বিশ্বের মুসলমানদের ক্ষেত্রে রোজা পালনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ইসলাম নির্দেশিত এ বিধানটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রোজা নামকরণই সংযমের ব্যাপকতার নির্দেশক। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিবেচনাতেই এটিকে সীমাবদ্ধ করা যায় না। বিধানটি শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমিত নয়। আবার এটি শুধুমাত্র খাদ্য অভ্যাসের ভিতরেও সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি একজন মুমিন ও মুসলিমের সামগ্রিক জীবনধারার সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে সংযুক্ত। এর ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি মুসলমানদের সামগ্রিক জীবনাচরণের সাথে সম্পৃক্ত। একজন রোজাদার তার মননে, মননশীলতায়, চিন্তায় এবং দৈনন্দিন সকল কর্মে সংযমের মানসিকতা লালন করবেন, এটাই হলো রোযার কাক্সিক্ষত দাবি। মুসলিম বিশ্বের সব দেশেই রোজার সামগ্রিক প্রভাব কম-বেশি প্রদর্শিত হয়ে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ রমজান মাসকে ভিন্ন আঙ্গিকে সাজিয়ে থাকে। তারা রোজার মাসে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অসামান্য সংযমী নীতি অনুসরণ করে। তারা রোজাদারদের প্রতি পরম সহিষ্ণু ও সম্মান প্রদর্শন করে। এ মাসে মুসলিম বিশ্বের ব্যবসায়ীরা ব্যাপকভাবে মূল্য ছাড় দেয়। ব্যবসার ক্ষেত্রে তারা মুনাফার লাগাম টেনে ধরে। ঐ সমস্ত দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ী পণ্যে শতকরা ৫০ থেকে ৭০ ভাগ পর্যন্ত মূল্য ছাড় দিয়ে থাকে। একজন ব্যবসায়ীও অন্তত ৩০ ভাগ মূল্য ছাড় না দিয়ে পণ্য বিক্রি করে না। পুণ্য অর্জন ও জনগণকে স্বস্তি দিতে তারা প্রতি রমজানে এ আয়োজন করে থাকে।
এ কারণে রমজান এলেই সেসব দেশে ভোগ্য-অভোগ্য পণ্যের মূল্য কমে যায়। ছোটো-বড়ো সকল শপিংমলে মূল্য ছাড়ের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। উদ্দেশ্য থাকে বেশি পণ্য বিক্রি করা এবং ব্যাপকভাবে বাজারজাত করা। মূল্য ছাড়ের কারণে ভোক্তা সাধারণ খুশি হয়। ফলে ভোক্তা ও ক্রেতা সাধারণ স্বস্তিতে থাকে। মূল্য ছাড় পেয়ে ক্রেতারা সাধ এবং সাধ্যের সমন্বয় ঘটিয়ে মনের আনন্দে কেনাকাটা করে। ঈদের আনন্দে মেতে ওঠে দেশের সাধারণ জনগণ। মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা মুসলিম বিশ্বে কম-বেশি এটি লালিত হলেও বাংলাদেশে শুধু এর ব্যতিক্রম। রমজান মাস আসতে না আসতেই বাংলাদেশ যেনো তার সংযমের লাগাম টেনে ছিঁড়ে ফেলে। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীগণ উন্মত্ত নেশায় নেমে পড়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায়। ব্যবসায়ীরা হুহু করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। ভোক্তা সাধারণের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায় বহুগুণ। ফলস্বরূপ জনগণের নাভিশ্বাস উঠে যায়। ইসলামের স্বাভাবিক নির্দেশই হলো মানুষ সংযমী হবে। আর রমজান মাসে সংযমের গুরুত্ব আলাদাভাবে বিধৃত রয়েছে। ইসলাম যেখানে রমজান মাসে বিশেষভাবে নির্দেশ করেছে সংযমী হতে, সেখানে অহরহ প্রকাশ পাচ্ছে অসংযমী আচরণ। এখানে ধর্মের নামে চলছে অধর্মের চর্চা। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীগণ ১১ মাসের আয়ের সমান আয় করে শুধু রমজান মাসে। অর্থাৎ গোটা ১১ মাসে তারা যা আয় করে, তার চেয়ে বেশি আয় করে এক রমজান মাসে। দেশের অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। প্রতি বছর রমজান যায়, রমজান আসে। কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না।
সংযমের বিন্দুমাত্র ছিঁটেফোটা এখানে পরিলক্ষিত হয় না। এটি যেনো বাংলাদেশের স্বাভাবিক রীতিতেই রূপান্তরিত হয়েছে। এ রীতিতে বড় লোক ব্যবসায়ীরা ফুলে ফেঁপে আরো মোটাতাজা হয়। আর গরিব আরো বেশি গরিব হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে গরিবের হাহাকার কারো কর্ণগোচর হয় না। সাধারণ মানুষের অভিযোগ আছে, অনুযোগ আছে, আছে আপত্তি। কিন্তু কে শোনে কার অভিযোগ আর আপত্তি? চলছে তো চলছেই; কোনো সমাধান নাই। সমাধানের কোনো উদ্যোগও নাই। কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিয়েছে বলে ঘোষণা করলেও বাস্তবে তার কোনো লেশমাত্র নেই। এমতাবস্থায় প্রশ্ন জাগতেই পারে, কোথায় সিয়ামের বরকত? কোথায় রোজার রহমত আর কোথায়ই-বা এর বরকত? তাহলে কি ধরে নেয়া যায় যে, রোজার সংযমী আচরণ শুধু মসজিদেই সীমাবদ্ধ থাকবে? না, সেখানেও মুসল্লিদের মাঝে সম্প্রীতি নেই, নেই একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। রোজাদারের কথা ও আচরণে কোনো পরিবর্তন নাই। সেই আগের মতোই রয়ে গেছি আমরা। অথচ, আমরা রোজা রেখে চলেছি বছরের পর বছর।
বহুকাল থেকে আমরা শুনে আসছি যে, দেশের খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানো হয়। মিডিয়ার মাধ্যমে এগুলো প্রকাশিত হয়। আর এ অনৈতিক কাণ্ডগুলো ঘটে প্রশাসনের নাকের ডগায়। প্রশ্ন হলো, এর কোনো প্রতিকার কি হয়েছে? এর উত্তরটা খুব সহজ, না। বরং রমজান মাস এলেই ভেজাল মেশানোর অশুভ এ প্রতিযোগিতা অনেক গুণ বেড়ে যায়। কাঁচা ফল পাকানো হয় বিষ দিয়ে। হলুদের সাথে মিশানো হয় পোড়ামাটি ও ইটের গুঁড়া। সরিষার তেলে মেশানো হয় মরিচের গুঁড়া। বেগুনি বিক্রি করলেও তার ভিতরে থাকে না বেগুনের কোনো ছিটেফোঁটা। বরং তার পরিবর্তে বেষনের ভিতর রাখা হয় পেঁপের একটা ফালি অথবা কুমড়ার একটা টুকরা। এসব নকল বেগুনি আর মিথ্যা বড়া দিয়ে সাজানো হয় ইফতারের বাহারি প্যাকেট! অতঃপর এটা রোজাদারদের কাছে বিক্রি করা হয় চড়া দামে। আর এসব আয়োজন চলতে থাকে রমজানের ঠিক এক মাস আগে থেকেই। ব্যবসায়ী পাড়ায় ধুমধাম এ আয়োজন চলতে থাকে পুলিশের নাকের ডগায়। দেশে এসব অবৈধ আয়োজন চলে আসছে যুগের পর যুগ। আর পাশাপাশি রোজা রাখার প্রাকটিসও চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। এসবের কোনো প্রতিকার কি আজও হয়েছে দেশে? মজার ব্যাপার হলো, এসব ব্যবসায়ীও রোজা রাখেন আর নামাজ আদায় করেন! বড়ই হাস্যকর আমাদের জীবনাচার!
বাংলাদেশের শহরের প্রতিটি অলি-গলিতে বখাটেদের উৎপাত কি নতুন কিছু? মোটেই নতুন কিছু নয়। টোলের নামে দুর্বলদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের ঘটনা এদেশে নতুন নয়। রমজান মাস এলেই মাস্তানি বহুগুণে বেড়ে যায়। একদিকে গুন্ডাদের দাপুটে গুন্ডামি, অন্যদিকে ছোট-বড় সকল ব্যবসায়ীর ঠান্ডা মাথার চাঁদাবাজি। এদ্বৈত শোষণে নিষ্পেসিত হয়ে আসছে দেশের দুর্বল-নিরীহ মানুষেরা। আর এ নিষ্পেসন চলে আসছে যুগ থেকে যুগব্যাপী। আর এগুলোর প্রত্যেকটি সংঘটিত হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। প্রশাসনের কাছে বিষয়গুলো একবারেই ওপেন সিক্রেট। দেশ চালকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে চলে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড। ফলে নিষ্পেসিত জনতার অসহায় আর্তনাদ দেশের কর্তাব্যক্তিদের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করে না। দেশের মার্কেটগুলোতে চলছে বিক্রেতাদের মুনাফা লোটার উৎসব। রমজানের শেষ দশকে এটা আরো বহুগুণে বেড়ে গেছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা ক্রয় মূল্যের চেয়ে অন্তত ৫ গুণ বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছে। সরেজমিনে বাজার পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, দেশের একটি জনপ্রিয় ফিমেল ড্রেসের নাম ‘সারারা লেহেঙ্গা’। মোটামুটি মান-সম্মত এই লেহেঙ্গাটির বাজার মূল্য ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা। কিন্তু এখন এটির দাম হাকানো হচ্ছে ৩০ হাজার টাকা! একজন দোকানির ভাষ্যমতে: ‘সারা বছরের দোকান ভাড়া, বাড়ি ভাড়া, কর্মচারীর বেতন পরিশোধ, সংসারের খরচ ইত্যাদি মেটাতে আমরা এই রমজানের অপেক্ষায় থাকি!’
রমজানের চেতনা বোঝার জন্য একজন মানুষের খুব বেশি ধার্মিক হওয়া লাগে না। এমনিতেই বোঝা যায় যে, রোজা মানুষকে জাগতিক অনেক প্রলোভন থেকে দূরে রাখে। রোজা মানুষের জীবনকে এক ধরনের শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসে। জাগতিক এ শৃঙ্খলাবোধ থেকে মানুষ অনেক বড়ো শিক্ষা অর্জন করতে পারে। আর এ শৃঙ্খলাবোধ একজন মানুষকে বাকি ১১টি মাসের জন্য প্রশিক্ষণ হিসেবে কাজ করতে পারে। রোজাদার একজন সজ্জন, সুবিচেক, মার্জিত ও রুচিশীল মানুষে পরিণত হতে পারে। এ গুণগুলো যিনি অর্জন করতে পারবেন তিনিই সমাজে ধার্মিক ও ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত। কোরআনের পরিভাষায় যাকে মুত্তাকী বলা হয়। (সূরা আল বাক্বারা: ১৮৩)
রোজায় অর্জিত এই উপলব্ধিগুলো কাজে লাগাতে পারলে সমাজে উল্লেখিত অসংগতি সৃষ্টি হতো না। আর এ উপলব্ধিগুলো যার মধ্যে জাগ্রত হয়নি তার রোজা রাখা আর না রাখা একই। একটু ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যায় যে, আমাদের সমাজ জীবন থেকে যেনো ভদ্রতা ও সহিষ্ণুতা একবারেই উড়ে গেছে। এক দোকানে ক্রয়-বিক্রয় ভালো হলে পাশের দোকানি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। রাস্তাঘাটে চলার পথে একজন অন্যজনকে ওভারটেক করছে। এক্ষেত্রে একে অপরের সাথে খামাখা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। বাজারে ক্রেতাদের মাঝেও একই আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। শহরের গলিতে, গাড়িতে, গাড়ি চালানোর সময় সকলের ভিতরে একটা ক্ষিপ্ত মনোভাব কাজ করছে। মানুষ খুব অল্পতেই রেগে যাচ্ছে। জনসম্মুখে অতি সামান্যতেই মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছে। একজনকে পেছনে ফেলতে গিয়ে তাকে আঘাত দেয়া হচ্ছে। গাড়ি ওভারটেক করতে গিয়ে তার সাথে দুর্ঘটনায় লিপ্ত হচ্ছে। তারপরেও থামছে না তাদের অসহিষ্ণু আচরণ। অতি সমান্য কারণে একজন অন্য জনের উপর হামলা করছে। তুচ্ছ কারণে একজন অন্য জনকে হত্যা করছে। প্রথম আলোর জরিপ মতে, এ বছর শুধু রমজান মাসের ১৮তম দিন পর্যন্ত বাংলাদেশে অতি তুচ্ছ কারণে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে ১৪টি।
বোঝাই যাচ্ছে, রোজা রাখাটা আমাদের অনেকের ক্ষেত্রে একবারেই নিরর্থক হয়ে গেছে। রোজার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। রোজার শেষ দশকের ভাবনায় তাই বলা যায়, রমজান হলো বিশেষভাবে ধৈর্য্য ধারণের মাস। এমাস ধৈর্য্য ও সহমর্মিতার মাস। আর ধৈর্য্যরে প্রতিদান হলো জান্নাত’। (বায়হাকী) অথচ, এ মাসেই আমরা একটু বেশি অশান্ত হয়ে যাই!
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
dr.knzaman@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন