বাংলাদেশ সরকারের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ও জবাবদিহিতা ছাড়া র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোন সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। একইসাথে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষ বেছে নেবে না বলেও জানিয়েছেন তিনি। বরং যুক্তরাষ্ট্র শুধু এমন একটি নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রত্যাশা করে যার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে যে, কে দেশ চালাবে। গতকাল রোববার রাজধানীর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে (বিআইআইএসএস) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক : বর্ধিত সহযোগিতা ও অগ্রসর অংশীদারিত্ব’ শীর্ষক এক সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করেন।
র্যাবের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে পিটার হাস বলেন, আমি সৎভাবে বলতে চাই। সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ও জবাবদিহিতা ছাড়া র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোন সুযোগ নেই। আমরা এমন একটি র্যাব চাই যারা সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে যেমন কঠোর থাকবে তেমনি কঠোর থাকবে মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি সম্মান বজায় রাখতে। কিন্তু র্যাবের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মানে এই নয় যে, আমরা জোরদার আইন প্রয়োগ বিষয়ে আমাদের ইতোমধ্যে স্থাপিত শক্তিশালী নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়াতে পারবো না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ও সন্ত্রাসবাদের দমন, সীমান্ত নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং সহিংস চরমপন্থা প্রতিরোধে আমরা বাংলাদেশের সাথে কাজ করে যাবো। তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদ দমন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন পুলিশ, সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী ইউনিট এবং চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতামূলক কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান অব্যাহত রেখেছে।প্রস্তাবিত চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের মাধ্যমে এ কার্যক্রমগুলো বেগবান হবে এবং পুলিশকে নতুন সাজ-সরঞ্জাম অনুদান প্রদান ত্বরান্বিত হবে।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার উৎসাহিতকরণ যেখানে আমরা একসাথে কাজ করতে পারি। যুক্তরাষ্ট্র নিখুঁত নয়। আমরা আমাদের নিজেদের গণতান্ত্রিক নবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এই যাত্রার মধ্যে রয়েছে পুলিশের জবাবদিহিতা বিষয়ে আমাদের নিজস্ব সমস্যা নিরসন এবং নির্বাচনের দিনে সমস্ত আমেরিকান যেন ভোট দিতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। সেইসাথে আমরা সারা বিশ্বের দেশগুলোকেও তাদের গণতন্ত্রকে জোরদার করতে একই ধরনের অঙ্গীকার গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেন, আন্তর্জাতিক মানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান শুধু নির্বাচনের দিন ভোটদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কার্যত, ইতোমধ্যেই নির্বাচন শুরু হয়ে গেছে। সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য আবশ্যক হলো নাগরিকদের মতামত প্রকাশ, সাংবাদিকদের ভীতিহীন অনুসন্ধান এবং সুশীল সমাজের ব্যাপক পরিসরে জনমত গঠনের সুযোগ নিশ্চিত করা। আমি সুস্পষ্ট করতে চাই যে: আসন্ন নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষ বেছে নেবে না। আমরা শুধু এমন একটি প্রক্রিয়ার প্রত্যাশা করি যার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, কে দেশ চালাবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র পদক্ষেপ গ্রহণে প্রস্তুত জানিয়ে পিটার হাস বলেন, আগামী মাসে আমি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির উদ্বোধনী সফরকে স্বাগত জানাবো। আমাদের দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক বৃদ্ধিতে আমরা যে গুরুত্ব দিয়েছি তার অন্যতম প্রমাণ এই পদক্ষেপ। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বড় অর্থনীতির দেশগুলোর সাথে সমান তালে প্রতিযোগিতা করবে। মেধাস্বত্ব অধিকার, সরবরাহ ব্যবস্থার সক্ষমতা, মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার সুযোগ এবং স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবসা পরিবেশের মতো বিষয়গুলো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ যেভাবে ইন্টারনেট কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে সেটা বিদেশী বিনিয়োগ ও বিভিন্ন কোম্পানির বাংলাদেশে ব্যবসা করার আগ্রহকেও প্রভাবিত করবে। এছাড়া আরো অনেক সুযোগ আছে যার সদ্ব্যবহার আমরা করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, নতুন প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (বা ডিএফসি)-এর দক্ষিণ এশিয়া ব্যাপী দূষণমুক্ত জ্বালানি, কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা ও ব্যাঙ্কিংসহ বিভিন্ন খাতে ৪ বিলিয়ন ডলারের সক্রিয় অর্থায়ন রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, শ্রম অধিকার না থাকায় যেমন বাংলাদেশ জেনারেলাইজড সিস্টেম অফ প্রেফারেন্স (জিএসপি) বাণিজ্য সুবিধা পাবার যোগ্য হয়নি, ঠিক একই কারণে ডিএফসিও বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনায় অপারগ।
পিটার হাস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে লক্ষ্যভিত্তিক উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমেসহ শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা দানে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানা শ্রমিকদের কর্মপরিস্থিতি উন্নয়ন প্রচেষ্টায় সহায়তা দানের মাধ্যমে তাদের সমিতি বা ইউনিয়ন গঠনের স্বাধীনতাকে সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত করে থাকি। আগামী বছর আমরা ডিপার্টমেন্ট অফ লেবার থেকে একজন নতুন অ্যাটাশেকে স্বাগত জানাবো, যার মাধ্যমে এখানে আমাদের সমন্বয় জোরদার হবে। স্বচ্ছ ব্যবসায়িক পরিবেশ উৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ বা আইএলও পথনকশায় নির্ধারিত সময়সীমা পূরণের মতো কঠিন কাজ আমরা করতে পারি না। এসব পদক্ষেপ নির্ভর করছে বাংলাদেশের ওপর। তবে আমরা এই প্রক্রিয়া অনুসরণে সহায়তা দিতে প্রস্তুত।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, আমাদের দুটি দেশ গত ৫০ বছরে একসাথে একটি শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলেছে। আমাদের দুদেশের মানুষে মানুষে বন্ধন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দ করে এবং তাঁরা বিদেশী শিক্ষার্থী জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ১৪তম এবং তাঁদের সংখ্যা দ্রুততম হারে বাড়ছে। প্রাণচঞ্চল বহুদেশীয় জনগোষ্ঠী ও শক্তিশালী ব্যবসায়িক সংযোগ আমাদেরকে নিবিড়ভাবে পরস্পর যুক্ত রাখে। এখন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে। আমাদের অংশীদারিত্ব জোরদার করতে এবং আমাদের সম্পর্কের বিশাল সম্ভাবনা বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় ভূমিকা নিতে প্রস্তুত। আমরা আপনাদের গতির সাথে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে পিটার হাস বলেন, গত ৫০ বছরে আমরা আমাদের সংস্কৃতি, জনগণ ও আমাদের অর্থনীতিকে সম্পৃক্ত করে একসাথে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরি করেছি। তাছাড়া আমাদের সম্পর্ককে বাংলাদেশ যত দ্রুত প্রসারিত ও গভীর করতে চাইবে, যুক্তরাষ্ট্রও তত দ্রুত এগিয়ে যেতে প্রস্তুত। তবে ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য করলে আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে পরিবর্তন আসবে। কারণটা সহজ: বদলে গেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর একটি। আপনারা স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা উত্তীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং মধ্যম আয়ের মর্যাদা অর্জনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এই পরিবর্তন এক গতিশীল নতুন সম্পর্ক নির্দেশ করে। সহজ কথায়, বড় বড় অর্থনীতি ও আঞ্চলিক পর্যায়ে নেতৃত্বশীল দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্র কূটনীতি পরিচালনা করে ভিন্নভাবে। সম্পর্ক বাড়ার সাথে সাথে সংলাপও প্রসারিত হয়। আমাদের দুদেশের সরকার সম্প্রতি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ করেছে- অংশীদারিত্ব সংলাপ, দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপ এবং ওয়াশিংটনে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ। আগামী সপ্তাহগুলোতে আমরা আরো দুটি সংলাপ আয়োজন করবো: দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সংলাপ এবং উচ্চ-পর্যায়ের অর্থনৈতিক মত-বিনিময়। এ ধরনের সংলাপের মাধ্যমে আমাদের সম্পর্ক বিকশিত ও জোরদার করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং আরো অনেক নতুন সুযোগ উন্মোচিত হবে। তবে আমাদের নিজ নিজ সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, শুধু কথায় আটকে না থেকে কীভাবে সেগুলোকে কাজে পরিণত করা সম্ভব। আমি আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত তিনটি ক্ষেত্রে আলোকপাত করতে চাই: নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক।
নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আমরা সহসাথী হিসেবে সম্পৃক্ত। আমরা বেশ কয়েকটি বার্ষিক অনুশীলন পরিচালনা করি। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের দুদেশের নিজ নিজ বিশেষ অপারেশন বাহিনী বর্তমানে টাইগার শার্ক নামে একটি যৌথ মহড়া পরিচালনা করছে। আমরা অন্যান্য সমমনা পরস্পর-সহযোগী দেশগুলোর সমন্বয়ে এসব সম্পৃক্ততাকে আরো জোরদার করতে পারি। আমরা দুটি মৌলিক তথা ভিত্তিমূলক চুক্তিতেও যেতে পারি। জেনারেল সিকিউরিটি অফ মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট যার আওতায় সামরিক ক্রয় সংক্রান্ত সংবেদনশীল তথ্য আদান-প্রদানের মূলনীতি নির্ধারিত হবে। এই রূপরেখাটি বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী অভীষ্ট ২০৩০ অর্জনে অবদান রাখবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তির সহায়তায় বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন ত্বরান্বিত হবে। অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস সার্ভিং এগ্রিমেন্ট এর আওতায় আমাদের সামরিক বাহিনী আন্তর্জাতিক জলসীমায় একে অপরকে সহায়তা দিতে পারবে এবং বিমান, যানবাহন বা নৌযান কোন সমস্যায় পড়লে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বা খুচরা যন্ত্রাংশ ধার দিতে পারবে, কিংবা শুধু জ্বালানি ও খাদ্য বিনিময়ে সক্ষম হবে। ২০২০ সালে বিস্ফোরণের পর বৈরুত বন্দরে জাহাজ আটকে পড়া অথবা বঙ্গোপসাগরে যৌথ মানবিক ত্রাণ কার্যক্রম চলাকালে নিরাপত্তা ও যৌথ কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টিতে এই এসিএসএ’র একটি প্রায়োগিক প্রভাব রয়েছে। তিনি আরো বলেন, জিসোমিয়া ও এসিএসএ সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। এগুলো কারিগরি চুক্তি। এগুলো “জোট” বা “সামরিক চুক্তি”র পর্যায়ভুক্ত নয়। কিংবা এগুলো কোন বিস্তৃত ও অস্পষ্ট প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তিও নয় যেমনটা ২০০২ সালে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছিল চীনের সাথে। এগুলো কেবল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির উপাদান হিসেবে এবং আপনাদের নিজ প্রতিরক্ষা অভীষ্টকে এগিয়ে নিতে আপনাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সহায়তা করবে। তাছাড়া এগুলো প্রচলিত বিষয়। ৭০টিরও বেশি দেশ আমাদের সাথে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।####
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন