ট্রেনের টিকিট পেতে যত ভোগান্তি। সহজে মেলেনা ট্রেনের টিকিট। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে যাত্রীদের চাপ তত বাড়ছে কমলাপুরসহ বিভিন্ন স্টেশনের টিকিট বিক্রি করা কাউন্টারগুলোতে। রোজ রোজ টিকিটটের জন্য হয়রানি আর দুর্ভোগ যেন শেষ হচ্ছে না। দিন যত যাচ্ছে নতুন নতুন দুর্ভোগের মাত্রা যোগ হচ্ছে। ঈদ যাত্রায় ট্রেনের টিকিট নিয়ে বিপর্যয় নামার কারণে বেশিরভাগ যাত্রীদের পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া যেন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
গত চারদিন ধরে ট্রেনের টিকিটপ্রত্যাশীরা রাত-দিন অপেক্ষা করেও টিকিট পাননি অনেক যাত্রী। অনলাইনে কেনার সুযোগ থাকলেও অনেকের অভিযোগ, কয়েক মিনিটে লগইন করেও টিকিট কাটতে পারেননি তারা। এছাড়া, টানা তিনদিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও কাঙ্খিত টিকিট পায়নি অনেকে। অনেক টিকিটপ্রত্যাশী মোবাইল, কম্পিউটার ও ল্যাপটপ থেকে একসঙ্গে চেষ্টা করেও টিকিট কাটতে পারিনি। এমন অভিযোগও করেছেন অনেকে। এ যেন ডিজিটাল প্রতারণার সামিল বলে অভিযোগ করেন টিকিটপ্রত্যাশীরা। কেউ কেউ আবার এই ব্যবস্থাপনা কে ডিজিটাল ফাঁদ বলেও মনে করছেন।
গতকাল মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিলের টিকিট দেয়া হয়। সকাল ৮টায় অনলাইনে টিকিট বিক্রি শুরু হয়। কয়েক মিনিটে যেতে না যেতেই টিকিট সব বিক্রি হয়ে গেছে বলে দেখানো হয়। ভুক্তোভোগী টিকিট প্রত্যাশীরা বলছেন, অনলাইনে টিকিট কারসাজি করে রাখা হয়। এখানে কোন যুক্তিই কাজে আসবে না। ওই টিকিট সাধারণ মানুষদের না দিয়ে কালোবাজারে বেশি দামে বিক্রি করা হয়। রেলের কর্তাব্যক্তিরা টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত। কারণ কাউন্টারেও সব টিকিট দেওয়া হয় না। বিশেষ করে এসি টিকিট চাইলে বলা হয় শেষ হয়ে গেছে।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, অগ্রিম টিকিট বিক্রির চতুর্থ দিনেও উন্নতি হয়নি ব্যবস্থাপনার। তাই কমেনি দুর্ভোগ। এবার শৃঙ্খলার কোনো বালাই নেই অভিযোগ টিকিট প্রত্যাশীদের। তবে বিদ্যুৎ বিভ্রাটে টিকিট বিক্রিতে ধীরগতি সকাল থেকে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন রাত থেকে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষায় থাকা ব্যক্তিরা। অনেকে কাঙ্খিত টিকিট না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। কারো কারো অভিযোগ শত চেষ্টায়ও টিকিট মিলছে না অনলাইনে। টিকিট প্রত্যাশীরাই লাইনে সিরিয়াল লিখে রাখছেন। সবাই যাতে সিরিয়াল মেইনটেইন করতে পারে এটাই তাদের লক্ষ্য। লাইন ভেঙে কেউ দাঁড়াতে চাইলেই পেছন থেকে অন্য টিকিট প্রত্যাশীরা চিৎকার দিয়ে উঠছেন। কালো বাজারে যাতে কোনো টিকিট বিক্রি না হয় এজন্য স্টেশন এলাকায় রয়েছে র্যাব, পুলিশ, ডিএমপি পুলিশসহ আনসার সদস্যরা। র্যাব-পুলিশের বুথও রয়েছে স্টেশন এলাকায়।
লাইনে দাঁড়িয়েও টিকিট পাওয়ার সম্ভাবনা নেই অধিকাংশের। কেননা সর্বমোট টিকিটের সংখ্যার বিপরীতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন কয়েকগুণ বেশি মানুষ। ২৩ এপ্রিল থেকে ঈদের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ৫০ শতাংশ টিকিট পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনে আর বাকি ৫০ শতাংশ টিকিট কাউন্টারে। তাই টিকিট কিনতে একদিকে মানুষ যেমন অনলাইনে চেষ্টা করছেন, তেমনি আবার অনলাইনে না পেয়ে অধিকাংশই ভিড় করছেন কমলাপুর রেল স্টেশনসহ ঢাকার ৫টি স্টেশনে।
গত দু’দিনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ যাত্রী গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই কমলাপুর রেলস্টেশনের কাউন্টারের সামনে দাঁড়ান। যারা লাইনের প্রথম দিকে, তারা গত দুই-তিনদিন টিকিট না পেয়ে একটানা এখানেই আছেন। ক্লান্ত শরীর নিয়ে কাউন্টারের সামনেই থাকা-খাওয়া করছেন সকাল ৮টায় টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার পরপরই দু’বার বিভ্রাটে পড়ে টিকিট বিক্রি কার্যক্রম। একেতো ধীর গতির সার্ভার তার ওপর লোডশেডিংয়ে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় টিকিট বিক্রি। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েন টিকিট প্রত্যাশীরা। মঙ্গলবারও অনলাইন বিপর্যয়ে নাজেহাল টিকিটপ্রত্যাশীরা। সার্ভার জটিলতায় বিপর্যস্ত হাজার হাজার মানুষ ঢাকার যানজট পেরিয়ে ছুটে আসেন কাউন্টারে। কিন্তু এখানেও টিকিট না পেয়ে খালি হাতে ফিরে গেছেন অনেকেই।
এবারও টিকিট কালোবাজারির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এজন্য এবার কালোবাজারি বন্ধে টিকিট কেনার সময় যাত্রীদের জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদের ফটোকপি কাউন্টারে দেখাতে হচ্ছে। তবুও কালোবাজারি হচ্ছে ট্রেনের টিকিটে। এবার অবশ্য টিকিট হস্তান্তর হচ্ছে অন্যভাবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দালাল জানান, টিকিট ক্রেতার পরিচয়পত্র নিয়ে আসলে টিকিটের মূল্যের চেয়ে ২ থেকে ৩শ’ টাকা বেশি দিলে আমরা টিকিট কিনে দিতে পারবো। এমনই এক যাত্রী বিমানবন্দর স্টেশন থেকে টিকিট নিয়েছে ৩০০ টাকা বেশি দিয়ে। তিনি জানান, প্রথম দুইদিন স্টেশনে গিয়ে কোন টিকিট পাইনি। পরে একজনকে ৩০০ টাকা বেশি দিলে সে রংপুরের একটি টিকিট ব্যবস্থা করে দেন।
টিকেটপ্রত্যাশী শফিকুল বলেন, গত দুইদিন ধরে লাইনে দাঁড়িয়েছি কিন্তু টিকিট পাইনি। অনলাইনে টিকেট কাটার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি। এখন কাউন্টারই ভরসা। দীর্ঘ লাইন, টিকিট পাব কি না সেই আশা নেই।
সহজ ডটকমের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) ফারহাত আহমেদ বলেন, প্রতি মিনিটে ১০ লাখ মানুষ সার্ভার ভিজিট করছে। টিকিট থাকার পরিপ্রেক্ষিতে সবাই টিকিট পাচ্ছেন। যারা টিকিট পাচ্ছেন না, তারাই বিভিন্ন মিথ্যাচার করছে। আমাদের সিস্টেমে টিকিট সংরক্ষণ করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ যদি অতিরিক্ত টিকিট কাটে বা রাখে তাদের আমরা জিজ্ঞেসাবাদ করি। মোটকথা অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই।
কমলাপুর রেলস্টেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার জানিয়েছেন, ঈদ যাত্রায় প্রতিদিন ৫৩ হাজার যাত্রী ট্রেনে ঢাকা ছাড়তে পারবেন। এরমধ্যে শুধু আন্তঃনগর ট্রেনে আসন থাকবে ২৭ হাজার। এখন সবাই যদি ট্রেনে যেতে চান সেটা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। এক মিনিটে ১৮ লাখ হিট পড়েছে। এই এক মিনিটেই ১৩ হাজার যাত্রী টিকিট কিনেছেন। ট্রেনের ই-টিকিট দেখভাল করা প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকমের সঙ্গে কথা বলেছি। আজ (গতকাল) ১৫ থেকে ১৮ লাখ মানুষ একসঙ্গে অনলাইনে প্রবেশ করেছেন। এদের মধ্যে ১৭ লাখ ৮৭ হাজার টিকিট প্রত্যাশী টিকিট পাননি।
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলছেন, রেলের কর্মীদের টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়টি সঠিক নয়। কারণ যার টিকিট তাকেই এনআইডি নম্বর দিয়ে কাটতে হচ্ছে। কাজেই এখানে কালোবাজারির সুযোগ কই? ঈদে ৫০ লাখ মানুষ প্রতিদিন রাজধানী ছাড়বে। অথচ রাস্তার সক্ষমতা হলো মাত্র ১৫ লাখ। অনলাইনে সবাই টিকিট পাবেন না। পাঁচ লাখ মানুষ যদি যেতে চায়, আমি তো সবাইকে টিকিট দিতে পারবো না। কালোবাজারি করে টিকিট যে নেবে তার তো লাভ হতে হবে, কিন্তু এখানে তো সেই সুযোগই নেই। অনেকেই সহজের ব্যাপারে অভিযোগ দিয়েছেন। এনআইডি কার্ড দিয়েই তারা বিক্রি করেছে। তারা অর্ধেক বিক্রি করছে আর আমরা অর্ধেক কাউন্টারের মাধ্যমে বিক্রি করছি।###
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন