এ বি সিদ্দিক
চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণহীন। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়, আবার কোথাও ৭৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ব চিনি শিল্প “বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের” উৎপাদিত প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। বেসরকারি পরিশোধিত চিনি কলের মালিক ও আমদানিকারকরা মূলত চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। বর্তমানে আমদানিকৃত পরিশোধনকারী প্রতিকেজি চিনির দাম পড়ছে (সরকারের ট্যাক্স সহ) ৪৯ টাকা আর বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়। প্রতিকেজি চিনিতে মুনাফা ২৫ থেকে ৩০ টাকা। দেশের বাজারে চিনির দাম ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দাম বাড়ার কারণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেও সুস্পষ্ট যুক্তি দেখাতে পারছেন না। ব্যবসায়ীদের কেউ বলছেন, সিন্ডিকেটের কারণে দাম বেড়েছে, কেউ উৎপাদনে ঘাটতির কথা বলছেন, আবার কেউ বা আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দর বৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করছেন। তবে ভোক্তাদের অভিযোগ, মুনাফালোভী মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরাই কারসাজি করে চিনির দাম বাড়িয়েছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বছরে দেশে চিনির চাহিদা ১৫ লাখ টন। এর মধ্যে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের মিলগুলো বছরে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন চিনি উৎপাদন করে। বাকিটা বেসরকারি চিনি কলে উৎপাদন ও আমদানি হয়ে থাকে। প্রায় ১১ লাখ টন চিনি উৎপাদন করে বেসরকারি পরিশোধনকারী মিল মালিকরা।
আবার আমদানি করা মিহি দানার সাদা চিনির ক্ষতিকর উপাদান নিয়ে উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছে খাদ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশীয় আখের চিনির পরিবর্তে আমদানি করা চিনিতে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে অনেক বেশি মাত্রায়। তাই আমদানি করা এই চিনিকে বিষের সাথে তুলনা করে তা না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্বখ্যাত চিকিৎসকগণ। আমদানিকৃত অপরিশোধিত চিনি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিধায় এনিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইতোমধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এই চিনির বিকল্প তালাশ করছে পশ্চিমাবিশ্বের উন্নত দেশগুলো। যেসব দেশে আখের চিনি উৎপাদনের ব্যবস্থা নেই সে সব দেশ বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে স্টিভিয়া। বাংলাদেশে আখের চিনি (বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার অধীনস্থ চিনি কলের উৎপাদিত চিনি) থাকলেও ভোক্তা সাধারণ আমদানিকৃত চিনির প্রতি বেশি আগ্রহী। যার সুযোগটা নিচ্ছেন আমদানিকারকরা। এছাড়া সঠিকভাবে এই চিনি পরিপাক না হওয়ায় কার্বোহাইড্রেড রাসায়নিক রূপান্তর হয়ে বিষাক্ত কার্বন পরমাণু সম্বলিত অস্বাভাবিক চিনি ও পাইরোভিক এসিড তৈরি করে। এই পাইরোভিক এসিড মস্তিষ্ক ও ¯œায়ুতন্ত্রে জমা হয়। তাছাড়া রক্তের লোহিত কণিকায় অস্বাভাবিক চিনি জমাট বাঁধে। দেহকোষে টক্সিক এসিড নানা পার্শ¦প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ফলে এ কোষগুলো সতেজ থেকে স্বাভাবিক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পায় না। এক সময় এ কোষগুলো মারা যায়। ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশের কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হয়ে নানাবিধ জঠিল রোগের জন্ম দেয়। অপরদিকে আখের চিনিতে কার্বোহাইড্রেড পরিপাক করার জন্য প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলস পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ থাকে।
খাদ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট তার গবেষণায় বলেছে, আখের চিনিতে ক্যালসিয়াম প্রতি ১০০ কিলোগ্রামে ১৬০.৩২ মিলিগ্রাম আর আমদানিকৃত চিনিতে ১.৫৬ থেকে ২.৬৫ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম আখের চিনিতে ১৪২.০৯ আর আর আমদানিকৃত চিনিতে ০.৩২ থেকে ০.৩৫ মিলিগ্রাম, ফসফরাস আখের চিনিতে ২.০৫ থেকে ১০.৭৯ মিলিগ্রাম আর আমদানিকৃত চিনিতে ২.৩৬ থেকে ২.৩৫ মিলিগ্রাম, আয়রণ আখের চিনিতে ০.৪২ থেকে ৬ মিলিগ্রাম আর আমদানিকৃত চিনিতে ০.৪৭ থেকে ০.৮২ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেশিয়াম আখের চিনিতে ০.১৫ থেকে ৩.৮৬ মিলিগ্রাম আর আমদানিকৃত চিনিতে ০.৬৬ থেকে ১.২১ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম আখের চিনিতে ০.০৬ থেকে ০.০৭ মিলিগ্রাম আর আমদানিকৃত চিনিতে ০.০২ থেকে ০.০৩ মিলিগ্রাম। বিশ্বের যসব দেশে আখের চিনি উৎপাদন হয় না সেসব দেশে এখন স্টিভিয়ার ব্যবহার শুরু হয়েছে।
বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ব চিনিকল চালু আছে ১৫টি। এই ১৫টি চিনিকল যদি পর্যাপ্ত কাঁচা মাল পায় তবে দেশের চাহিদার পুরোটাই মেটাতে সক্ষম। কিন্তু কাঁচা মাল আখের সংকটের কারণে চিনিকলগুলো বেশি দিন চলে না বা চালু রাখা সম্ভব হয় না। অপরদিকে আবার রংপুর চিনি কলের প্রায় সাড়ে ১৮ শত একর আখ চাষের খামারি জমি স্থানীয় সাওতাল সম্প্রদায় ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দখল করে নিচ্ছে। এতে চিনিকলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে।
চিনির অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে রাষ্ট্রায়ত্ব চিনি শিল্পকে প্রাধান্য দিতে হবে। বাড়াতে হবে আখের উৎপাদন, প্রয়োজনে বিকল্প কাঁচামাল বিটের চাষ শুরু করতে হবে। আর বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে চিনি শিল্প করপোরেশনের মাধ্যমেই চিনি আমদানি করতে হবে। যেমন, বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প করপোরেশন সার উৎপাদনের পাশাপাশি আমদানির দায়িত্বও পালন করছে। যার ফলে সার নিয়ে কোন কারসাজি নেই। বর্তমানে দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা প্রায় ২৩ লাখ টন। এর মধ্যে বিসিআইসি’র কারখানাগুলো ৯ থেকে সাড়ে ৯ লাখ টন উৎপাদন করে থাকে। যদিও কারখানাগুলো চাহিদার সিংহভাগ উৎপাদনে সক্ষম, কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। বিসিআইসি ইউরিয়া আমদানি করে তাদের তালিকাভুক্ত ডিলারদের মাধ্যমে চাষিদের মধ্যে সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করায় বাজার নিয়ন্ত্রণে আছে বা থাকে। তেমনি চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন যদি চিনি আমদানি করে তাদের তালিকাভুক্ত ডিলারদের মাধ্যমে বা খোলা বাজারে বিক্রি করে তা হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তখন বেসরকারি মিল মালিক বা আমদানিকারকরা সিন্ডিকেট করে ৪০ টাকার চিনি ৭০ টাকা বিক্রি করে কেজিতে ৩০ টাকা মুনাফা করতে পারবে না।
লেখক : সাংবাদিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন