রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পুনর্গঠন, প্রতিবেশী আফগানিস্তানের অস্থির পরিস্থিতি এবং বিদেশী সমর্থন বেলুচিস্তান প্রদেশে সহিংসতার নতুন বিস্তারের মূল কারণ। খনিজ-সমৃদ্ধ প্রদেশে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে কারণ সাম্প্রতিক মাসগুলিতে এই অঞ্চল জুড়ে অতর্কিত হামলা, সংঘর্ষ এবং বোমা বিস্ফোরণে কয়েক ডজন নিরাপত্তা কর্মী এবং সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। গত রোববার সীমান্ত পোস্টে টহল দেয়ার সময় আফগানিস্তান থেকে জঙ্গিদের হামলায় অন্তত ৫ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে পাকিস্তান।
রোববার ইসলামাবাদের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, প্রতিবেশী আফগানিস্তানের অভ্যন্তর থেকে সেনাদের লক্ষ্য করে ওই গুলি ছোড়া হয়। গত আগস্ট মাসে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর এটি এধরনের দ্বিতীয় হামলা। ইন্টার-সার্ভিস পাবলিক রিলেশন্স (আইএসপিআর) এর একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক সীমান্তের ওপারে আফগানিস্তানের ভিতরে থেকে সন্ত্রাসীরা কুররাম জেলায় পাকিস্তানি সেনাদের উপর গুলি চালায়,’ যোগ করে যে পাকিস্তানি সেনারা ‘উপযুক্ত পদ্ধতিতে’ জবাব দিয়েছে।
আইএসপিআর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তান তাদের দেশের বিরুদ্ধে কার্যকলাপের জন্য সন্ত্রাসীদের দ্বারা আফগান মাটি ব্যবহারের তীব্র নিন্দা করে এবং আশা করে যে (অন্তর্র্বতীকালীন) আফগান সরকার ভবিষ্যতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই ধরনের কার্যকলাপ পরিচালনার অনুমতি দেবে না।’ আরও বলা হয়ে, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী সন্ত্রাসবাদের হুমকির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সীমান্ত রক্ষা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং আমাদের সাহসী পুরুষদের এই ধরনের আত্মত্যাগ আমাদের সঙ্কল্পকে আরও শক্তিশালী করে।’ নিষিদ্ধ ঘোষিত তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) হামলার দায় স্বীকার করেছে।
ইসলামাবাদ-ভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবঃ) তালাত মাসুদ আনাদোলু এজেন্সিকে বলেছেন যে, এই অঞ্চলের বিশালতা, পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের শিথিল নিয়ন্ত্রণ এবং এতে বিদেশী শক্তি জড়িত থাকার কারণে প্রদেশে সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থান অপ্রত্যাশিত নয়। শুধুমাত্র গত সপ্তাহে বহু বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) এর একটি প্রধান রুটে নিরাপত্তা চেক পোস্টে হামলা এবং বিভিন্ন অংশে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষে পাকিস্তানের অন্তত ২০ জন সৈন্য নিহত হয়েছে। এটি সহিংসতার প্রত্যাবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত।
গত ২৮ জানুয়ারী ইরানের সীমান্তের কাছে কেচ এলাকায় একটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলায় ১০ সেনা নিহত হওয়ার ঘটনাটি কয়েক মাসের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনা। বেলুচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট, একটি নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, হামলার দায় স্বীকার করেছে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি পাঞ্জগুর ও নওশকি জেলায় দুটি পৃথক নিরাপত্তা অভিযানে আরও সাত সেনা ও ১৩ সন্ত্রাসী নিহত হয়। ‘আফগান সরকারের কাছ থেকে (সন্ত্রাসবাদের জন্য) কোন সমর্থন নেই তবে এটি শিথিল সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের কারণে, যেটির সন্ত্রাসীরা কেবল বেলুচিস্তানেই নয়, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপজাতীয় অঞ্চলে সুবিধা নিচ্ছে,’ বলেছেন সাবেক সেনা সদস্য মাসুদ।
গত আগস্টে তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর থেকে পাকিস্তান উপজাতীয় অঞ্চলে, প্রধানত উত্তর ওয়াজিরিস্তান, যা আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বেলুচিস্তান প্রদেশ হল সিপিইসি প্রকল্পের একটি মূল রুট, যার লক্ষ্য চীনের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশকে রাস্তা, রেলপথ এবং পণ্যসম্ভার, তেল এবং গ্যাস পরিবহনের জন্য পাইপলাইনের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরের সাথে সংযুক্ত করা।
এর ৬০০-কিলোমিটার উপকূলরেখা সহ, গোয়াদর একটি গুরুত্বপূর্ণ গভীর সমুদ্রবন্দর যা বর্তমানে চীন দ্বারা পরিচালিত হয়, যার লক্ষ্য সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে সরাসরি প্রবেশাধিকার অর্জন করা। করিডোরটি কেবল চীনকে আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে সস্তায় প্রবেশাধিকার দেবে না বরং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি থেকে ট্রানজিট ফি আকারে বিলিয়ন ডলার পাকিস্তানে আনবে। কিন্তু সন্ত্রাসীরা, যারা সাম্প্রতিক অতীতে চীনা শ্রমিকদের অপহরণ ও হত্যার সাথে জড়িত বলে বলা হয়, তারা এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে, বেইজিংকে ‘সম্পদ চুরি’ করার অভিযোগ করে।
মাসুদের মতে, বেলুচিস্তান একটি বিশাল প্রদেশ, এবং পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। সুতরাং, তাদের (সন্ত্রাসীদের) পুনরায় সংগঠিত হওয়া খুব কঠিন নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে, করাচি-ভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ইকরাম সেহগাল পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে নো ম্যানস ল্যান্ড দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসীদের জন্য ‘নিরাপদ আশ্রয়স্থল’ হিসেবে কাজ করছে। তিনি বেলুচিস্তানের মধ্যে এবং ইরান ও আফগানিস্তানের সীমান্তে ‘সন্ত্রাসীদের আন্তঃসীমান্ত গতিবিধি’ ঠেকাতে সেনা সংখ্যা দ্বিগুণ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
কোয়েটা-ভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক আনোয়ার সাজিদি, প্রদেশ জুড়ে নতুন করে সহিংসতার তরঙ্গের পিছনে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির ‘একত্রীকরণ’কে একটি মূল কারণ হিসেবে দেখেন। সেহগাল এবং মাসুদ আরও বলেছিলেন যে, সন্ত্রাসী হামলা বৃদ্ধির পিছনেও ভারতীয় হাত রয়েছে, যেখানে সাজিদিও এই আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেন না। ইসলামাবাদ নয়া দিল্লির বিরুদ্ধে বেলুচিস্তানে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ করেছে, যে অভিযোগ ভারত অস্বীকার করেছে।
মাসুদ বলেছেন যে, নয়াদিল্লি আইআইওজে’কে-তে স্কোর নিষ্পত্তি করতে সীমান্তে ভিন্নমতাবলম্বী উপাদানগুলির সহায়তায় বেলুচিস্তানে নতুন ফ্রন্ট খুলছে। সেহগাল দাবি করেছেন যে, ভারত বেলুচিস্তানে ‘তার নেটওয়ার্ক পুনরায় সক্রিয় করেছে’, যা এই অঞ্চলে সহিংসতার সর্বশেষ তরঙ্গের জন্য দায়ী। সাজিদি বলেন, বেলুচিস্তানে সর্বশেষ হামলায় বিদেশি হাতের জড়িত থাকার আশঙ্কা ‘সেখানে’ রয়েছে।
২০১৬ সালে, পাকিস্তান ইরানের সীমান্ত থেকে কয়েক মাইল দূরে বেলুচিস্তানের মাশকেলে কুলভূষণ যাদব নামে ভারতীয় নৌবাহিনীর একজন সক্রিয় অফিসারকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতার করে। এর আগে মুবারক হোসেন প্যাটেল নামের একজন ছদ্মবেশি মুসলিমকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে ইরানের চাবাহার বন্দর থেকে ভারতের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র) এর জন্য একটি গুপ্তচর নেটওয়ার্ক চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল। তার কর্মকাণ্ডের ভিডিও স্বীকারোক্তি প্রকাশ করা হয়। একটি সামরিক আদালত গুপ্তচরবৃত্তি এবং সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে এপ্রিল ২০১৭ সালে যাদবকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ইসলামাবাদ হাইকোর্টে তার আপিল বিচারাধীন।
এ বিষয়ে মাসুদ বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদের এই ঢেউ আসতেই থাকবে এবং চলতেই থাকবে, যদি না সন্ত্রাসবাদের প্রকৃত কারণ, যা বিচ্ছিন্নতার অনুভূতির মূলোৎপাটন না হয়।’ তিনি বলেন, ‘বেলুচ (জনগণ) মনে করে তারা বঞ্চিত এবং ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে। তাদের ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে আনা দরকার। যদি এটি ঘটে, সহিংসতার ঢেউ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে যাবে।’ সূত্র : ডন, ট্রিবিউন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন