মনির হোসেন শিমুল
‘আনন্দ-বেদনা আর পাওয়া-না পাওয়ার মানব জীবনের শেষ অধ্যায় হলো প্রৌঢ় বা প্রবীণ বয়স। প্রবীণ মানে শুধু বেশি বয়সী ব্যক্তি বা বৃদ্ধ বুঝায় না। শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়লেও এই প্রবীণদের সঞ্চিত পরিপক্ব অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞতা ও দিকনির্দেশনাই পরবর্তী প্রজন্ম তথা পরবর্তী পৃথিবীর উত্তরণের পথ দেখায়।’ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আয়োজিত আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী ও মানব সম্পদ উন্নয়ের নির্বাহী পরিচালক ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য শ্রীমতী সন্ধ্যা রায়।
পহেলা অক্টোবর ছিল আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় প্রতি বছরের এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যথাযথ আনুষ্ঠানিকতায় এইবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘বয়স বৈষম্য নিরসন করুন’। জাতিসংঘ অনুযায়ী, ৬০ বছর বয়সী মানুষকে প্রবীণ হিসেবে গণ্য করা হয়। আদমশুমারি মতে, বাংলাদেশের বর্তমান ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক ব্যক্তির সংখ্যা শতকরা প্রায় ৬ ভাগ অর্থাৎ আনুমানিক ৯০ লাখ। আধুনিক চিকিৎসার সুবিধা, খাদ্যাভাস পরিবর্তন এবং সচেতনতার ফলে দেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, বয়স্কদের মৃত্যুহার একদিকে যেমন কমেছে অন্যদিকে গড়আয়ুও বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০৩০ সালে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ হবে প্রবীণ। ২০৪৪ সালে যা কমবয়সী জনগোষ্ঠীকে ছাড়িয়ে যাবে। ‘প্রবীণদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের থেকে পাওয়া ভালোবাসা প্রয়োজনের সময় তাদের দিতে হবে। রাখতে হবে তাদের স্বাস্থ্য, মানসিক ও পারিপার্শ্বিক বিষয়ের খবরাখবর। নতুন প্রজন্মের এই শিক্ষক-অভিভাবক, পথের দিশারীদের অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে জাতিকে তথা দেশকে।’ বলছিলেন সিনিয়র স্বাস্থ্য কর্মী রেজিয়া আক্তার।
সময়ের সাথে নগরায়ন, শিল্পায়ন, চাকুরীগত কারণে বাঙালির ঐতিহ্যম-িত যৌথ পারিবারিক ব্যবস্থা এখন আর নেই। সামাজিক মূল্যবোধের কিছু ফাটলের কারণে কারো বাবা-মায়ের জায়গা হচ্ছে ঘরের বাহিরে। আর কেউ তাদের আশ্রয়ে আপন মূল্যবোধের তাগিদে তৈরি করছে বৃদ্ধাশ্রম। হিসেব অনুযায়ী যেখানে আশ্রয় প্রার্থীদের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত আর্থিক অসচ্ছলতার কারণেই প্রবীণরা পরিবারে ও সমাজে উপেক্ষা, অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হন। ‘কারণ এই বয়সে তাদের যতœ নেওয়াকে অনেকে বড় সমস্যা মনে করে। বোঝা হিসেবে বিবেচিত করায় কখনো কখনো ভিক্ষাবৃত্তি বা অন্যের করুণার পাত্র হয়ে বাকিজীবন অতিবাহিত করতে হয়।’ কান্না ভেজা গলায় কথাগুলো বলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালের ইনচার্জ আফরোজা জাহান। ‘যে সন্তানের মঙ্গল কামনায় পিতা-মাতা তাদের জীবনকে প্রৌঢ়ত্বে নিয়ে এসেছেন, আজ তাদের থেকে অধিকার আদায়ের জন্য সরকারকে আইন করতে হচ্ছে। প্রতি বছর বয়স্কভাতা প্রার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। প্রবীণদের প্রাপ্য ভালোবাসা, সম্মান আজ করুণায় রুপ নিয়েছে। প্রকৃতির নিয়মে একদিন এই সন্তানরা প্রবীণ হবে। তাই পরবর্তী প্রজন্মকে শেখাতে, সম্মান পেতে নিজেদের প্রবীণদের প্রতি সহনশীল হওয়া জরুরি।’ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রশিক্ষক সিরিয়া খানম কথাগুলো বলে আরো যোগ করেন, প্রবীণ মানুষগুলোর সুস্থজীবন যাপনের জন্য তাদের বার্ধক্যকে সম্মানজনকভাবে কাটানোর ব্যবস্থা করা প্রতিটি সন্তানদের দায়িত্ব হওয়া উচিত। কারণ তাদের বাদ দিয়ে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
সামাজিক সম্মানবোধ ও মানব মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে, করুণা করে নয় বরং ভালোবাসা আর সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই সকল সন্তান তথা দায়িত্বপ্রাপ্তদের তাদের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। অধিকারের প্রশ্নে নয় বরং তাদের জীবনের শেষভাগ যেন সফল, সার্থক, স্বাচ্ছন্দ্যময় ও আপনজনের সান্নিধ্যে কাটে তা নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হতে হবে। কারো জীবনের শেষ সময়টা যেন পরিবারহীন বৃদ্ধাশ্রমে না কাটে। আজ যাদের প্রবীণ বলা হচ্ছে, তাদের জীবনে আমরাও একদিন প্রবেশ করবো। আজকের সন্তান আগামী দিনের পিতা বা মাতা হবে। তাদের জগত আমাদের দেখানো পথেই চলবে। বৃদ্ধাশ্রম যেন কোন বাবা-মায়ের শেষ বয়সের ঠিকানা না হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন