মেয়েটির নাম আকলিমা। বয়স এক বছর। গ্রামবাসীর সামনেই একেবারে দুর্বল হয়ে গেছে সে। মা রেহানা বানু (২৫) তাকে পর্যাপ্ত বুকের দুধ দিতে পারেনি। ¯েœহময়ী সন্তানের প্রতি তেমন নজরও দিতে পারেনি মা। অভাব রেহানার সংসারের নিত্যসঙ্গী। সংসার চালানোর জন্য সে ৩০টি মুরগি পালে। সব মুরগিই ডিম দেয়। অভাবের সংসার। ডিম বিক্রি করে সংসার চালায় রেহানা। আকলিমাকে কখনো একটি ডিমও খাওয়াতে পারেনি এবং নিজেও ডিমের স্বাদ পায়নি রেহানা। অযতœ আর অবহেলায় আকলিমা দিন দিন শুকিয়ে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। মা রেহানার শরীরও শুকিয়ে যাচ্ছে। রেহানার বুকের দুধ শুকিয়ে গেছে। পুষ্টির অভাবে এ অবস্থা হয়েছে তাদের। নানা অসুখ এখন তাদের নিত্যসঙ্গী। এমনি একটি সময় স্বাস্থ্যকর্মী মরিয়মের সাথে তাদের দেখা হয়। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় মরিয়ম। অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে আকলিমার ও মা রেহানা বানুর। সম্পূরক খাবার কম খরচে কীভাবে শিশুকে খাওয়াতে হয় সে সম্পর্কে শিখিয়ে দেন মরিয়ম। সিরাজগঞ্জের যুমনা সেতুর পশ্চিম থানার পাশের গ্রামেই রেহানা বানুর (২৫) বাড়ি। স্বামী মোখলেসুর রহমান (৩৫) একজন দিনমজুর। খুব কষ্টে দিন কাটে তাদের। ইতোমধ্যে তাদের ঘরে আসে নতুন মেহমান আকলিমা। জন্মের পর আকলিমার স্বাস্থ্য ভালো ছিল। মা রেহানার বুকেও ছিল পর্যাপ্ত দুধ। পুষ্টির অভাব ছিল না মা রেহানা বানু ও শিশু আকলিমার। এক বছরের ব্যবধানে আকলিমার স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। রেহানাও শুকিয়ে যায়। শিশু আকলিমা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। নানা রোগে আক্রান্ত হতে থাকে সে। অভাব যার সংসারে নিত্যসঙ্গী, তার পক্ষে ডাক্তারের পরামর্শ সম্ভব নয়। তাই রেহানার স্বামী মোখলেসুর রহমান থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগাযোগ করেন। আকলিমাকে নিয়ে যান স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। স্বাস্থ্যকর্মী মরিয়মের পরামর্শে মা রেহানা সব ডিম বাজারে বিক্রি না করে পুষ্টিকর খাবার হিসেবে ডিম নিজে খান এবং আকলিমাকে খাওয়ান। সেই সাথে রেহানা বাড়ির আশপাশে শাক-সবজির চাষ করেন এবং সেখান থেকে টাটকা-সতেজ শাক-সবজি খাওয়া শুরু করেন। তিনি বুঝতে পারেন, পুষ্টিকর খাবারের অভাবেই শিশু আকলিমা দুর্বল হয়ে গেছে। এ জন্য সে ভীষণ অনুতপ্ত। দুর্বলতা কাটিয়ে উঠছে আকলিমা। তার স্বাস্থ্যও ভালো হচ্ছে।
রেহানার বুকেও এখন দুধ আসছে। রেহানা বানুর দেখাদেখি গ্রামের অন্যান্য দরিদ্র শ্রেণির মায়েরাও স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দিচ্ছেন এবং পুষ্টির ঘাটতি পূরণের জন্য পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছেন। এ গ্রামের সকল নারীই রেহানার মতো এখন স্বাস্থ্যের প্রতি আগের চেয়ে যতœবান। স্বাস্থ্য খাতে বর্তমান সরকারের সাফল্য প্রশংসনীয়। বর্তমান সরকার জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এ কর্মসূচিতে মহিলা, শিশু বয়স্ক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও প্রজনন স্বাস্থ্য (জবঢ়ৎড়ফঁপঃরাব ঐবধষঃয) ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা এবং টেকসই উন্নয়নের বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এতে দেশে মা ও শিশু মৃত্যু হার হ্রাস পেয়েছে। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত হয়েছে। নিরাপদ প্রসব সেবা গ্রামীণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। বগুড়ায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতাল স্থাপন, কুমিল্লা মেডিকেল হাসপাতালকে ৫০০ শয্যায় উন্নীতকরণ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ৫০০ থেকে ১ হাজার শয্যায় উন্নীতকরণসহ দেশব্যাপী সকল হাসপাতালের বেড সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে বর্তমান সরকার। হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়েছে। সেই সাথে সরকারি হাসপাতালগুলোতে গাইনি ও শিশু চিকিৎসা বিভাগের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। আর্সেনিকোসিস রোগ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬১টি জেলায় খাবার পানিতে যে অতিরিক্ত মাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে, সেসব জেলা ও উপজেলায় ১ হাজার ৫০০ চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এ চিকিৎসকরা দক্ষতার সাথে কাজ করেছেন। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুদের ছয়টি প্রতিরোধযোগ্য রোগের টিকা ও ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী মায়েদের টিটি টিকা প্রদান করা হচ্ছে। এ কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য সাফল্যের ধারাবাহিকতায় সরকার সারা দেশে হেপাটাইটিস-বি রোগে টিকা প্রদান কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। টিকাদান কর্মসূচি সফল হওয়ায় বিগত বছর গুলোতে নতুন করে কোনো পোলিও রোগ দেখা যায়নি। বিভিন্ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মোট ৩ হাজার ৬১৭ জনকে, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে ৩০৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এ সরকারের আমলে পদোন্নতি কার্যক্রম নিয়মিতকরণ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ সংস্থাসমূহে যেসব পদ শূন্য রয়েছে তা পূরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এইচআইভি/এইডস রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে সরকার জাতীয় এইডস নীতি ও কৌশল প্রণয়ন করেছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি প্রজনন স্বাস্থ্য, জরুরি প্রসব সেবা ও চিকিৎসা প্রদান করছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়েছে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা। সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য কর্মীগণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও চিকিৎসা এবং পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন। কিন্তু এর পরেও মহিলা ও শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির মানের যে উন্নতি হচ্ছে তার গতি মন্থর। এ জন্য প্রয়োজন জনগণের অংশ (ঈড়সসঁহরঃু চধৎঃরপরঢ়ধঃরড়হ) এ ব্যাপারে সমাজের শিক্ষিত ও সচেতন জনগোষ্ঠী-বিশেষ করে শিক্ষক, ইমাম, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, জনপ্রতিনিধি ও ছাত্র-ছাত্রীদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তারা সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা ও পরামর্শ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে তা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। গণমাধ্যম-বিশেষ করে বেতার ও টেলিভিশন বিভিন্ন স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেন।
য় পিআইডিফিচার
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন