রাজধানীর সব থেকে বেশি বায়ু দূষণ হয় শাহবাগে এবং বেশি শব্দদূষণ গুলশান-২ এলাকায় বলে জানিয়েছে পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়াম। বায়ুদূষণ রোধে হাইকোর্ট দফায় দফায় নির্দেশনা দিলেও তা মানা হচ্ছে না বলর দাবি করেছে সংগঠনটি।
রোববার (২৯ মে) রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করে সংগঠনটি। ঢাকা শহরে বায়ু ও শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশগত প্রশমন ব্যবস্থা ও আইনের কার্যকর প্রয়োগের দাবিতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
বক্তারা বলেন, রাজধানী ঢাকাকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে একটি বাসযোগ্য নগরী হিসাবে গড়ে তুলতে দূষণবিরোধী শক্তিশালী নাগরিক প্রচেষ্টা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে USAID এর অর্থায়নে এবং কাউন্টারপার্ট ইন্টারন্যাশনালের সহায়তায় দূষণবিরোধী অ্যাডভোকেসি প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ এবং স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রকে (ক্যাপস) সাথে নিয়ে ‘ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়াম’ গঠন করেছে। এই দূষণবিরোধী অ্যাডভোকেসি কর্মসূচিটি ঢাকা শহরের বায়ু এবং শব্দ দূষণ পরিমাপসহ ঢাকার চারপাশের নদীরগুলোর পানি দূষণের অবস্থাও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যালোচনা করছে। ক্যাপস ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত মোট ১ বছর ঢাকা শহরের ১০টি স্থান যথাক্রমে আহসান মঞ্জিল, আবদুল্লাহপুর, মতিঝিল, শাহবাগ, ধানমন্ডি-৩২, সংসদ এলাকা, তেজগাঁও, আগারগাঁও, মিরপুর-১০ এবং গুলশান-২ এর বায়ু ও শব্দ মানের তথ্য উপাত্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে।
সংবাদ সম্মেলনে বায়ু দূষণ গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়, প্রাপ্ত ১ বছরের বায়ুর উপাত্ত সমূহকে বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের বায়ুমান সূচক অনুযায়ী অবস্থা ‘অস্বাস্থ্যকর’। যেখানে বস্তুকণা ২ দশমিক ৫ গড় বার্ষিক উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ৭৭ মাইক্রোগ্রাম, যা বার্ষিক আদর্শমান (১৫ মাইক্রোগ্রাম) এর থেকে গড়ে প্রায় ৫.১ গুণ বেশি এবং বস্তুকণা ১০ গড় বার্ষিক উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ১০৫ মাইক্রোগ্রাম, যা বার্ষিক আদর্শমান (৫০ মাইক্রোগ্রাম) এর থেকে গড়ে প্রায় ২.১ গুণ বেশি।
ওই ১০টি স্থানের মধ্যে সর্বোচ্চ বায়ুদূষণ পরিলক্ষিত হয়েছে শাহবাগ এলাকায়, সেখানে বস্তুকণা ২ দশমিক ৫ গড় বার্ষিক উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটার ৮৫ মাইক্রোগ্রাম অর্থাৎ আদর্শমান (১৫ মাইক্রোগ্রাম) থেকে ৫.৬ গুণ বেশি এবং সর্বনিম্ন বায়ুদূষণ পরিলক্ষিত হয়েছে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায়, সেখানে বস্তুকণা ২.৫ গড় বার্ষিক উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটার ৭০ মাইক্রোগ্রাম অর্থাৎ আদর্শমান (১৫ মাইক্রোগ্রাম) থেকে ৪.৬ গুণ বেশি।
এই প্রাপ্ত তথ্যকে ঋতুভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, বস্তুকণা ২.৫ এবং বস্তুকণা ১০ এর উভয় ক্ষেত্রেই শীতকালে দূষণের আধিক্য বেশি। যেখানে বস্তুকণা ২.৫ এর পরিমাণ গড়ে ১২৭ মাইক্রোগ্রাম অর্থাৎ ৮.৪ গুণ বেশি এবং বস্তুকণা ১০ পরিমাণ গড়ে ১৬২ মাইক্রোগ্রাম অর্থাৎ ৩.২ গুণ বেশি। বায়ু দূষণের তীব্রতায় ২য় ও ৩য় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে প্রাক-বর্ষা এবং বর্ষা পরবর্তী সময়। বায়ুমান ভালো ছিল বর্ষাকালে, যদিও দূষণ তুলনামূলকভাবে বর্ষাকালে কম হয়েছে তথাপি বস্তুকণা ২.৫ এর পরিমাণ গড়ে ৭৭ মাইক্রোগ্রাম অর্থাৎ ২.৬ গুণ বেশি এবং বস্তুকণা ১০ পরিমাণ গড়ে ৬২ মাইক্রোগ্রাম অর্থাৎ ১.২ গুণ বেশি ছিল।
শব্দ দূষণ গবেষণার ফলাফল হিসেবে বলা হয়- ঢাকা শহরের ১০টি জরিপ এলাকা মধ্যে গুলশান-২ তে শব্দের সর্বোচ্চ মান পাওয়া গিয়েছে যেখানে Leq বা ধারাবাহিক ভাবে যে মাত্রায় (সমতুল্য) শব্দ মান ছিল ৯৫.৪৪ ডেসিবল যা আবাসিক এলাকার জন্য দিনের বেলার জাতীয় আদর্শ মান (৫৫ ডেসিবল) থেকে ১.৭ গুণ বেশি এবং পরের অবস্থানে রয়েছে আব্দুল্লাহপুর সেখানের শব্দের Leq মান ৯৫.৪৩ ডেসিবল যা মিশ্র এলাকার জন্য দিনের বেলার জাতীয় আদর্শ। মান (৬০ ডেসিবল) থেকে ১.৬ গুণ বেশি। অপরদিকে তেজগাঁও এলাকায় সর্বনিম্ন Leq মান ছিল ৮৯ ডেসিবল যদিও এটি শিল্প এলাকার জন্য দিনের বেলায় জাতীয় আদর্শ মান (৭৫) থেকে ১.১ গুণ বেশি। এই জরিপকৃত স্থানগুলোর মধ্যে, সর্বাধিক (১৩২ ডেসিবল) শব্দ রেকর্ড হয়েছিল গুলশান-২ এলাকায় এবং সর্বনিম্ন শব্দ রেকর্ড হয়েছিল (৩১.৭ ডেসিবল) জাতীয় সংসদ এলাকায়। দেখা যাচ্ছে যে, সকল এলাকায় উপাত্ত সংগ্রহের মোট সময়ের ১০ শতাংশ সময় গড়ে ৮৩.৬২ ডেসিবল এর উপরে শব্দ ছিল, যেখানে ৫০ শতাংশ সময় গড়ে ৭০.২ ডেসিবল এর উপরে শব্দ ছিল এবং ১০ শতাংশ সময় শব্দের মাত্রা গড়ে ৫৬.২৩ ডেসিবল এর বেশি ছিল।
১০টি স্থানের প্রাপ্ত উপাত্ত সমূহকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, নীরব এলাকায় ৯৬.৭ শতাংশ সময় আদর্শ মান (৫০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, আবাসিক এলাকায় ৯১.২ শতাংশ সময় আদর্শ মান (৫৫ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, মিশ্র এলাকায় ৮৩.২ শতাংশ সময় আদর্শ মান (৬০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, বাণিজ্যিক এলাকায় ৬১ শতাংশ সময় আদর্শ মান (৭০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে এবং শিল্প এলাকায় ১৮.২ শতাংশ সময় আদর্শ মান (৭৫ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে। সমগ্র ঢাকা শহরেকে মিশ্র এলাকার সাথে তুলনা করলে ১০টি স্থানেই ৮২ শতাংশ সময় ৬০ ডেসিবল এর উপরে শব্দ পাওয়া গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে যেসব দাবি উত্থাপন করা হয় তা হলো-
১. গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় ঢাকা শহরের বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ চলমান নির্মাণ প্রকল্পসমূহ। আমাদের দাবি সকল নির্মাণ প্রকল্পে নির্মাণবিধি মেনে সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও নিয়মিত তদারকি নিশ্চিত করতে হবে।
২. বায়ুদূষণ রোধে মহামান্য হাইকোর্ট দফায় দফায় নির্দেশনা দিলেও বাস্তবে আমরা হাইকোর্টের এই নির্দেশনাগুলোর মান্যতা দেখছি না। হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এবং অমান্যকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই। খসড়া নির্মল বায়ু আইন ২০১৯ অধিকতর সুস্পষ্ট করে চুড়ান্ত করার এবং তা যতদ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করার দাবি জানাচ্ছি।
৩. শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-এ এর সংজ্ঞা অনুযায়ী চিহ্নিত জোনসমূহে (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) সাইনপোস্ট উপস্থাপন করে জনসাধারণকে সচেতন করা ও তা মান্যতার ব্যাপারে নিয়মিত মনিটরিং করার দাবি জানাচ্ছি।
৪. শব্দের উপাত্ত বিশ্লেষণে গাড়ির তীব্র হর্ণের অনেকগুলো পিক (উচ্চ শব্দ) লক্ষনীয় ছিল, সাধারণ জনগণের নিকট আমাদের দাবি, আপনারা প্রয়োজন ছাড়া হর্ণ বাজাবেন না, বিশেষ করে নীরব এলাকায় অযথা হর্ণ বাজাবেন না। সন্ধ্যার পর উচ্চস্বরে গান বাজাবেন না ও নির্মাণ কাজ করবেন না।
৫. পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষন স্টেশন (ক্যামস) এর ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে এবং নিয়মিত শব্দ মান পর্যবেক্ষণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে ঢাকা শহরের সব এলাকাকে এর আওতাধীন করতে হবে। এছাড়াও বায়ু দূষণের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচলন করতে হবে এবং পরিবেশ বিসিএস ক্যাডার নিয়োগের দাবি জানাচ্ছি।
৬. জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ রক্ষায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, আইন প্রণেতা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সংবাদকর্মী ও উদ্যোক্তাদের নিয়ে অবিলম্বে সমন্বিত, অংশীদারিত্বমূলক, বিজ্ঞানভিত্তিক, টেকসই ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন— ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার, জাহাঙ্গীরনগর ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. নুরুল ইসলাম প্রমুখ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন