বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অপরাধে জড়াচ্ছে পুলিশ

আসামি ধরতে গিয়ে মারধরের ঘটনায় তিন পুলিশ বরখাস্ত শাস্তির আওতায় আনা হলে অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে -অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান

খলিলুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১৭ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০০ এএম

করোনা মহামারির সময় মানবিক কাজে মানুষের পাশে থেকে সবার মনে জায়গা করে নিয়েছিলো পুলিশ বাহিনীর সদস্য ও কর্মকর্তারা। জীবন ঝুঁকি নিয়ে লাশ দাফন থেকে শুরু করে বাসায় খাবার পৌঁছে দেয়ার কাজ ও করেছে পুলিশ সদস্যরা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কতিপয় পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ডে সেই অর্জন স্লান হয়েছে অনেকটাই। দিন দিন অপরাধ দমন না করে নিজেরা বারবার তারা জড়িয়ে পরছে অপরাধে। সম্প্রতি লালমনিরহাটে পুলিশ হেফাজতে রবিউল ইসলাম নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় এলাকাবাসী রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিলও করেছে। ফেনীতে কিশোরকে ভয় দিখেয়ে তিন মাস ধরে বলাৎকার করে এক পুলিশ সদস্য ও যাত্রাবাড়ীতে আসামি ধরতে গিয়ে ভুক্তভোগীদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় গোটা পুলিশ বাহিনীর ইমেজ বা ভাবমর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।

সম্প্রতি যাত্রাবাড়ীর বিবির বাগিচা এলাকায় প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে ৯৯৯-এ ফোন করে একটি ভুক্তভোগী পরিবার। তবে আসামি ধরতে গিয়ে ভুক্তভোগীদের মারধর করে পুলিশ। মামলা দিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারকে জেলেও দেওয়া হয়। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় যাত্রাবাড়ী থানার তিন পুলিশ ও এক আনসার সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটিও করেছে পুলিশ। বরখাস্তরা হলেন যাত্রাবাড়ী থানার এসআই বিশ্বজিৎ সরকার, কনস্টেবল শওকত ও নারী কনস্টেবল নবনিতা। গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারি বিভাগের ডিসি শাহ্ ইফতেখার আহমেদ এসব তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যাত্রাবাড়ী থানার এক এসআই ও দুই কনস্টেবলকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে এক আনসার সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তাকে আনসার বাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় ওয়ারি বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) কামরুল ইসলামকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, যাত্রাবাড়ীর বিবিরবাগিচা এলাকায় আসামি ধরতে গিয়ে ভুক্তভোগীদের পুলিশি নির্যাতনের ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্য ও এক আনসার সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে, লালমনিরহাটে পুলিশ হেফাজতে রবিউল ইসলাম খান নামে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আতিকুল ইসলামকে প্রধান করে এই কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ হেফাজতে রবিউলের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। গার্মেন্টকর্মী রবিউল ইসলাম খান সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নের দুলাল খানের ছেলে। নিহতের স্বজনদের দাবি, পুলিশি নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে।

পুলিশ ও রবিউলের স্বজনরা জানায়, লালমনিরহাট সদর উপজেলার হারাটি ইউনিয়নের হিরামানিক এলাকায় বৈশাখ উপলক্ষে মেলা চলছিল। মেলা-সংলগ্ন এলাকায় জুয়ার আসর বসে। খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক ১১টার দিকে সদর থানার পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। এ সময় রবিউলসহ দুইজনকে আটক করে পুলিশ। এদের মধ্যে রবিউল অসুস্থ হয়ে পড়লে রাত ১২টার দিকে পুলিশ তাকে চিকিৎসার জন্য লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে নিয়ে আসে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা চলাকালীন তিনি মারা যান।
এছাড়া ফেনীতে এক কিশোরকে বলাৎকারের অভিযোগে ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) গাড়ি চালককে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার পুলিশ সদস্য হলেন মো. ইউনুস। এ ঘটনার পর তাকে গত বৃহস্পতিবার রাতে বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী কিশোরের মা বাদী হয়ে ফেনী মডেল থানায় মামলা করেছেন।

মামলার বিবরণী ও ভুক্তভোগীর মা অভিযোগ করেন, গত ২৩ ডিসেম্বর রাতে বাড়ি ফেরার পথে ওই কিশোরের কাছে অবৈধ মালামাল আছে অজুহাতে তাকে আটক করে মো. ইউনুস। পরে একটি হোটেলে নিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাকে বলাৎকার করে। এরপর ২৪ ডিসেম্বর নির্জন স্থানে নিয়ে থানার গাড়িতে এবং চলতি বছরের ৫ মার্চ মো. ইউনুস নতুন মোবাইল ফোন উপহার দেয়ার আশ্বাসে তার নিজ গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে নিয়ে গিয়ে একাধিকবার বলাৎকার করে। পরে এ বিষয়ে জানতে পেরে ওই কিশোরের মা বৃহস্পতিবার সকালে থানায় একটি ধর্ষণের মামলা করেন। ফেনী মডেল থানার ওসি নিজাম উদ্দিন বলেন, ঘটনায় তদন্ত পূর্বক সত্যতা পেয়ে আসামি মো. ইউনুসকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া বৃহস্পতিবার রাতে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলেও জানান ওসি।

তবে পুলিশ সদরদফতর সূত্রে জানা যায়, পুলিশ বাহিনীতে বর্তমানে প্রায় সোয়া দুই লাখ সদস্য কর্মরত। তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি ধরতে পুলিশ সদর দফতরের বিভিন্ন সেল এখন আগের চেয়ে আরও সক্রিয়। পুলিশ সদর দফতরের বাইরে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটেও অনুরূপ সেল কাজ করছে। প্রতি বছর গড়ে ১৮ থেকে ২৫ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আসে সদর দফতরে। এদের মধ্যে গড়ে প্রায় ২ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মে জাড়িয়ে পড়ার তথ্য পায় পুলিশ সদর দফতর। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী নির্ধারিত হয় তাদের সাজা।

পুলিশ প্রবিধান পিআরবি-১৮৬১অনুযায়ী, কোন পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির (লঘু ও গুরু) বিধান আছে। গুরুদণ্ডের আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিত, বেতন বৃদ্ধি স্থগিত ও বিভাগীয় মামলা হয়। মামলায় অপরাধ প্রমাণিত হলে বরখাস্ত করা হয়। গুরুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ আছে। আর ছোট অনিয়ম বা অপরাধের জন্য দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইনস বা রেঞ্জে সংযুক্ত করে লঘুদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরদারির দুর্বলতাতেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। শুধু নজরদারি বাড়ানো নয়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারলে অনেকাংশে কমানো সম্ভব পুলিশ সদস্যদের অপরাধ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান ইনকিলাবকে বলেন, শুধু পুলিশে নয়, অনেক সময় অর্থনৈতিক লোভের কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তবে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা হলে অপরাধ প্রবণতা কমে আসে। আসার দিক হলো সম্প্রতি সময় পুলিশের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে পুলিশ সদস্যরাও অপরাধে জড়াতে ভয় পাবে বলে মনে করেন তিনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন