শামীম চৌধুরী
চট্টগ্রাম টেস্টে হচ্ছে অভিষেক, দল ঘোষণার আগে এমন বার্তা দিয়ে রেখেছিলেন কোচ হাতুরুসিং। ভুলেও যেনো বিসিবি একাদশের শেষ ২ দিনের ম্যাচে মিরাজের হাতে তুলে না দেয়া হয় বল, ব্যাটিংয়েও যেনো পাঠানো না হয়Ñহাতুরুসিংহের এই নিদের্শনা মেনেই এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে ১৬-১৭ অক্টোবরের ম্যাচে মিরাজ বিসিবি একাদশে ছিলেন শুধুই একজন ফিল্ডার! চট্টগ্রাম টেস্টে কোচের ট্রাম্পকার্ড অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজকে লুকিয়ে রাখতেই প্রস্তুতি ম্যাচে এমন বার্তাটা ছিল হাতুরুসিংহের। ইংল্যান্ড দলে বাঁ হাতি ব্যাটসম্যানের সমাবেল বলে প্রতিপক্ষদের অচেনা এক অফ স্পিনারই হতে পারে সফরকারী দলের ঘাতক, সে বিশ্বাসেরই প্রতিফলন হাতেনাতে পেয়েছেন হাতুরুসিংহে। টসে জিতে ইংল্যান্ড নেয় ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত, তাতে বাংলাদেশকে রান চাপা দেয়ার যে শঙ্কা করেছিল যারা, ১৫ মাস পর টেস্ট প্রত্যাবর্তনে তারাই দেখল অভিষিক্ত মেহেদী হাসান মিরাজ নামের এক অফ স্পিনারের দ্যুতি! অভিষেকের প্রথমইনিংসেই তুলে নেন ৫ উইকেট, নাইমুর রহমান দুর্জয়, মুঞ্জুরুল ইসলাম রানা, মাহামুদুল্লাহ রিয়াদ, ইলিয়াস সানি, সোহাগ গাজী ও তাইজুল ইসলামের পর ৭ম বাংলাদেশি বোলার হিসেবে অভিষেকে ৫ উইকেট। তবে একটা জায়গায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন মিরাজ। বাংলাদেশী বোলারদের মধ্যে অভিষেকে সর্ব কনিষ্ঠ সফল বোলার মেহেদী হাসান মিরাজ। ১৮ বছর ৩৬১ দিন বয়সে এই কৃতিত্বপূর্ন ইতিহাস রচনা করেছেন তিনি। অভিষেকে ৫ উইকেটের ইনিংসে এতোদিন বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন সাবেক পেস বোলার মঞ্জুরুল ইসলাম, ২০০১ সালে বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৬ উইকেটের ইনিংসের দিনে বয়স ছিল তার ২১ বছর ১৬৩ দিন। জানেন, টেস্ট ইতিহাসে অভিষেকে সর্বকনিষ্ঠ সফল বোলার অস্ট্রেলিয়ার প্যাট কামিন্স (১৮ বছর ১৯৩ দিন), পাকিস্তানের শহীদ আফ্রিদি (১৮ বছর ২৩৫ দিন) ও শহীদ নাজিরের (১৮ বছর ৩১৮দিন) পর ৪র্থ সর্বকনিষ্ঠ সফল ডেব্যুটেন্ট মেহেদী হাসান মিরাজ।
সাকিবের মতো অভিজ্ঞ স্পিনার দলে থাকতে, নতুন বলে দ্বিতীয় ওভারে মিরাজের হাতে বল তুলে দিয়েই কৌশলগত লড়াইয়ে ইংল্যান্ডকে ধাক্কা দেন মুশফিকুর। ৫ম ওভারেই মিরাজ এনে দেন ব্রেক থ্রু, মিডল স্ট্যাম্পে পিচিং ডেলিভারিকে ডিফেন্স করতে যেয়ে হতভম্ব ইংলিশ টেস্ট ডেব্যুটেন্ট বেন ডাকেটের অফ স্ট্যাম্প উড়িয়ে দেন মিরাজ। তার প্রথম স্পেলটা ছিল ১০-২-১৩-২। ধুঁকতে থাকা ইংল্যান্ড প্রথম ঘন্টায় হারিয়েছে ৩ উইকেট! স্কোরশিটে ২১উঠতে ইংল্যান্ডের তিন তিনজন ব্যাটসম্যান সেই কবে ফিরেছেন, এমন বিপর্যয়ের চিত্র গত ৯ বছরে একবারই দেখেছে তারা। ২০০৭ সালে গল টেস্টে (২২/৩)! প্রতিবারই ব্রেক থ্রু এনে ইংলিশদের রানের লাগাম টেনে ধরেন মিরাজই। ৪র্থ জুটির ৬২,৬ষ্ঠ জুটির ৮৮ কিংবা ৭ম জুটিকে ৪৩এ থামিয়ে দেয়ার নায়ক তিনিই! বেয়ারস্টকে যেভাবে কুইকারে হতভম্ব করে বোল্ড আউটে ফিরিয়ে দিয়ে অভিষেক ইনিংসে ৫ম উইকেট প্রাপ্তির আনন্দে উঠেছেন মেতে, তা এক কথায় অসাধারণ।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে তোলার নায়ক অধিনায়ক মিরাজ, ২৪২ রান এবং ১২ উইকেটে আসর সেরা ক্রিকেটারের স্বীকৃতিতে উঠে এসেছিলেন লাইম লাইটে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকে প্রতীক্ষর ক্ষণ গননা শুরু সেই থেকেই। তবে অভিষেকে এমন সাফল্য নাকি কল্পনায়ও ভাবেননি। ছিল না তার উপর প্রত্যাশার চাপ, অভিষেকে গড়পড়তা পারফর্ম করতে পারলেই নাকি হতেন খুশি। টেস্ট অভিষেক দিনটিকে স্মরণীয় করে সে সত্যিই উচ্চারিত হয়েছে মিরাজের মুখেÑ ‘এ দিনটার কথা আমার সারাজীবন এ ম্যাচটি মনে থাকবে। আমার ডেব্যু ম্যাচ। আমি পাঁচ উইকেট পেয়েছি। বুঝতেই তো পাইছি। ইংল্যান্ডের সঙ্গে পাঁচ উইকেট পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের বিষয়। অভিষেকে পাঁচ উইকেট পাবো এতোটা ভাবিনি। ডেব্যুতে যেন আমি অ্যাভারেজ পারফর্ম করতে পারি, এই যেমন একটা-দু’টা উইকেট, ব্যাটিংয়ে ৩০র রান তাতেই খুশি থাকতাম। অভিষেক দিনে বোলিংয়ে কর্তৃত্ব করব, এটা ভাবিনি। চিন্তা ছিল প্রথম ম্যাচে নিজেকে সেট করব। আস্তে আস্তে জায়গায় বল করে কিভাবে নেজেকে সেট করা যায় সেই চেষ্টাই করে গেছি।’
অভিষেকে নিজেকে মেলে ধরার পেছনে বয়সভিত্তিক দলের কোচ সোহেল ইসলামের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন মেহেদী হাসান মিরাজÑ‘অনূর্ধ্ব-১৫,১৭ এবং ১৯ দলে যখন খেলেছি, তখন সোহেল স্যার ছিলেন আমাদের সহকারী কোচ। তিনি সব সময় আমাকে গাইড করছেন। সব সময় তিনি আমার সঙ্গে আলোচনা করতেন। কিভাবে উন্নতি করতে হবে, যখনই ওনার কাছে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি তা বলে দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস উনিও আমার পারফরমেন্স দেখে সন্তুষ্ট।’ ১৭তে পা দেয়ার আগেই প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে অভিষেক, জাতীয় লীগে খুলনার হয়ে খেলে গাইড পেয়েছেন বাঁ হাতি স্পিনার আবদুর রাজ্জাকের। ১২ ম্যাচে ৪১ উইকেটে ৩টি ৫ উইকেটের ইনিংসের সব ক’টিতেই লম্বা সময় বল করতে হয়েছে। প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে সাড়ে তিনশ’ উইকেট শিকারী সেই রাজ্জাকের গাইডকেও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন মিরাজÑ‘জাতীয় লীগে যখন খেলেছি, তখন রাজ ভাই (আবদুর রাজ্জাক) গাইড করেছেন। টেস্ট দলে সুযোগ পাওয়ার পর উনি আমাকে একটা কথাই বলেছেন, লংগার ভার্সনে যে জিনিসটি করেছিস আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও সেটাই করবি। বলেছেন, কোনো ভেরিয়েশন করার দরকার নেই। তুই যদি এক জায়গায় বল করে যাস, তাহলে তোর বল কেউ খেলতে পারবে না।’
নুতন বলে বোলিংয়ের দায়িত্বটা কিভাবে পালন করতে হয়, তা মিরাজের জন্য নুতন নয়। তবে ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে মিরাজের হাতে বল তুলে দিয়ে অধিনায়ক মুশফিকুরের নির্দেশ ছিল একটাইÑ ‘আমার প্রথম বলেই অনেক টার্ন করছে। মুশফিক ভাই আমাকে বারবার একটা কথাই বলেছেন, স্ট্যাম্পে বল রাখিস। স্ট্যাম্পে বল রাখলে এলবিডাব্লু, বোল্ড হওয়ার চান্স থাকবে। প্রথম ওভারটা অবশ্য বাইরে বাইরে করছিলাম। ওরা খুব সহজে বলগুলো ছেড়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয় ওভার থেকে যখন বুঝতে পারলাম যে স্ট্যাম্পে করলে ফল পাবো, তখন থেকেই স্ট্যাম্প টু স্ট্যাম্প বল করার চেষ্টা করেছি।’ ৬ষ্ঠ জুটিতে পাহাড় হয়ে দাঁড়ানো (৮৮ রান) পার্টনারশিপকে ভেঙে দিতেও মুশফিকুরের টিপসটা লেগেছে কাজে, এমনটাই জানিয়েছেনÑ‘রুট ও মঈণ আলী যে জুটি করেছে, তখন ওভার দ্যা উইকেটে বল করছিলাম। সে সময়ও মুশফিক ভাই আমাকে বলেছেন ‘তুই স্ট্যাম্পে বলটা রাখিস। যদি স্ট্যাম্পে রাখিস তাহলে অনেক সুযোগ আসবে। টাচ হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।’
সেরা ডেলিভারিতে নির্দ্দিষ্ট করে রেখেছেন বেয়ারস্ট’র উইকেটকেÑ‘সবচেয়ে ভাল লেগেছে ৫ম উইকেটটি পেয়ে। বল পড়ে সোজা ঢুকে গেছে। আমি নিজেও বুঝতে পারিনি, এমনকি সে (বেয়ারস্ট)ও বুঝতে পারেনি।’ নাইমুর রহমান, মাহামুদুল্লাহ, সোহাগ গাজী পর তৃতীয় অফ স্পিনার হিসেবে অভিষেকে ৫ উইকেট। নাইমুর, সোহাগ গাজী ক্যারিয়ার বড় করতে পারেননি, মাহামুদুল্লাহ এখন অফ স্পিন ভুলে দলে অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। তবে অফ স্পিনার পরিচয়টা মিরাজের কাছে বড়, এই পরিচয়েই ক্যারিয়ারটা বড় করতে চান।
মন্তব্য করুন