প্রতি বছরের মতো কোটি কোটি টাকার লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে এবারও নাটোর, জয়পুরহাটসহ দেশের ১৫টির মধ্যে ৯টি চিনিকলে শুরু হয়েছে মাড়াই মৌসুম। দেশে বছরে ১৮ লাখ মেট্রিক টন চিনির চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয় মাত্র ৮০ হাজার মেট্রিক টন। শুধু পবিত্র রমজান মাসেই চিনির চাহিদা হচ্ছে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ মেট্রিক টন।
কৃষি গবেষণা কর্মকর্তাদের মতে, সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কৃষকদের আখ চাষে উদ্যোগী করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এটি করা সম্ভব হলে প্রতি বছর ১৭ লাখ মেট্রিক টনের বেশি চিনি আমদানি করে মূল্যবান যে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করা হচ্ছে তা সাশ্রয় হবে। একই সাথে দেশে চিনি ও গুড়শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে দেশের চিনি শিল্পের প্রসারে তেমন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আখ চাষ করে কৃষকরা লোকসান দিলেও তাদের দিকে সংশ্লিষ্টরা ফিরে তাকায়নি। যে কারনে দেশ এখনো প্রায় ৯৫ শতাংশ চিনি আমদানি নির্ভরতা থেকে বের হতে পারেনি।
দেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে উৎপাদনের চাকা বন্ধ হয়ে গেছে ৬টি মিলের। অপর ৯টি চিনিকলের মধ্যে চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় কেরু অ্যান্ড কোম্পানি নামের সবচেয়ে বড় চিনিকলটি ছাড়া অন্যান্যগুলো লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়েই আখমাড়াইয়ের কাজ করছে। গত বছরের ডিসেম্বরেই ৯টি চিনিকলে পৃথকভাবে শুরু হয়েছে আখমাড়াইয়ের কাজ।
চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের সূত্র জানায়, তাদের কাছে থাকা রেকর্ডপত্র বলছে দেশে বর্তমানে বার্ষিক চিনির চাহিদা ১৮ লাখ মেট্রিক টন। এরমধ্যে পবিত্র রমজান মাসেই চাহিদা থাকে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু ১৮ লাখ মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে দেশের চিনিকলগুলোতে বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে মাত্র ৮০ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ বছরে চিনির ঘাটতি হচ্ছে ১৭ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন।
কয়েকটি চিনিকলের সাথে সংশ্লিষ্ট এমন কয়েকজন জানান, ইচ্ছে করেই চিনির ক্ষেত্রে দেশকে পুরোপুরি আমদানিনির্ভর রাখা হয়েছে। বর্তমানে কয়েকজন শিল্পপতি চিনি রিফাইনারি প্রতিষ্ঠা করে বিদেশ থেকে ক্রুড আমদানি করেন। আর সেগুলো রিফাইন করেই তারা বাজারজাত করছে। দেশের চিনিকলগুলোকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় এনে আধুনিকায়ন করার কোন পদক্ষেপ না নিয়ে সেগুলোর মাথায় পরিকল্পিতভাবে লোকসানের বোঝা চাপিয়ে শ্বেতহস্তী বানানোর চক্রান্ত চলছে বলে চিনিকল শ্রমিক নেতারা মনে করেন।
ইতিহাস বলছে, বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলেই উত্তরাঞ্চলে সেই সময়কার সর্বাধুনিক অ্যাডভান্স টেকনোলজি দিয়ে স্থাপন করা হয় চিনিকল। জমির সীমাবদ্ধতা না থাকায় সুপরিসর জায়গায় কারখানাগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৩৩ সালে দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ এবং নাটোরের লালপুরে দুটি বৃহত্তম চিনিকল প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই হিসেবে চিনিকল হচ্ছে এদেশের প্রাচীন শিল্পগুলোর অন্যতম।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ৫০ থেকে ৬০ দশকজুড়ে সীমান্ত এলাকাগুলোতে চিনি ও পাটকল প্রতিষ্ঠা করা হয়। সীমান্ত এলাকায় পাট ও চিনিকল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই ছিল ভারতে আখ ও পাটের পাচার নিরুৎসাহিত করা। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন অজুহাতে পাটকলগুলো বেসরকারিকরনের মাধ্যমে পাটের বারোটা বাজানো হয়। তবে চিনিকলে ট্রেড ইউনিয়নগুলোর তৎপরতার কারনে সরকারি চিনিকলগুলো এখনো টিকে আছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। তবে মাথাভারি প্রশাসন, দুর্নীতি ও অবব্যবস্থাপনার কারনে চিনিকলগুলোর দেনার পরিমাণ এখন হাজার কোটি টাকা। আর এই দেনার অযুহাতে চিনিকলগুলো বেসরকারি পর্যায়ে ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চিনির বাইপ্রডাক্ট মোলাসেস ব্যবহার করে স্পিরিট ও সার উৎপাদন করলে প্রত্যেকটি চিনিকলকে লাভজনক করা সম্ভব। এদিকে কৃষি বিভাগ সূত্র বলছে, মোটামুটি সারাদেশই আখচাষের উপযোগী হলেও এই খাতে প্রনোদনা প্রদানসহ অন্যান্য সহায়তা কার্যক্রম নামমাত্র। বর্তমানে দেশের মোট ১৩টি কৃষি অঞ্চলে চলতি অর্থবছরে মাত্র ২৭ হাজার ১১৮ হেক্টর জমিতে আখ চাষ হয়েছে। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৬ লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন।
এর পাশাপাশি অবশ্য মিলজোন এলাকাতেও পৃথকভাবে আখ চাষ হয়েছে। ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট (ঈশ্বরদী) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হাসিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি গবেষণা প্রসঙ্গে তেমন কোন অগ্রগতির তথ্য দিতে পারেননি। তবে তিনি বলেন, মুখে খাওয়ার আখের একাধিক জাত তারা উদ্ভাবন করেছেন। যার একটির নাম ‘রঙ্গীলা’। অপরদিকে একাধিক কৃষি গবেষণা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পরিকল্পনা করে আখচাষে উদ্যোগী হলে দেশে চিনি ও গুড়শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। কমবে আমদানি নির্ভরতা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন