মহামারি করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন দিন দিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওমিক্রনের সংক্রমণে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। আবারও ভিড় বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে। ওমিক্রন সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দিলেও কেউ মানছে না। ফুটপাথ, টং দোকান, হাটবাজার, কাঁচাবাজার, শপিংমল, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, গণপরিবহণ, বাসস্ট্যান্ড কোথাও কেউ মানছে না স্বাস্থ্যবিধি।
রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, অফিস-আদালতসহ কোথাও এখন স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। বাস, লঞ্চ ও রেলে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ও মাস্ক ব্যবহারে উদাসীন অনেক যাত্রী। বেশিরভাগ পথচারীর মুখে মাস্ক নেই। কেউ কেউ মুখের থুতনিতে মাস্ক নামিয়ে চলাফেরা করছেন। অধিকাংশ গণপরিবহন আসনের অতিরিক্ত যাত্রী দাঁড়িয়ে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর কোনও তৎপরতা লক্ষ করা যায় না।
স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতার কারণেই করোনা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্ত ভেঙে চলাফেরার যেন প্রতিযোগিতা চলছে। এমন চলতে থাকলে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্যবিধি মানতে জনসচেতনতারও ব্যাপক ঘটতি রয়েছে বলে মনে করছেন তারা। করোনা শুধু স্বাস্থ্যগত বিষয় নয়, এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, যোগাযোগ, ধর্ম, বাণিজ্য অর্থাৎ জীবনের সব কিছুকে ঘিরে রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে উদাসীনতা, করোনাসংক্রান্ত বিষয়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে সমন্বয়হীনতা, লোকজনের স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা, স্বাস্থ্যবিধি মানানোর ব্যাপারেও তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করাসহ নানাবিধ কারণ এ জন্য দায়ী। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যপারে আরও কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের নজরাদারি বাড়ানোর পরামর্শ তাদের।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে তার খেসারত দিতে হবে। বাস্তবায়ন যারা করছেন না, তাদের কারণে দেশে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সরকারি নির্দেশনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করেনি তাদের নিতে হবে। নিরাপদ থাকতে টিকা গ্রহণ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত। অফিস-আদালত, বাজার-ঘাট, যানবাহনে চলাচল, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট, বাস, ট্রেন, মসজিদ- সব জায়গাতেই মাস্ক পরার নির্দেশনা আছে। কিন্তু বাস্তবে তা মানছেন খুব কম লোকই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রফেসর ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে সর্বত্রই গা-ছাড়া ভাব বিপদ ডেকে আনবে। জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। নইলে তারাও নিরাপদ থাকতে পারবে না।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারগুলোতে দেখা যায়, ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়। কেউ থুতনিতে মাস্ক লাগিয়ে ঘুরছেন। কারও হাতে, অনেকের মাস্কই নেই। ভিড়ে ধুলায় একাকার পরিস্থিতি। গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে কেনাকাটা করছেন অনেকে। এর মধ্যেই হাঁচি, কাশি, থুথু ফেলছেন অনবরত।
মতিঝিল কলোনী বাজারে আসা এক ক্রেতা শাহীন বলেন, কেউই মাস্ক পরে না, তাই আমিও পরি না। মাস্ক ছাড়াই ঘোরাফেরা করছে মানুষ। আর বাজারে কোনভাবেই স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দাঁড়িয়ে থাকলে বাজার করা হবে না। আমি একা মানলে কি হবে। অন্য কোন ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ মানে না।
এদিকে গণপরিবহনসহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, গণপরিবহনে উঠতে গিয়ে লোকজন হুড়োহুড়ি করছেন। একে অন্যের গায়ের ওপর গিয়ে উঠছেন। অধিকাংশ মানুষের মুখে মাস্ক নেই। নিয়ম মেনে খুব কম লোকই মাস্ক ব্যবহার করছেন। বাসে ওঠার আগে যাত্রীদের হাতে জীবাণুনাশক দিতেও দেখা যায়নি। গণপরিবহনে অতিরিক্ত যাত্রী বহন এবং স্বাস্থ্যবিধি না মানার বিষয়ে যাত্রী, বাস চালক ও হেলপাররা করেছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে।
কমলাপুর স্টেশন এলাকায় যাত্রীদের মাস্ক ছাড়া স্টেশনে প্রবেশ করতে দেয়া না হলেও বাইরের রাস্তায় মানুষের গাদাগাদি চলাচল। স্টেশনের বাইরের রাস্তায় রিকশার জট ও ছিন্নমূল মানুষের আড্ডার স্থানে পরিণত হয়েছে। একই চিত্র সদরঘাটে, নদী টার্মিনালে আসা বা ছেড়ে যাওয়া প্রায় সব লঞ্চের যাত্রীদের। অনেকে স্টেশন বা টার্মিনাল থেকে বের হয়েই মাস্ক খুলে পকেটে রেখে দিচ্ছেন। এরপর ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠছেন। কোন স্টেশনেই প্রবেশের সময় হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক ব্যবহারের দৃশ্য চোখে পড়ে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি এখন কারো মনেই নেই।
পল্টন এলাকায় ভিক্টর পরিবহনের যাত্রী আশিক বলেন, এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে আমরা চলাচল করছি। পরিপূর্ণভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাসে চলাচল করা যায় না। আর চালক ও হেলপাররা কোন ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। যাত্রীবাহী কোন বাসেই এখন আর জীবাণুনাশক রাখা হচ্ছে না।
সাধারণ যাত্রীদের কথা কেউই বিবেচনা করে না। স্বাস্থ্যবিধি পরিপূর্ণভাবে পরিপালনে সরকারের কোন নজরদারি নেই। কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে করোনা মহামারি আরও ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবেই এসব কথা বলেছেন, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী
রাজধানীর বেশিরভাগ হোটেল-রেস্তোরাঁয় স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। ক্রেতা-বিক্রেতাদেরও এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়া হলেও মানা হচ্ছে না তা। খাবার গ্রহীতাদের মধ্যে অনেকে মাস্ক পরে ঢুকলেও কারও কাছেই টিকা সনদ দেখতে চাইছেন না ম্যানেজার বা খাবার সরবরাহকারীরা। এমনকি যারা খাচ্ছেন তাদেরও কারও কাছেই টিকা সনদ নেই। এ নির্দেশনা কেবল কাগজেই। পালন করছে না কেউ।
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, করোনা মহামারি শুরুর আগে দেশে ৬০ হাজার রেস্তোরাঁ ছিল। এখন সে সংখ্যা ৫০ হাজারে নেমে এসেছে। মহামারি করোনার কারণে সাধারণ ছুটি ও লকডাউনে কয়েক দফায় ব্যবসা বন্ধ থাকায় এ পর্যন্ত ৩০ শতাংশ হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে। একই সময়ে আর্থিক সঙ্কটে ৫০ শতাংশ হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিকানা বদল হয়েছে। আর ক্ষতি হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা।
রাজিব নামের খাবারের এক ক্রেতা বলেন, হোটেল-রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে হলে টিকা সনদ দেখাতে হবে এটা এখনো প্রচলন হয়নি। আমরা এখানে খেতে এসেছি আমাদের কাছে কেউ টিকা সনদ দেখতে চায়নি। আর আমার কাছে টিকা সনদ নেই। বিষয়টি নিয়ে কোন কড়াকড়িও নেই। যে যার মতো আসছে, আর আড্ডা দিচ্ছে, খাবার খাচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন