বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ শেষ না হতেই পৃথিবীতে আরেক সংক্রামক ভাইরাস মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। মাঙ্কিপক্স একটি ‘একেবারে বিরল ও স্বল্প পরিচিত’ রোগ। এটা মাঙ্কিপক্স প্রজাতির ভাইরাসের মাধ্যমে হয়ে থাকে এবং ইঁদুর ও কাঠবিড়ালির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঙ্কিপক্স সিরিয়াস কোনো রোগ নয়। কেউ এখনো মারা যায়নি। ইউরোপের দেশ যুক্তরাজ্য, স্পেন, পর্তুগাল, জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি ও সুইডেন এবং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রলিয়ায় মাঙ্কিপক্সের রোগী পাওয়া গেছে।
সর্বপ্রথম বানরের দেহে শনাক্ত হওয়া এ রোগটি এর আগে আফ্রিকার বাইরে দেখা যায়নি। তবে বাংলাদেশের এ নিয়ে কোনো আতঙ্কের কারণ নেই। জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে গুটি বসন্তের (স্মলপক্স) যে টিকা এটা যদি দেয়া যায় তাহলে ৮০ বা ৮৫ ভাগ প্রটেকশন দিতে পারে। মাঙ্কিপক্স আমাদের রিসার্চ পর্যায়ে রয়েছে। অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দেশেও আসতে পারে। তবে এটা নিয়ে সতর্কতা থাকা ভাল আতঙ্কের কিছু নেই।
উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে ভাইরাসজনিত বিরল রোগ মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় আগাম সতর্কতা অবলম্বন করছে বাংলাদেশ। এ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশের প্রতিটি বন্দরে সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নির্দেশনা অনুযায়ী ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের অন্যান্য আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে সতর্কতা জারি করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বিশেষ করে আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আসা যাত্রীদের ওপর সজাগ দৃষ্টিসহ স্ক্রিনিং জোরদার করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিমানবন্দরে তুরস্কের এক নাগরিককে মাঙ্কিপক্স রোগী হিসেবে সন্দেহ করা হলেও পরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, ওই রোগী মাঙ্কিপক্স নয়, চর্মরোগে আক্রান্ত। তারপরও মাঙ্কিপক্স নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি ও কৌতুল সৃষ্টি হয়েছে। দেশের ডাক্তাররাও মাঙ্কিপক্স নিয়ে জানার চেষ্টা করছেন।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ইনকিলাবকে বলেন, দেশে এখনো মাঙ্কিপক্সের অস্তিত্ব নেই। এটি করোনার মতোই। তাই মাঙ্কিপক্স নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। এটা স্মল পক্সের মতোই। স্মল পক্সের টিকা আমাদের আছে। তবে ওই টিকা মাঙ্কিপক্সের জন্য সঠিক কিনা সে নিয়ে গবেষণা চলছে। একই সঙ্গে মাঙ্কিপক্স সন্দেহ হওয়া তুর্কি নাগরিক আক্কোশ আলতের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠনো হয়েছে। পরীক্ষার ফলাফল আসলে সঠিকভাবে বলা যাবে কি রোগ। তবে সরিয়োসিস নামের এক ধরনের চর্ম রোগে তিনি আক্রান্ত বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ রোগে আক্রান্তদের শরীরে ফুসকুড়ি দেখা যায়। মাঙ্কিপক্সের নিশ্চিত রোগী পাওয়া গেছে- এমন দেশে সম্প্রতি যারা ভ্রমণ করেছেন, অথবা এমন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, যাদের একই রকম ফুসকুড়ি দেখা গেলে বা নিশ্চিত বা সন্দেহজনক মাঙ্কিপক্সের রোগী হিসেবে শনাক্ত হলে, সেই রোগীদের মাঙ্কিপক্সের সন্দেহজনক রোগীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সন্দেহজনক এবং লক্ষণযুক্ত রোগীদের কাছের সরকারি হাসপাতাল বা ঢাকার সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ধরনের ব্যক্তির তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা এবং আইইডিসিআরে পাঠানোর নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
করোনাভাইরাসের মধ্যেই ৭ মে প্রথম একজন ইউরোপীয় নাগরিকের দেহে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার উষ্ণ ও আর্দ্র বনাঞ্চলের বানররা ছিল এ রোগের প্রথম শিকার। এরপর একসময় মানবদেহেও সংক্রমণ ঘটায় এই ভাইরাসটি। সাধারণত হালকা ভাইরাল সংক্রমণের জন্য দায়ী এই ভাইরাস। ভাইরাসটি গুটিবসন্তের মতো ভাইরাল প্রজাতির সদস্য। এই প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ভেরিওলা ভাইরাস, ভ্যাক্সিনিয়া ভাইরাস ও কাউপক্স ভাইরাস।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের কঙ্গো প্রজাতি ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতি নামক দুই প্রজাতির সন্ধান মিলেছে। এই দুইয়ের মধ্যে কঙ্গো প্রজাতির চেয়ে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতির তীব্রতা তুলনামূলক কম। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে কঙ্গো প্রজাতিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যুর হার ১০ শতাংশের বেশি। তবে বাচ্চাদের মৃত্যুর আশঙ্কা আরও বেশি। অন্যদিকে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর হার ১ শতাংশের মতো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঠিক কোন প্রজাতির মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের দ্বারা রোগীরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তা সঠিকভাবে এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। তবে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে প্রাথমিক উপসর্গের মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, পিঠ ও গায়ে প্রচণ্ড ব্যথার মতো লক্ষণ। কাঁপুনি ও ক্লান্তি দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া দেহের বিভিন্ন লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠে। সেই সঙ্গে মুখে ছোট ছোট ক্ষতচিহ্ন দেখা দিতে থাকে। ধীরে ধীরে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে সেই ক্ষত। ফাটা বা অমসৃণ খসখসে ত্বক (যদিও তা দেখা যায় না), শ্বাসতন্ত্র অথবা চোখ, নাক ও মুখ, সংক্রমিত প্রাণীর কামড়, আক্রান্ত প্রাণী অথবা মানুষের রক্ত, শরীরের তরল বা পশম স্পর্শ করা, সংক্রমিত প্রাণীর মাংস সঠিকভাবে রান্না ছাড়া খাওয়া হলে, ফুসকুড়ি রয়েছে এমন কারও ব্যবহৃত পোশাক, বিছানা অথবা গামছা স্পর্শ করা, মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত কারও ত্বকের ফোসকা অথবা খোসপাঁচড়া স্পর্শ করা অথবা সংক্রমিত ব্যক্তির কাশি ও হাঁচির খুব কাছাকাছি যাওয়ার মাধ্যমে মাঙ্কিপক্স ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে।
নতুন এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে দেখা যাওয়ার আশঙ্কা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. তিনি বলেন, এখন কত দেশ থেকে কত লোকজন আসে। কেউ ভাইরাস বহন করে আনলে হতেই পারে। মাঙ্কিপক্সে মৃত্যুর ঝুঁকি নেই তবে আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। কাউকে সন্দেহ হলে তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে। আইসোলেট করতে হবে। এ নিয়ে আতঙ্কের কোনো কারণ দেখি না। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন