা সাত বছর। হযরত হুসাইন (রা.)-এর জীবনের প্রথম ৬টি অথবা ৭টি বসন্ত অতিবাহিত হয়েছিল মাতামহ হযরত মোহাম্মাদ মুস্তফা আহমাদ মুজতাবা (সা.)-এর অপত্য ¯েœহ ও অনাবিল মায়া-মমতার ভিতর দিয়ে। হাদিস শরিফে আছে, মাতামহ হযরত মোহাম্মাদ (সা.) বালক হযরত হুসাইন (রা.)-কে অত্যদিক ¯েœহ করতেন। তিনি তার গালে, কপালে চুমো খেতেন, কাঁধে তুলে নিতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর ছয় মাস পর্যন্ত হযরত হুসাইন (রা.) আম্মাজান খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা যাহরা (রা.)-এর গভীর সান্নিধ্যে ছিলেন। ¯েœহময়ী মাতার মৃত্যুর পর তিনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হযরত হাসান (রা.) এবং মান্যবর পিতা হযরত আলী ইবনে আবু তালিবের নিকট তালীম ও তারবিয়াত লাভ করেন। শেরে খোদা হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) হাসানাইন ভ্রাতৃদ্বয়ের জীবন বিকাশের যাবতীয় দিকের প্রতি গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন। ফলে হাসানাইন ভ্রাতৃদ্বয়ের জীবন ও কর্ম রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কর্মের প্রতিচ্ছায়া রূপে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। ইসলামের তৃতীয় খলিফা জিন্নুরাইন হযরত ওসমান ইবনে আফ্ফান (রা.) হিজরি ৩৫ সালে বিদ্রোহীদের তরবারির আঘাতে শাহাদতবরণ করলে মুসলিম জাহানে নেমে আসে দুর্যোগের এক ঘনঘটা। এ সময় মদিনায় অবস্থানকারী নেতৃস্থানীয় শাহাবায়ে কেরাম (রেদ.) হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.)-কে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব বিনীতভাবে পেশ করেন। প্রথমে তিনি প্রস্তাব গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। কিন্তু পাঁচ দিন পরে সাহাবিদের বিশেষ অনুরোধের ফলে তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ৩৫ হিজরির ২৫শে জিলহজ শুক্রবার মদিনার মসজিদে নববীতে সমবেত সাহাবায়ে কেরাম ও অন্য মুসলিমগণ খলিফা হিসেবে তার হাতে বায়াত হন। এ এ সময় হযরত হুসাইন (রা.)-এর বয়স হয়েছিল ২৯ অথবা ত্রিশ বছর। পরিপূর্ণ যৌবনদীপ্ত ও সকল বিদ্যায় পারদর্শী হযরত হুসাইন (রা.) ঈশানিয়াত, আমলিয়াত, এছলাছিয়াত, হুব্বুল্লাহু ও হুব্বুর রাসূলের সমুদ্রে নিজেকে সর্বদাই ব্যাপৃত রাখতেন। এ জন্যই হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা.)-এর দুর্যোগময় খেলাফাতের সময় হযরত হুসাইন (রা.) কোনো রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে কিংবা সমস্যাসঙ্কুল মুহূর্তে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেননি। হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা.)-এর শাহাদতবরণের পর তিনি তদীয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হযরত হাসান (রা.)-এর সান্নিধ্য হতে কখনো দূরে থাকতেন না এবং মদিনায় নির্জন জীবনযাপন করতেন। আমিরে মুয়াবিয়া (রা.)-এর রাজত্বকালে হযরত হাসান (রা.) এ ইন্তেকালের পর হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা.)-এর অনুগতদের নেতৃত্ব পদ গ্রহণের জন্য তদীয় ইরাকি সমর্থকদের সনির্বন্ধ অনুরোধ গ্রাহ্য না করে তিনি উমাইয়্যাদের সাথে হযরত হাসান (রা.) অপেক্ষা অধিকতর সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সম্মানজনক মনোভাব প্রদর্শন করেন। আমিরে মুয়াবিয়া (রা.)-এর মৃত্যুর পর পূর্বে সম্পাদিত চুক্তির খেলাপ ইয়াজিদের সিংহাসনারোহণের পর তার মতের বিরাট পরিবর্তন ঘটে। আহলে বাইতের সমর্থক ইরাকিগণ পুনরায় আবেদন করলে তিনি এতে সাড়া দেন। কিন্তু কোনো সুদৃঢ় কর্মপন্থা অবলম্বন করার পূর্বে তদীয় জ্ঞাতিভ্রাতা মুসলিম ইবনে আফীল (রা.)-এর সাহায্যে পরিস্থিতি যাচাই করার মনস্থ করেন। মুসলিম ইবনে আকীল (রা.), ইরাকে উপস্থিত হলে হাজার হাজার লোক তার সমক্ষে সমবেত হয়ে হযরত হুসাইন (রা.)-এর প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে। মুসলিম ইবনে আকিল ইরাকে অনুকূল পরিবেশ অবলোকন করে হযরত হুসাইন (রা.)-কে সেখানে গমনপূর্বক আন্দোলনের ভার গ্রহণ করতে অনুরোধ করে পত্র লিখেন। ইতোমধ্যে ইরাকে ইয়াজিদ কর্তৃক নবনিযুক্ত শাসনকর্তা উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ মুসলিম বিন আকিলকে বন্দি করে নিহত করেন। বস্তুত ইয়াজিদের আনুগত্য অস্বীকার করে হযরত হুসাইন (রা.) মক্কায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। এবার মুসলিম বিন আকিলের প্রেরিত পত্রের মর্মানুসারে তিনি মক্কা পরিত্যাগ করে কুফার পথে রওয়ানা হলেন। কুফা শহর হতে কয়েক মনজিল দূরে থাকতেই তিনি তদীয় দূত মুসলিম বিন আকিলের মর্মান্তিক মৃত্যুর শোকাবহ সংবাদ পেলেন। উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ হিজাজ হতে ইরাক পর্যন্ত রাস্তার সর্বত্র ফাঁড়ি স্থাপন করেছিলেন এবং অশ্বারোহী বাহিনীকে প্রহরায় নিযুক্ত করেছিলেন। হযরত হুসাইন (রা.)-এর প্রাণপ্রিয় আত্মীয় সহচর এবং কতিপয় অনুরক্ত অনুগামী প্রহরারত সেনা বাহিনীর একটি দলের মোকাবিলায় এসে পড়ে। তারা মাঝপথে যাত্রা বন্ধ করতে অস্বীকার করলে উবায়দুল্লাহর বাহিনী তাদের সাথে কিয়দ্দুর অগ্রসর হয়। এভাবে তারা কারবালা প্রান্তরে এসে পৌঁছেন। ভাগ্যের বিধানে এই কারবালা দশ দিন পরেই হযরত হুসাইন (রা.)-এর মৃত্যুশয্যায় পরিণত হয়। উবায়দুল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত সৈন্য বাহিনীর আবেষ্টনীতে তিনি পরিবেষ্টিত হন। উমাইয়্যা শাসনকর্তা তাকে আত্মসমর্থনে রাজি করতে অথবা বাধ্য করতে ইচ্ছা করেছিল। সুতরাং ফুরাত নদীর পানির নিকট যাওয়ার সকল পথ বন্ধ করে তিনি হযরত হুসাইন (রা.) ও তার সহযাত্রীদেরকে পিপাসায় কষ্ট দিতে বদ্ধপরিকর হলো। হযরত হুসাইন (রা.) আশা করেছিলেন যে, কুফার সে সকল সৈন্য গোপনে তার আনুগত্য স্বীকার করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে তারা হয়তো তার পক্ষ সমর্থনে এগিয়ে আসবে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। এভাবে ১০ই মহররম ৬১ হি./১০ই অক্টোবর ৬৮০ খ্রি.-এর সকাল বেলা উমর ইবনে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস কারবালা প্রান্তরে সমবেত চার হাজার উমাইয়্যা সৈন্যের সেনাপতি হযরত হুসাইন (রা.)-কে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করতে আহ্বান জানালো। হযরত হুসাইন (রা.) এতে স্বীকৃত হলেন না। ফলে, উভয় পক্ষে সংঘর্ষ বেধে গেল। হযরত হুসাইন (রা.)-এর দলীয় লোকজন আত্মরক্ষা করতে চেষ্টা করলেন। হযরত হুসাইন (রা.) শত্রু পক্ষের তীর ও তরবারির আঘাতে গুরুতর রূপে আহত হয়ে শহীদ হলেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার পবিত্র মস্তক ছেদন করা হলো। কারবালার যুদ্ধাবস্থা অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একটি উট যবেহ করতে কতটুকু সময় লাগে অথবা স্বল্প দিবা নিদ্রা যতটুকু স্থায়ী হয় মাত্র ততক্ষণ ধরে উভয় পক্ষে যুদ্ধ চলেছিল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন