গত ৭ ফেব্রুয়ারি রয়টার্স পরিবেশিত একটি খবরে বলা হয়, ফিলিস্তিনিদের অভিমত, বিশ্ববাসী এখন তাদের নির্যাতনের কথা বিশ্বাস করছে। এর দুইদিন পর বৃহস্পতিবার, ইনকিলাবে প্রকাশিত আরো দুটি খবরের একটি হচ্ছে, ‘মুসলিমদের পোশাক পরে প্রার্থনা করেন যে ইহুদিরা’ এবং আরেকটি খবর হচ্ছে, ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে’।
খবরগুলোর উপর আলোকপাত করার পূর্বে একটি হাদীসের কথা বলে রাখা দরকার। হাদীসটি হচ্ছে: ‘আখরিজুল ইহুদা মিন জাযিরাতিল আরব’ অর্থাৎ ইহুদিদের আরব ভ‚খÐ হতে বিতাড়িত করে দাও। এজন্য প্রথম প্রয়োজন ফিলিস্তিনের বৃহত্তর আরব মুসলিম ঐক্য ও সমরশক্তি অর্জন করা। কোরআনেরও নির্দেশ মুসলমানদের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলার এবং সমরশক্তিতে সজ্জিত হওয়ার। কিন্তু শত্রæপক্ষের তুলনায় তারা না ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, না সমরশক্তি।
এ পর্যায়ে আমরা ফিলিস্তিনের বিষয়টা নিয়ে আসতে চাই। ১৯৪৮ সালের এক কালোরাতে অবৈধভাবে ইসরাইলি রাষ্ট্রের জন্মলাভ হতে এ যাবত ফিলিস্তিনিদের ওপর নানামুখী অত্যাচার এবং অব্যাহত ইসরাইলি আগ্রাসনের নিমর্ম কাহিনী বিশ্বমুসলিমের অজানা না থাকলেও বলিষ্ঠ প্রচার মাধ্যমের অভাবে তার প্রচারধারা সীমিত অথবা অজানা রয়ে গেছে। তাছাড়া ইহুদি-প্রীতি ও ইসরাইলের তোষণ-পোষণ নীতি, পরাশক্তিবর্গের সত্যবিমুখিতা, এক তরফা পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি বর্বরতাকে সর্বদা সমর্থন করার মানসিকতা নিন্দনীয় হলেও সে-ধারা সক্রিয়ভাবে চালু রয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমগুলোর বৃহৎ শক্তিবর্গের সেবাদাস হিসেবে ভ‚মিকা পালন করার অভিযোগ নতুন নয়। বহির্বিশ্বে ইসরাইলি ধ্বংসাত্মক তৎপরতার সঠিকচিত্র উঠে আসতে পারছে না। যদি তাই হতো তাহলে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি নির্যাতনের লোমহর্ষক ঘটনাবলী পর্দার আড়ালে থাকতো না। কখনো কখনো অবশ্য অজানা নির্যাতনের বিষয় ফাঁস হয়ে যায়। এর সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে, একটি আন্তর্জাতিক প্রচার সংস্থার প্রতিবেদনে ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতনের স্বীকৃতি এবং তার প্রতি ফিলিস্তিনিদের সমর্থন জ্ঞাপন করার সংবাদ, যেখানে ফিলিস্তিনিদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘বিশ্ববাসী এখন আমাদের ওপর নির্যাতনের কথা বিশ্বাস করছে।’
ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি অত্যাচার-নির্যাতন, মানবতাবিরোধী অপরাধ ইত্যাদি বর্বরতার কথা বিশ্ববাসী জেনে যাওয়ার কথা ফিলিস্তিনিরা স্বীকার করেছে। বস্তুত সত্যকে দীর্ঘকাল ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায় না, সত্য এক সময় উদ্ভাসিত হয়েই উঠে। আবার অসত্যকে সত্য হিসেবে প্রচার করলে তা কখনো সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয় না। অসত্য এক সময় অসত্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়ে যায়। আধুনিক যুগে উন্নত প্রচার মাধ্যমের বদৌলতে অনেক অনুদঘাটিত বিষয় যেমন সহজে প্রকাশ পেয়ে যায়, তেমনি অনেক বাস্তব ঘটনাও যথার্থ কিংবা আংশিক অথবা বিকৃতভাবে প্রচারিত হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। দেখা যায়, উন্নত প্রচার মাধ্যমগুলোর কর্তৃত্ব অমুসলিমদের দখলে থাকায় তারা যেভাবে লাঠি ঘোরায়, সেভাবেই লাঠি ঘুরতে থাকে। কিন্তু এখন একচেটিয়া কারবার খুব বেশি দিন চলতে পারছে না। কিছু কিছু প্রচার মাধ্যম মুসলমানদেরও কব্জায় এসেছে, যার ফলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মাধ্যমও সত্য গোপন করতে দ্বিধান্নিত হয় এবং প্রচার করতে উদারতা প্রদর্শন না করে পারে না ।
এবার দ্বিতীয় খবরটি প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাক। ‘মুসলিমদের পোশাক পরে প্রার্থনা করেন যে ইহুদিরা’ এ ঘটনাটি ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসে মোনাফেকদের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এ সম্পর্কে যারা সম্যকরূপে অবহিত, তারা উত্তমরূপে জ্ঞাত যে, মদীনায় হিজরতকারী মুসলমানদের সাথে সেখানকার ইহুদি সম্প্রদায়গুলো মোনফেকী তথা শঠতা ও প্রতারণার যে সব আচরণ প্রদর্শন করেছিল, তার পরিণতি কী ঘটেছিল তা সকলের জানা। রসূলুল্লাহ (সা.) ইহুদি মোনাফেকদের মদীনা হতে নানাস্থানে বিতাড়িত করেছিলেন এবং খলিফা উমর (রা.) তো সমগ্র আরব ভ‚খÐ হতে বিতাড়িত করার পক্ষপাতি ছিলেন, ওদের বিশ্বাস ঘাতকতার কারণে। আরব মুসলমানদের অনৈক্য এবং পরস্পর দ্ব›দ্ব-কলহ এবং বর্তমানে ইসরাইলি প্রতারণার নবনব কৌশলে আরবরা বিভ্রান্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ইসরাইলি ইহুদিদের নব কৌশলগুলোর মধ্যে মুসলমানদের পোশাকের অনুকরণ একটি। তাদের এ বাহ্যিক রূপ পরিবর্তনের মাধ্যম ওরা মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে চায়, যা ওদের চারিত্রিক ঐতিহ্য। প্রতারণার সে পুরানো রূপটি নবরূপে প্রকাশিত হয়েছে।
বিবিসির বরাতে প্রকাশিত খবরে অনুযায়ী, আল-আকসা মসজিদ বা টেম্পল মাউন্ট এলাকায় ইহুদিরা প্রবেশ করে প্রার্থনা করছেন। বলা হয়েছে, একগোড়া ইহুদি এটি জানিয়েছেন। এই এলাকায় ইহুদিদের জন্য প্রার্থনা করা নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরেও তারা নিজ ধর্মমতে প্রার্থনা করে চলেছেন সেখানে। এজন্য তাদের বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হয়। অনেক ইহুদিই মুসলিমদের পোশাক পরে টেম্পল মাউন্ট এলাকায় প্রবেশ করছে। এটি ইহুদি প্রতারণার এক জ্বলন্ত রূপ। মুসলমানগণ যেহেতু প্রাচীনকাল থেকে খুব উত্তমরূপে জেনে আসছেন, তাই তারা ইহুদিদের ঐ বিভ্রান্তিকর প্রতারণায় বিভ্রান্ত হবে না, এটা আশা করা যায়।
ইহুদিদের মিথ্যাচার ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত এবং পবিত্র কোরআনের বহু স্থানে তাদের মিথ্যাচারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের ধাপ্পাবাজি ও প্রতারণার কারণে তাদের বর্ণনাগুলোর অধিকাংশই বিকৃতি ও মিথ্যা বলেই এগুলোকে ‘ইসরালিয়াত’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। তারা বহুস্থানকে পৈত্রিক ভ‚মি বলে মিথ্যা দাবিও করে থাকে। ইহুদিরা এবাদতকেও মিথ্যাচারিতার কালিমাযুক্ত করে চলেছে, যার টাটকা দৃষ্টান্ত মুসলিমদের পোশাক পরে মসজিদে গমনের ঘটনা ।
‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে সময় দ্রæত শেষ হয়ে যাচ্ছে’ খবরটিতে এ আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। আশংকাটি কোনো রাষ্ট্র প্রধান বা কোনো নেতার নয়, খোদ জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতরেসের। ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্ব›দ্ব নিরসনে জাতিসংঘ মহাসচিবের হতাশাব্যঞ্জক উক্তিকে হাল্কাভাবে দেখার উপায় নেই। তার এ বিশ্ব সংস্থায় দীর্ঘদিন ঝুলে আছে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যা। তিনি বলেন, দ্বি-রাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা থেকে আমরা এ মুহূর্তে ফিরে আসতে চাই না। প্রশ্ন জাগে, জাতিসংঘ কেন এর সমাধান করতে পারছে না? কী সে বাধা? কেন-বা এই বাধা? জাতিসংঘ প্রধান এসব প্রশ্নের জবাব ভালোভাবেই জানেন। ফিলিস্তিনে ইসরাইলি বর্বরতা এবং তার মানবতাবিরোধী তৎপরতা কেন থামানো যাচ্ছে না, সেটাও তার অজানা নয়। জাতিসংঘ মহাসচিবের ভাষায়, ‘পশ্চিম জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনের ইসরাইল অধিকৃত এলাকাগুলোর পরিস্থিতি ভয়ানক হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষে এ অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন