অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছেন। গোপালগঞ্জের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব চক্ষু হাসপাতালের নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালে নির্মাণকাজে নয়-ছয় করে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। অবশ্য প্রতিষ্ঠানটির ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণকাজের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সাময়িক বরখাস্ত, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি এক বছরের জন্য স্থগিত রেখে লুঘুদণ্ডে দণ্ডিতও করে। যদিও সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শাস্তির মাত্র আট মাসের মধ্যে প্রভাব খাটিয়ে পদোন্নতিও নিয়েছেন। তবে এখানেও থেমে থাকেননি এবার নিজের পরিবারের সম্পত্তি জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাতের চেষ্টা করছেন। নিজের আপন ছোট ভাই, পিতার সম্পত্তি রক্ষায় প্রতিবাদ করলে তাকেও মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছেন। এরই মধ্যে আপন ছোট ভাই প্রদীপ কুমার বসু নিজ এলাকা মাগুরার মহম্মদপুর থানায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ডায়েরি এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গত ৩০ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যানকে লিগ্যাল নোটিশ প্রদাণ করেছেন। এদিকে আগামী জুলাই মাসে অবসরে যাচ্ছেন বলে গত কিছুদিন থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা শত শত কোটি টাকা পাচারের চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি অর্থপাচারের দীক্ষ্মা নিতে আলোচিত অর্থপাচারের হোতা পলাতক পি কে হালদারের সঙ্গে ভারতে দেখাও করেছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। যদিও পি কে হালদার বর্তমানে ভারতের কারাগারে আছেন। এতক্ষণ বলছিলাম গণপূর্ত অধিদফতরের ঢাকা মেট্রোপলিটন জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার বসুর কথা।
নানাবিধ অপকর্মের হোতা প্রদীপ কুমার বসু’র অনিয়ম এখানেই শেষ নয়; গণপূর্ত অধিদফতরের বিতর্কিত ঠিকাদার গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়টিও উঠে এসেছে। দুর্নীতি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার পর সাময়িক বরখাস্ত, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি এক বছরের জন্য স্থগিত রাখার লঘুদণ্ডের পরও আট মাসের মধ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব শহিদ উল্লাহ খন্দকার স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে মাত্র আট মাসের মধ্যে পদোন্নতি দেয়ার নেপথ্যে বিশাল অঙ্কের ঘুষ লেনদেন হয়েছে বলে ইতিমধ্যে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে। এ ক্ষেত্রে ঠিকাদার গোল্ডেন মনির প্রদীপ কুমার বসু’র পক্ষ নিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করেছেন উৎকোচ হিসেবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, পরিপত্র গোপন রেখে শাস্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আট মাস আগে প্রদীপ কুমার বসুকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। ১৫তম বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার বসুকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে মূল ব্যাচের সঙ্গে ধারণাগত সিনিয়রিটি দেয়ার বিধিগত সুযোগ ছিল না। তার পরও পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দুদক গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানিয়েছে। পাশাপাশি মনির এ পদোন্নতির জন্য কাকে কাকে ঘুষ দিয়েছেন সেটিও খতিয়ে দেখবে দুদক। দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, প্রদীপ কুমার বসুকে ইতিমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। প্রয়োজনে আবার তলব করে এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হবে। কমিশন এরই মধ্যে তার আত্মীয়স্বজনের নাম-ঠিকানা ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিয়েছেন। সেগুলো জব্দ করার প্রক্রিয়া চলছে।
এদিকে ঠিকারদারকে সঙ্গে যোগসাজশ করে সরকারের কোটি কোটি টাকা লুটপাট করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কিছু কিছু অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর প্রদীপ কুমারকে শাস্তিও পেতে হয়। তার বিরুদ্ধে আরও যেসব অভিযোগ রয়েছে সেই সব অভিযোগ তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়। বিধি অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে লঘুদণ্ড কার্যকর করা হলে ওই দণ্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর পার না হওয়া পর্যন্ত তিনি পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হবেন না। কিন্তু তিনি দণ্ড গোপন রাখতে ও বিধিবহির্ভূতভাবে পদোন্নতি নিতেও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। প্রদীপ কুমারের বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। অনেক অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। সব শেষ প্রদীপ কুমার বসু’র আপন ভাই (সহোদর) প্রশান্ত কুমার বসু গত ২২ মে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। ওই লিখিত অভিযোগের অনুলিপি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, দুদক চেয়ারম্যান ও গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীকে দেয়া হয়েছে।
দুদক বরাবর লিখিত অভিযোগে প্রদীপ কুমার বসুর ভাই প্রশান্ত কুমার বসু জানিয়েছেন মাগুরায় দায়িত্ব পালনকালে ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে অবৈধ উপায়ে মোটা অঙ্কের সরকারি টাকা আত্মসাতের বিভিন্ন নথি দিয়েছেন। পাশাপাশি প্রদীপ কুমার বসু গোপালগঞ্জের উপ-বিভাগী প্রকৌশলী থাকাকালে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবজ্ঞা করা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের মাজারের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের কারণে ওই সময়ে তাকে লঘুদণ্ড হিসেবে সতর্ক করা হয়।
এছাড়া দরপত্র মূল্যায়ন ও ম্যানুপুলেশনের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় একাদশ জাতীয় সংসদের পিএ কমিটির ১২তম বৈঠকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে যোগসাজশে স্বর্ণ চোরাচালান, রাজউক ও গণপূর্ত অধিদফতরের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশে ভূমি দখল, দুই শতাধিক প্লট ও হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জন এবং মানি লন্ডারিং সহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ করা হয়েছে। যা বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে।
এদিকে ঢাকা গণপূর্ত মেট্রোপলিটন জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে দায়িত্ব পালন অবস্থায় প্রদীপ কুমার বসু’র বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এজন্য তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর বিধি ৩ এর উপ-বিধি (খ) অনুযায়ী বিভাগী মামলা দায়েরের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু তিনি এই মামলা দায়েরকে বাধাগ্রস্ত করতেও অত্যন্ত সুকৌশলে দুর্নীতির আশ্রয় নেন। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি অসাধু চক্রকে বড় অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে বিভাগীয় মামলা ও বিভিন্ন অনিয়ম থেকে বাঁচতে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র মতে, প্রদীপ কুমার বসু নিজে এবং স্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সড়ক ও জনপথ অধিদফতর গোপালগঞ্জ তাপসী দাস অনিয়মের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে সম্পত্তি গড়েছেন। সম্প্রতি প্রদীপ প্রায় ৬০ লাখ টাকায় নিজের নামে নিশান এক্স-টেল ঢাকা মেট্রো-ঘ-২১-৫৮৭৫ গাড়িও কিনেছেন।
বিভাগীয় মামলার তদারকির দায়িত্বে থাকা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মমতাজ উদ্দিনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে প্রদীপ কুমার বসুর সঙ্গে একাধিকবার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে কখনও মিটিংয়ে, কখনো ব্যস্ত, পরে কল দিবেন বলে জানান। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেননি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন