শাহানাজ পলি
শহরের বাসাবাড়িতে নারী গৃহকর্মীরা কাজ করে তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কিশোরী বা শিশু। প্রান্তিক জনপদের দরিদ্র পরিবারের কাছ থেকে নারী গৃহকর্মীদের এনে শহরের বাসাবাড়ি বা মেসে গৃহকর্মে নিয়োজিত করা হয়। শুধু সংসারের কাজই না একটু ভুল ভ্রান্তি হলে তাদের উপর জুলুম-নির্যাতনের ঘটনাও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এ ধরনের অমানুষিক কিছু কাজের চিত্র খবরের কাগজে বা টেলিভিশনে আমরা দেখতে পাই। তবে বেশির ভাগ নির্যাতনের খবর থেকে যায় সকলের অগোচরে রয়ে যায়। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের আয়োজনে ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, ২০১৫’-এর উপর একটি ওরিয়েন্টেশন সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারটির সহযোগী হিসেবে ছিল জাপানি অর্গানাইজেশন শাপলা নীড়। সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেল এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালের নারী সাংবাদিকগণ। সেমিনারে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, ২০১৫ বাস্তবায়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। শিশু গৃহকর্মীকে শুধু কাজের মানুষ হিসেবে নয় বরং পরিবারের একজন দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে দেখার জন্য তার প্রাপ্ত সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের কথা বলা হয়।
‘প্রভু-ভৃত্য কোন সম্পর্ক নয়, বরং গৃহকর্মীকে পরিবারের একজন সদস্যসঙ্গী হিসেবে দেখা উচিত বলেন নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক পারভীন সুলতানা ঝুমা। কোন গৃহকর্মীর বয়স যেন ১৪ (বিশেষ ক্ষেত্রে ১২বছর) বছরের নিচে না হয় সে ব্যাপারে সুশীল সমাজকে আরো সচেতন হতে হবে। শিশু গৃহকর্মীর মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য গৃহকর্তাকে দায়িত্ব সহকারে নিজ উদ্যোগে গৃহকর্মীর ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা স্বরূপ তার মজুরির একটি অংশ ব্যাংক একাউন্টে জমা রাখাসহ গৃহকর্মীর পর্যাপ্ত বিশ্রাম, বিনোদন, পড়ালেখা, ছুটি, প্রসূতিকালীন সবেতনে ১৬ সপ্তাহ ছুটি প্রদান, চিকিৎসা, ধর্মপালনের সুযোগ, দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়। শিশুশ্রম বন্ধ করার আইন থাকলেও তার যথার্থ নিয়ম পালন করা হচ্ছে না বলে জানালেন সাংবাদিক শান্তা মারিয়া। অনেক শিশু ঝুঁকি নিয়ে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে তা কর্তৃপক্ষকে মনিটরিং করে শিশু অধিকার আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানান তিনি। বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় শিশু গৃহকর্মীকে ঠিক মতো খেতে দেয়া হয় না, একইবাড়িতে রান্না হয় দুই রকমের। এমনকি তাকে থাকতে দেওয়া হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। এসব বৈষম্য ভুলে শিশুদেও শৈশব ফিরিয়ে দিতে হবে। শিশু শ্রম অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আমরা যতই সচেতন হবো ততই এসব ঘটনা অনেকাংশেই কমে আসবে। গৃহকর্মীদের বিনোদন, ছুটি, বেতনের বিষয়ে আইনের অওতায় আনা দরকার বলে মনে করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই প্রতিভা আছে, তা বিকাশের সুযোগ দিতে হবে।
সেমিনারে বাংলাদেশের শাপলা নীড়ের তত্ত্বাবধানে থাকা জাপানি নাগরিক নবুতাদা সুগাহারা বলেন, দেশের অনাচে কানাচে শিশু নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটে। অনেক শিশুগৃহকর্মী ভায়োলেন্সের শিকার হয় কিন্তু সেসবের দু-একটি ছাড়া অনেক ঘটনাই মিডিয়ায় প্রকাশ পায় না। এর জন্য বাবা মা এবং সমাজের সবাইকে আরো সচেতন হতে হবে। সেসব ঘটনা মিডিয়ার মাধ্যমে সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। আরো বেশি বেশি সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন শাপলা নীড়ের অ্যাডভোকেসী অফিসার আতিকা বিনতে বাকী। তিনি গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি,২০১৫ আলোকে সার সংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেন। রাজধানীতে কম বেশি ৭৫ হাজার গৃহকর্মী কজে করে বলে তিনি জানান। বর্তমানে শিশু গৃহকর্মীদের জন্য ঢাকা শহরে ৭টি স্কুল পরিচালিত হয়ে আসছে। আজিমপুর, বনানী কড়াইল বস্তি, মিরপুরের পাইকপাড়ায় এসব স্কুলের কার্যক্রম চলে। ফুলকি নামে স্কুলগুলিতে শিশু গৃহকর্মীদের পড়াশুনার পাশাপাশি হতের কাজ এবং রান্না শেখানো হয়। পুতুল, পাপেট, ফ্রগ সেলাই এবং সিঙ্গাড়া জাতীয় খাবার তৈরী শেখানো হয়। ঢাকার আশেপাশে উপজাতিদের নিয়েও কাজ শুরু করতে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। উল্লেখ্য, শাপলা নীড় ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে নানান বিষয়ের উপর প্রজেক্ট পরিচালনা করে আসছে। এছাড়াও শাপলা নীড় বাংলাদেশ, নেপাল এবং জাপানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করে আসছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন