যুগে যুগে সমাজ ও রাষ্ট্রে অন্যায়-অবিচার ও তাওহীদ বিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিবাদ এবং এর পরিণাম সতর্ক করেছেন আম্বিয়ায়ে কিরাম। নবী-রাসূলগণ এ প্রতিবাদ নিজ থেকে করেননি। করেছেন আল্লাহর তাআলার হুকুমে। তাঁর নির্দেশ পালনে। তাঁদের পর পবিত্র এ দায়িত্ব ও কর্তব্য আসে উলামায়ে কিরামের কাঁধে। আলেম সমাজ এ দায়িত্ব নিজ থেকে নেননি; বরং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই তা অর্পণ করে গেছেন তাঁদের উপর। অন্য কারো উপর নয়। সাহাবী আবূ দারদা রা. এর বাচনীক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নিশ্চয় আলেম সমাজ আম্বিয়ায়ে কিরামের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী। নিশ্চয় নবীগণ দীনার-দিরহামের [ধন-সম্পদ] ওয়ারিছ বানান না। তাঁরা কেবল ইলমের ওয়ারিছ বানান। [তিরমিযী, হাদীস:২৬৮২; ইবনে মাজা, হাদীস:২২৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস:২১৭১৫] নবীজীর পবিত্র এ হাদীস প্রমাণ করে নবী-রাসূলগণের সকল জিম্মাদারীর একমাত্র ওয়ারিছ আলেম সমাজ। তাই আমাদের প্রাণের নবীর ইন্তিকালের পর সুদীর্ঘ দেড় হাজার বছরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, যখনই সমাজ বা রাষ্ট্রে ইসলাম ও কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো কর্মকান্ড দেখা দিয়েছে, তখনই সর্ব প্রথম সে কর্মকান্ডের অবৈধতা ও পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন আলেম সমাজ। এটি আলেম সমাজের মিরাছসূত্রে পাওয়া ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ দায়িত্ব তাঁরা এড়িয়ে যেতে পারেন না বা ভুলে থাকতে পারেন না। সে ঈমানী দায়িত্ব পালনকালে কোনো কথা বা উক্তি কোনো ব্যক্তি বা মতাদর্শের বিপক্ষে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ চটে না গিয়ে তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে কথা বলা উচিত। কুরআন-সুন্নাহসম্মত পন্থায় যুক্তির আলোকে শালীন ভাষায় পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দেওয়া যেতে পারে। আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, কুরআন-হাদীসের একমাত্র ধারক-বাহক আলেম সমাজ। অন্য কেউ নয়। তাই যে কোনো বিষয় বা পরিস্থিতির উপর কুরআন-সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যা তাঁদের কাছ থেকে জানার কোনোই বিকল্প নেই। অতএব কোনো অবস্থার প্রেক্ষাপটে মুসলমানের পক্ষ থেকে আলেম-উলামাদের শানে মিথ্যাচার, কোনো অশালীন ও বেআদবীমূলক কথা বা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ বা কথা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। কারণ আমাদের প্রধান ও প্রথম পরিচয় হলো, আমরা মুসলমান। আমরা মুমিন। অন্য সকল পরিচয় এর পরে। আর উলামায়ে কিরামের প্রতিবাদ বা সতর্ক করা তো কুরআন-হাদীসের কথাই। কাজেই প্রতিবাদ বা সতর্ক করার কারণে তাঁদেরকে গালমন্দ করা বা তাঁদের শানে কোনো অশালীন ও বেআদবীমূলক কথা বা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ বা উক্তি কিংবা তাঁদের উপর আক্রমণ অথবা তাঁদেরকে হত্যা করা কুরআন-হাদীসের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার নামান্তর। যা একজন মুমিন কখনো করতে পারে না। একটি কথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, কুরআন-হাদীসে আলেম সমাজকে যে মর্যাদা ও সম্মান দেওয়া হয়েছে, অন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে তা দেওয়া হয়নি। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সকল মানুষের মধ্যে কেবল আলেম সমাজই আল্লাহ তাআলাকে ভয় করেন।’ [সূরা ফাতির, আয়াত: ২৮] মুফাসিসরীনে কিরাম উক্ত আয়াতের আরেকটি অনুবাদ করেছেন। সেটি হলো, ‘সকল মানুষের মধ্যে আল্লাহ তাআলা কেবল আলেম সমাজকেই সম্মান করেন।’ [কুরতুবী:১৪/৩৪৪, সূরা ফাতির, আয়াত: ২৮] যে আলেম সমাজকে স্বয়ং আল্লাহ সম্মান করেন, তাঁদের শানে কোনো কটুক্তি করা বা তাঁদেরকে আঘাত করার আগে একজন মুসলমানের খুব ভালোভাবে ভাবা উচিত। সাহাবী আবূ দারদা রা. এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘একজন সাধারণ আবেদ [ইবাদতকারী] এর উপর একজন আলেমের শ্রেষ্ঠত্ব, সম্মান ও মর্যাদা তেমন, যেমন পূর্ণিমা রাতে চাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব, সম্মান ও মর্যাদা সকল তারকার উপর।’ [তিরমিযী, হাদীস:২৬৮২; ইবনে মাজা, হাদীস:২২৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস:২১৭১৫] পূর্ণিমা রাতে আকাশে চাঁদ উদিত হলে এক চাঁদের আলোতে আকাশের সকল তারকার সম্মিলিত আলো নিষ্প্রভ হয়ে যায়। তখন তারকার আলোর কোনো মূল্যই থাকে না। ঠিক সেভাবে একজন আলেমের সামনে সাধারণ মানুষ তো পরে একজন ভালোমানের আবেদও মূল্যহীন। মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র এ হাদীসের আলোকে এমনটিই প্রমাণিত হয়। সাহাবী আবূ উমামা বাহেলী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এমন দ্ইু ব্যক্তির আলোচনা করা হলো, যাদের একজন আলেম আরেকজন সাধারণ আবেদ [ইবাদতকারী]। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘একজন সাধারণ আবেদ এর উপর একজন আলেমের শ্রেষ্ঠত্ব, সম্মান ও মর্যাদা তেমন, যেমন আমার শ্রেষ্ঠত্ব, সম্মান ও মর্যাদা তোমাদের মাঝে সবচে নিম্ন মর্যাদার অধিকারী সাহাবীর উপর। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা, ফিরিশতা, আসমান-জমীনের অধিবাসী, এমনকি গর্তের পিপিলিকা ও পানির মাছ পর্যন্ত আলেম সমাজরে জন্য রহমতের দুআ করেন।’ [তিরমিযী, হাদীস: ২৬৮৫] পৃথিবীর এমন কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা জাতি আছে কি যাদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বলেছেন। আলেম সমাজের শ্রেষ্ঠত্ব, সম্মান ও মর্যাদা বুঝাতে গিয়ে কি অপূর্ব ভঙ্গিতে উপমা টেনেছেন তিনি। বাক্যগুলোর বর্ণনা শৈলী হাদীসটির মর্মবাণীকে জোরালো করেছে বহুগুণে। এ কথা কে না জানে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা ও সাহাবাগণের মর্যাদার মাঝে আকাশ-পাতালের ব্যবধান। আরও যদি সে সাহাবী হয় সবচেয়ে নিম্ন মর্যাদার সাহাবী। একজন আলেম ও একজন সাধারণ আবেদের মর্যাদার ব্যবধানও তদ্রুপ। এটি কি কোনো সাধারণ ব্যাপার যে, আলেম সমাজের জন্য স্বয়ং আল্লাহ তাআলা, ফিরিশতা, আসমান ও জমীনের অধিবাসী, এমনকি গর্তের পিপিলিকা ও পানির মাছ পর্যন্ত রহমতের দুআ করেন। আলেম সমাজের এ সম্মান ও মর্যাদা কি এমনিতেই হয়েছে? না, এমনিতেই হয়নি। এ জন্যই হয়েছে যে, আলেম সমাজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অর্পিত দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। কুরআন-হাদীসের বাণী প্রচার-প্রসার করেন। সমাজ ও রাষ্ট্রে নববী উসওয়াহ ও আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা-মুজাহাদা ও ফিকর করেন। এক কথায় আলেম সমাজ সব রকমের নববী জিম্মাদারী পালন করেন। তাই তাঁদের এত্তো মর্যাদা। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আলেম সমাজকে এতো সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করলেন, আমরা সেই নবীর উম্মত হয়ে কিভাবে তাঁদের শানে অশালীন ও ঔদ্ধত্বপূর্ণ কথা বলতে পারি! তাঁদের উপর হামলা-মামলা করতে পারি। তাঁদের গয়ে আঘাত করতে পারি। হত্যা করতে পারি। আলেম সমাজের সাথে এ জাতীয় আচার-আচরণ ও কথা-বার্তার পরিণাম কখনও শুভ হয় না। অনেক সময় তাঁদের কষ্ট ও বদদুআয় দুনিয়া-আখেরাতে অশুভ পরিণামের সম্মুখীন হতে হয়। দুটি ঘটনা বলি। ১. তখন উমর রা. মুসলিম জাহানের খলীফা। কুফার কিছুলোক কুফার তৎকালীন আমীর সাহাবী সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. এর ব্যাপারে তাঁর কাছে অভিযোগ করল যে, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. নামায সুন্দর করে আদায় করে না। এ জাতীয় আরও কিছু গুরুতর অভিযোগের প্রেক্ষিতে উমর রা. তাঁকে বরখাস্ত করে সাহাবী আম্মার রা.কে কুফার আমীর নিযুক্ত করলেন আর সাদ রা.কে নিজের কাছে ডেকে এনে বললেন, হে আবূ ইসহাক [সাদ রা. এর উপনাম] এ সকল লোকেরা বলে, তুমি নাকি নামায সুন্দর করে আদায় করো না। এ কথা শুনে সাদ রা. বললেন, আমীরুল মুমিনীন! আপনি শুনুন, আল্লাহর কসম! আমি তাদের ইমামতী সেভাবে করি যেভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায আদায় করেছেন। তার থেকে আমি কোনো কাটছাট করি না। আমি ইশার নামায পড়ি। প্রথম দুই রাকআত লম্বা করি আর শেষ দুই রাকআত তুলনামূলক সংক্ষেপ করি। (চলবে)
লেখক: প্রধান মুফতী ও সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া মিফতাহুল উলূম, নেত্রকোনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন