শুক্রবার, ২৪ মে ২০২৪, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের বড় অংশই বেকার

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১:৪০ পিএম

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে একটা বড় অংশই এখন বেকার। পড়াশোনা শেষ করে বছরের পর বছর চাকরির জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। সম্প্রতি একজন তরুণ 'ভাতের বিনিময়ে পড়ানোর বিজ্ঞাপন' দেয়ার পর করোনা মহামারিতে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি কতটা সংকট তৈরি করতে পারে - তার একটা নিদর্শন হিসেবে সামনে এসেছে।

বেকারত্বের হতাশা আর এ সংকট যে এখন কতটা মারাত্মক - সেটি উঠে এল উচ্চশিক্ষিত এক তরুণীর অভিজ্ঞতায়। নাম পরিচয় গোপন রেখে এই ইংরেজিতে মাস্টার্স পাশ একজন তরুণী জানান, পড়াশোনা শেষ করতেই তার আটাশ বছর বয়স হয়ে যায়। সরকারি চাকরির বয়স ত্রিশ বছরের মধ্যে একটি বিসিএস এবং ২০টির মতো সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করেন। কিন্তু মহামারির মধ্যে চাকরির পরীক্ষা বন্ধ থাকা আর বয়স শেষ হবার দুশ্চিন্তায় পেয়ে বসে তাকে।

পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলে একই দিনে ৫টি চাকরির লিখিত পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত হয়, দুটি পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। এছাড়া দুএকটি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ আসে। সবমিলিয়ে বেকারত্বের এই হতাশা থেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি।

চাকরি প্রত্যাশী এই তরুণী বলেন, "বয়সের সীমাবদ্ধতার কারণে আমি আশা নিয়ে বাঁচতে পারছি না যে সামনে পড়াশোনা করবো, করে এটা হয়নি অন্যটা হবে এরকমও হচ্ছে না। একাধিক পরীক্ষা, তারওপরে দুর্নীতির কারণে প্রশ্ন আউট হচ্ছে।"

"বিভিন্ন কারণে আসলে আমি অনেকটা হতাশ হয়েই আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলাম। আসলে খুব বিষণ্ন। আমি এখন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে ওষুধ নিচ্ছি।"

এখনো একটা চাকরি জন্য অপেক্ষা করছেন এই তরুণী।

কেন অন্য পেশা, আত্মকর্মসংস্থানের চেষ্টা নয় এ প্রশ্নে তিনি বলেন, "এটার জন্য একটা মানসিক প্রস্তুতি লাগে। আর্থিক সমর্থন লাগে।"

"আমি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে গিয়েছিলাম। সেখানে মাত্র ষাট হাজার টাকা দেবে, কিন্তু সেই টাকা উত্তোলনের জন্য যে ধরনের কাগজপত্র বা ফর্মালিটিজ লাগে সেটাও আমাকে সাপোর্ট করছে না। যেমন জমির দলিল লাগবে, কিন্তু এখনো আমি সম্পত্তির মালিক হয়নি। আমার বিয়ে হয়নি। অন্য কিছু যে করবো আমার সেই সোর্সটাও বন্ধ হয়ে গেছে।"

ধারণা করা হয়, দেশে প্রতিবছর ২০ লাখের বেশি জনশক্তি শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। যেখানে কর্মসংস্থানের মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি খাতে আর ৯৫ শতাংশই বেসরাকারি উৎসে।

কিন্তু উচ্চশিক্ষা সামাপ্ত করে বেশিরভাগই এখন সরকারি চাকরির জন্য অপেক্ষা করেন বছরের পর বছর। একাধিক বিসিএস এবং সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে অনেকের মধ্যে হতাশা তৈরি হয় কারণ যে পরিমাণ চাকরি প্রত্যাশী তার তুলনায় চাকরির সুযোগ নেই।

চাকরি প্রত্যাশী একজন ফয়সাল মাহামুদ বলেন, "আপনি যদি লক্ষ্য করেন ওইভাবে কিন্তু বিষয়ভিত্তিক চাকরি নাই। আলটিমেটলি সবাই বিসিএস এর চেষ্টা করে। বিসিএস যখন না হয় তখন ব্যাংকে বা অন্যান্য সেক্টরে চেষ্টা করে। যাদের ত্রিশ বছরের পরে হচ্ছে না ওরা তখন অন্য দিকে মুভ করে।"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা হাফিজা খানম বলেন, "যতদিন না চাকরি না হয়, ততদিন পর্যন্ত চেষ্টা করতে হয় আর বিসিএসএর ব্যাপারটা হচ্ছে দীর্ঘসূত্রিতা রয়েছে। সাড়ে তিন চার বছর লেগে যায় একটা বিসিএস শেষ করতে।"

আরেকজন চাকরি প্রত্যাশী শারমিন আক্তার বলেন, "যাদের বয়স অল্প সময় আছে, তারা এত বেশি হতাশ যে তারা অন্য কিছু চেষ্টা করবে সেই শক্তিটাই তাদের মধ্যে আর থাকে না।"

চাকরির চেষ্টা করতে 'বাধ্য' তারা?
এই তরুণ-তরুণীরা স্বীকার করেন যে বছরের পর বছর ধরে চাকরি জন্য অপেক্ষা তাদের কর্মদক্ষতা সৃজনশীলতা নষ্ট হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা বাস্তবতা এবং পরিস্থিতির শিকার।

আবু সাইদ নামের একজন বলছিলেন, "সবাই বুঝি যে এভাবে আমরা একদিকে দৌড়াবো চাকরির দিকে এটা ঠিক না। কিন্তু আসলে আমাদের সমাজকাঠামোটাই এমন যে আমরা বাধ্য। আমরা যেন বুঝেও না বোঝার ভান করে আমরা একদিকে দৌড়াচ্ছি। "

এ ব্যাপারে হাফিজা বলেন, "ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনার চেয়ে এখানে সামাজিক এবং পারিবারিক চাহিদাকে প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টাই মূলত এখনকার জেনারেশনে আমরা যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করি তাদের এই চিন্তাভাবনা নিয়েই আগাতে হচ্ছে আমাদের।"

উচ্চশিক্ষিত বেকার ছেলে মেয়েরা কেউ কেউ পরিবার থেকে টাকা পয়সা নিয়ে চলেন। অনেকে টিউশনি কিংবা পার্টটাইম কাজ করে হাত খরচ মেটান। গৃহশিক্ষকতা করার পেছনে অনেকেরই যুক্তি তারা এর মাধ্যমে পড়াশোনার চর্চার মধ্যেই থাকতে পারেন বিধায় এতে আগ্রহ বেশি।

তবে শিক্ষাজীবনেই কাজে ছোট-খাট কাজে ঢুকে পড়া কিংবা আত্মকর্মসংস্থানের পথ বেছে না নিয়ে শুধু চাকরিই করতে হবে এবং তার জন্য দীর্ঘ সময় নষ্ট করার মানসিকতা কেন - সে প্রশ্ন রয়েছে।

এ বিষয়ে আবু সাইদ বলেন, "আমি যদি ছোট একটা জব করি তাহলে আমার পরিবার কী বলবে, আমার আশেপাশের বন্ধুবান্ধব কী বলবে?"

"এই যে ভাবনাটা এবং তারা যে আমাদের আসলেই নেগলেক্ট [অবহেলা] করবে এই চিন্তা থেকেই আমরা যে অসুস্থ্য একটা ধারা- চাকরির পেছনে চার-পাঁচ বছর লেগে থাকা এদিকেই সবাই আছে।"

সব উচ্চ শিক্ষিতদের জন্য চাকরির সুযোগ নেই?
সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে প্রতিবছর কয়েক লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী পাশ করে বের হন। কিন্তু এত শিক্ষার্থীর জন্য চাকরির সুযোগ নেই এটি বাস্তবতা।

বিআইডিএস এর এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৩৪ শতাংশ আর স্নাতক পর্যায়ে এই হার ৩৭ শতাংশের মত।

মহামারির আগে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে ‌উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এ বছর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশীয় প্রশান্ত অঞ্চলে মহামারির আগের বছর ২০১৯ সালে বেকার জনগোষ্ঠীর যে সংখ্যা তার থেকে ২০২২ সালে এ সংখ্যা প্রায় অর্ধকোটি বেড়েছে।

উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব পরিস্থিতি নিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের জন্য এটি বড় সংকট।

"পরিস্থিতির উন্নতিতো হয়ইনি বরং বিশ্বব্যাংকের যে পর্যবেক্ষণ সেখানে আসলে বাংলাদেশের এখন বিশেষ করে যারা শিক্ষিত তাদের কিন্তু চাকরি পাবার সম্ভাবনা কম। এই মুহূর্তে আপনি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবটা দেখবেন না।"

তিনি মনে করেন, "শিক্ষিতদের বেকারত্বের হার সামনে আরো বেশি দেখার আশঙ্কা আছে। কারণ এই শিক্ষিতদের এমনিতেই স্নাতোকোত্তর পর্যায়ে আমাদের হাতে গোনা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিদের কোয়ালিটি ভাল না। এখন এরা আবার করোনার কারণে যেইটটুকু লেখাপড়া হতো সেটাও কিন্তু হয়নি।"

দেশের চাকরি বাজারে বিদেশীদের চাহিদা
এদেশে উচ্চশিক্ষিতরা অনেকেই যখন বেকার. তখন প্রতিবেশি দেশের থেকে বহুলোক কাজ করে। যেটিকে শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যা হিসেবে দেখেন নাজনিন আহমেদ।

"আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের প্রসার হয়েছে আমার টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার দরকার। সেখানে কিন্তু দেখা যাচ্ছে পার্শবর্তী দেশের অনেকেকেই কিন্তু নিয়োগ দিচ্ছি।"

তিনি বলেন, "আমার এখানে মানবসম্পদ উন্নয়নে ‌আমাদের এত এত বিবিএএমবিএ রেখে শ্রীলংকানরা এসে কাজ করবে। চিন্তা করতে হবে যে আমার দেশের প্রজেকশন কী।"

"আগামী দশ বছরে কোন শিল্পগুলোয় মানুষ দরকার হবে এবং কী ধরনের দক্ষতা আমাদের প্রয়োজন পড়বে - এই প্রজেকশন না থাকলে, শিক্ষার সাথে এই যোগাযোগ না থাকলে আমরা অনেক গ্রাজুয়েট তৈরি করতে পারবো কিন্তু আমরা কর্মী তৈরি করতে পারবো না।"

অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয় বাড়লেও তার সাথে সঙ্গতি রেখে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় না বলে সমালোচনা আছে।

সরকারি নতুন পরিসংখ্যান না হলেও বাস্তবতা আর পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে যে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব বাংলাদেশে যে একটা বড় সংকট যা অনেকের ধারনার চেয়েও গভীর। বিবিসি

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন