ফা রি ন সু মা ই য়া
মনের ভাব মানুষ সেই আদিমকাল থেকেই নানাভাবে প্রকাশ করে আসছে। কখনো সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে কখনো গুহার দেয়ালে নানা ছবি এঁকে বা কখনো ভাবভঙ্গিমা দিয়ে। তবে কালের বিবর্তনের সাথে সাথে মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমকে করেছে আধুনিক। বর্তমানে আমরা ঘরে বসেই মুহূর্তের মধ্য পেয়ে যাই অন্য আরেকজনের খবর। ই-মেইল, ম্যাসেজিং, ইন্টারনেট প্রযুক্তির এই সব অভাবনীয় আবিষ্কার আমাদের মনের ভাব আদান-প্রদানের পথকে করেছে আরো দ্রুততর। তবে এতে নেই সেই প্রাণের ছোঁয়া। ভালোবাসা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে লম্বা লম্বা চিঠি লেখার সময় এখন প্রায় নেই বললেই চলে। একটি চলিত কথায় আছে “বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ আর কেরে নিয়েছে আবেগ”। সময়ের বিবর্তনে আমরা নতুন জিনিস পেলেও পুরনোকে হারিয়ে ফেলা কোন যুক্তিগত সঙ্গায় পড়ে না। তবে এই হারিয়ে ফেলার ¯্রােতে হারিয়ে যাচ্ছে ডাকটিকিট। যা আমাদের ঐতিহ্যকে অনেকাংশে তুলে ধরে। এই ডাকটিকিটের ইতিহাস অনেক পুরনো। বহুকাল আগে থেকেই মানুষ চিঠি আদান-প্রদান করার জন্য ডাক ব্যবহার করত। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ২২৫ খ্রিস্টপূর্বে ডাকের ব্যবহার ছিল। সে সময়ের প্রাপ্ত একটি প্যাপিরাসে প্রথম ডাকের উল্লেখ পাওয়া যায়, যাতে লেখা ছিল দূতের নাম, প্রাপকের নাম এবং চলাচলের পথের চিহ্ন ইত্যাদি। ধীরে ধীরে এর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারদিকে। ডাকটিকিট এমন একটি মাধ্যম যার সাহায্যে আমরা ইতিহাসকে অধ্যয়ন করতে পারি বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের পিএইচডি গবেষক মীর আব্দুল্লাহ শাহনেওয়াজ। তিনি আরো বলেন, ডাকটিকিট আমাদের অনেক মূল্যবান একটি অংশ, কারণ যখন কোনো দেশে কোনো ঘটনা ঘটে তার নমুনা পাওয়া যায় একমাত্র ডাকটিকিট থেকে। তিনি বলেন, আমাদের দেশের ডাকটিকিটে এক সময়ের ছবি ছিল একটি লোক বল্লম হাতে দৌড়ে যাচ্ছে। এতে ওই সময়কার কাল, মানুষের পোশাক থেকে শুরু করে ভৌগোলিক অবস্থার একটা নমুনা পাওয়া যায়। আবার বিভিন্ন দিবস উপলক্ষেও স্মারক ডাকটিকিট বের হয়। তাছাড়া একটি দেশের শিল্প-সাহিত্য তার ক্রমবিকাশ, সামাজিক পরিবর্তন, সভ্যতার বিকাশের পরিবর্তন বোঝা যায় ডাকটিকিট থেকে। সময়ের সাথে এদের সাজালে সময়ের ঐতিহ্যের পরিবর্তন প্রকাশ করে ডাকটিকিট। ডাকটিকিটের ব্যবহার মূলত প্রথম শুরু হয় ১ লা মে ১৮৪০ থেকে। এর আগে ডাক মাশুল আদায় করা হতো চিঠির পাতার সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে এবং কত দূর চিঠি প্রেরক করা হচ্ছে তার ওপর। এই ডাক মাশুল দিতে হতো চিঠির প্রাপককে। কোনো কারণে প্রাপক সেই চিঠি না পেলে তা পুনরায় প্রেরকের কাছে ফেরত আসত এবং প্রেরককে তখন জরিমানাসহ মাশুল দিয়ে চিঠি ছাড়িয়ে নিতে হতো। অনেকেই এই ফেরত আসা চিঠি গ্রহণ করতে চাইতেন না। এক সময় বৃটিশ ডাকবিভাগে আসা চিঠির স্তূপ জমা পড়তে থাকল। এদিকে তাদের গুনতে শুরু করতে হলো লোকশান। তবে এসব ব্যাপার একজন মানুষকে ভাবিয়ে তুলে। যার নাম রোন্যাল্ড হিল। তিনি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে ১৯৩৭ সালে লিখে ফেলেন একটি পুস্তক, যার নাম চঙঝঞ ঙঋঋওঈঊ জঊঋঙজগ; ওঞঝ ওগচঙজঞঅঘঈঊ অঘউ চজঅঈঞওঈঅইওখওঞণ. বইটি প্রকাশের পর ব্যাপক জনমত সাড়া পাওয়া যায়। তিনি এতে প্রস্তাব রাখেন, যে চিঠি লিখবে তিনি ডাকমাশুল পরিশোধ করবে। অবশেষে জনমত এবং রোন্যাল্ড হিল এর চেষ্টায় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ডাকটিকিট প্রকাশের জন্য অনুমোদন দান করেন। এরপর ডাকটিকিটের নকশার জন্য আহ্বান করা হয়। দেখা যায় এতে প্রচুর সাড়া পাওয়া যায়। প্রায় ২৫০০ নকশা জমা পড়ে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এত বিপুল সংখ্যক নকশা থেকেও ডাকবিভাগের একটিও পছন্দ হয়নি। অবশেষে ডাকা হয় রোন্যাল্ড হেনরিকে। তিনি এবং চার্লস, ফ্রেডরিক হিথ রানী ভিক্টোরিয়ার ছবি খোদাই করা মডেল তৈরি করেন।
এই ডাকটিকিটের মাথায় মাঝখানে ছিল রানী ভিক্টোরিয়ার মাথার ছবি এবং উপরে বড় করে লেখা ছিল চঙঝঞঅএঊ এবং নিচে লেখা ছিল ঙঘঊ চঊঘঘণ.
এই ডাকটিকিটে কোনো দেশের নাম উল্লেখ ছিল না। কারণ তখন আর কোনো দেশই ডাকটিকিট ব্যবহার করত না। অবশেষে ডাকটিকিট ছাপানোর দায়িত্ব পায় বিখ্যাত প্রেস মেসার্স পারকিন্স বেকন অ্যান্ড কোম্পানি। ১১ এপ্রিল ১৮৪০ সালে তারা ডাকটিকিট ছাপানোর দায়িত্ব পায়। তারা ১ পেনি ও ২ পেনি মূল্যমানের ডাকটিকিট ছাপানোর দায়িত্ব পায়। ১ লা মে ১৮৪০ সালে ডাকটিকিট সরবরাহ করে। ১ পেনির ডাকটিকিটকে ডাকা হতো পেনি ব্লাক, কারণ এক পেনির ডাকটিকিট ছিল কালো রঙের। আর দুই পেনি ডাকটিকিটকে ডাকা হত পেনি ব্লু নামে, কারণ এটি ছিল নীল রঙের।
বাংলাদেশে প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের ২৯ তারিখ। এ সময় ৮টি ডাকটিকিট প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ডাকটিকিট ছাপানো শুরু হয়। ডাকটিকিটগুলো প্রকাশিত হয় লন্ডনের ফরম্যাট ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে। সে সময় মুদ্রিত ডাকটিকিটগুলোর মূল্যমান ছিল ১০ পয়সা, ২০ পয়সা, ৫০ পয়সা, ১.০০ রুপি, ২.০০ রুপি, ৩.০০ রুপি। এই ডাকটিকিটগুলোর নকশা প্রণয়ন করেন বিমান মল্লিক।
এ ছাড়া উপমহাদেশে প্রথম ডাকটিকিট চালু হয় ১৮৫২ থেকে। পাকিস্তানে প্রথম ডাকটিকিট চালু হয় ১৯৪৮ সালে।
ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এসব প্রসঙ্গে যেমন ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছে, তেমন স্মরণীয় ব্যক্তি যেমনÑ শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, এমএজি ওসমানী, আব্দুল হামিদ খান, এ কে ফজলুল হকসহ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়েও ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রকৃতি, প্রতœতত্ত্ব, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আর উৎসব নিয়ে ডাক টিকিট প্রকাশিত হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন