বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালির সংগ্রাম

আমির হোসেন আমু এমপি | প্রকাশের সময় : ২৬ জুন, ২০২২, ১২:০২ এএম

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

৬ দফাই পূর্ব পকিস্তানের একমাত্র রাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠে। পত্রপত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ৬ দফার প্রথম জনসভাটি হয়েছিলো ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ। পূর্ব পকিস্তানে ৬ দফার আন্দোলনই একমাত্র আন্দোলনে পরিগণিত হয়। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ৬ দফাকেই মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচনা করে। এত অল্প সময়ের মধ্যে ৬ দফা যে বাংলার প্রতিটি ঘরে পৌঁছে যাবে কেউই কল্পনা করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু প্রতিটি জনসভাতেই বলতেন, ওরা বেশি সময় দেবে না। দ্রুত নিজেদের আত্মত্যাগের জন্য তৈরি হতে হবে। ৬ দফা প্রচারে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য। ২০ মার্চের পর শেখ মুজিব সময় পেয়েছিলেন মাত্র ৫ সপ্তাহ। ৩৫ দিনে তিনি প্রায় ৩২ টি মূল জনসভায় বক্তব্য রাখেন। পল্টনের জনসভার সময় আইন মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো চ্যালেঞ্জ করেছিলেন যে, ৬ দফা পকিস্তানের জনগণের জন্য যে আত্মঘাতী তা তিনি প্রমাণ করতে পারবেন। শেখ মুজিব তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ভুট্টো আর আগাননি। ১৯৬৬ সালের ১৯ এপ্রিল খুলনায় তাকে গ্রেফতার করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। পরে যশোর পুলিশ তাকে যশোরে গ্রেফতার করে ঢাকায় রাষ্ট্রদ্রোহী ভাষণ দেয়ার অভিযোগে। সঙ্গে সঙ্গে জজকোর্ট থেকে জামিন নেয়া হয়। ২২ এপ্রিল মুজিব ঢাকা এসডিও কোর্টে হাজির হন। এসডিও তার জামিন বাতিল করে গ্রেফতারের আদেশ দিলে জজকোর্ট থেকে আবার জামিন নেয়া হয়। ২২ এপ্রিল রাত ১২টার সময় তাকে ৩২ নম্বর বাস ভবন থেকে গ্রেফতার করে সিলেট নিয়ে যাওয়া হয়, তিনি ১৯৬৬ সালের ৪ এপ্রিল সিলেটের জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন, সিলেট প্রশাসন রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করেছিলেন। ২৩ এপ্রিল সিলেট জজকোর্টে তার জামিন হলে জেলগেট থেকে বাহির হওয়ার আগেই পুলিশ ময়মনসিংহের ভাষণের মামলার জন্য তাকে গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ নিয়ে যায়। সিলেট প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ময়মনসিংহের জজকোর্টে জামিনের আবেদন জানানো হয় ১৯৬৬ সালের ২৫ এপ্রিল। জামিন মঞ্জুর হয়। ১৯৬৬ সালের ২৬ এপ্রিল তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সারা দেশে ৬ দফার প্রচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৯৬৬ সালের ৭ মে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় তিনি ৬ দফা আনোদলনের কর্মসূচি নতুন করে তৈরি করে দেন। ১৯৬৬ সারের ৮ মে তিনি নারায়ণগঞ্জে বিশাল জনসভা করলেন। এটাই ছিল তার ৬ দাফার শেষ জনসভা। সম্ভবত তিনি নিজেও তা আগে থেকেই জানতেন। বক্তৃতায় তিনি সকলকে বৃহত্তর আত্মত্যাগের আবহান জানিয়ে তদার নিজের আবস্থার কথাও ব্যাখ্যা করেছেন। ঐ দিনই গভীর রাতে ৩২ নম্বরের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে সরাসরি জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এবার তার বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতার অভিযোগ দাঁড় করানো হয় ৩২ দারা মোতাবেক, কঠোরতম দেশরক্ষা আইনে। বঙ্গবন্ধুসহ বন্দিদের মুক্তির দাবি এবং ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ১৩ মে পল্টনে জনসভা হয় এবং ২০ মে ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং থেকে ৭ জুন হরতালের কর্মসূচি দেয়া হয়।

৭ জুন হরতাল পালনের সময় তেজগাঁওয়ে বেঙ্গল বেভারেজের শ্রমিক সিলেটের মনু মিয়া গুলিতে প্রাণ হারান। এতে বিক্ষোভের প্রচন্ডতা আরও বাড়ে। তেজগাঁওয়ে ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। আদাজ এনামেল এ্যালুমনিয়াম কারখানার নোয়াখালীর শ্রমিক আবুল হোসেন ইপিআর এর গুলিতে শহীদ হন। বিকালের দিকে নারায়ণগঞ্জে রেলওয়ে স্টেশনের কাছে পুলিশের গুলিতে মারা যায় ৬ জন শ্রমিক। ঢাকা নারায়ণগঞ্জ সরকারের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করা হয়। দুই শহরে প্রায় এক হাজার গ্রেফতার হয়। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা নারায়ণগঞ্জের থানা থেকে বন্দিদের ছাড়িয়ে আনতেও দ্বিধা করে না। ফলে ১৯৬৬ সারৈর ১৩ জুনের মধ্যে আওয়ামী লীগের তৃতীয় সারির নেতারাও গ্রেফতার হয়। ১৫ জুন ইত্তেফাকের সম্পাদক মানিক মিয়াকেও গ্রেফতার করা হয়। ১৬ জুন ইত্তেফাক এবং নিউনেশন প্রিন্টিং প্রেস নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

১৯৬৮ সালের জানুয়ারি সরকারি প্রেসনোটে উল্লেখ করা হল, ভারতীয় হাই কমিশনের ফার্ষ্ট সেক্রেটারি মিস্টার ওঝার সঙ্গে যোগসাজশে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল সরকার তার বিরুদ্ধে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছেন। এ যাবৎ বিভিন্ন বিভাগের ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযুক্তের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। ইতিহাসে এটাই আগরতলা মামলা নামে পরিচিত, যদিও মামলার শিরোনাম ছিল শেখ মুজিবুর রহমান গং বনাম পাকিস্তান। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা জেলে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে জানানো হয়েছিল যে, তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। এটা ছিল গভীর রাতের ঘটনা। জেল গেটেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাওয়া হলো। উল্লেখ করা যেতে পারে, এবার ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা জেলে ছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালের ২৩ জুন সৈয়দ নজরুল ইসলামের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয় যা লিফলেট আকারে হাজার হাজার কপি সারোদেশে বিলি করা হয়েছিল। ওতে উল্লেখ ছিল ১৭ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা জেল গেট থেকে ধরে পশ্চিমা আর্মিরা কোথায় নিয়ে গেছ, কাউকে জানানো হয়নি। ১৯৬৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান সহ আগরতলা মামলায় অভিযুুক্ত সকলের মুক্তির দাবিতে দেশের প্রায় সবগুলো শহর থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। বহু গ্রেফতার হয়। ১৯৬৮ সারৈর ২১ এপ্রিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের এক অর্ডিনেন্সে জানানো হয় যে, পকিস্তান পেনাল কোডের ১২১ এবং ১৩১ ধারায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্যদের বিচার করা হবে। এ জন্য ঢাকায় বিশেষ একটি আদালত গঠন করা হয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এসএ রহমান ও পূর্ব পকিস্তান হইকোর্টের বিচারপতি মুজিবর ও মাকসুদুল হাকিমের সমন্বয় গঠিত কুর্মিটোলা সেনানিবাসের বিশেষ আদালতে ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন বিচার শুরু হয়। অভিযুক্তদের নাম এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। শেখ মুজিবুর রহমান, লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মজিবর রহমান, এলএস সুলতান আহমদ, এলএসডিআই নুর মোহাম্মদ, আহমদ ফজলুর রহমান সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ, আবুল বাশার মোহাম্মদ আবদুস সামাদ, প্রাক্তন হাবিলদার দলিল উদ্দিন, ফ্লাইট সার্জেন্ট মোহাম্মদ ফজলুল হক, খন্দকার রুহুল কুদ্দুস সিএসপি, বিভূতিভূষণ ওরফে মানিক চৌধুরী, বিধানকৃষ্ণ সেন, সুবেদার আবদুর রাজ্জাক, সার্জেন্ট জহিরুল হক, ক্লার্ক মজিবর রহমান, প্রাক্তন সার্জেন্ট মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক, প্রাক্তন এটি মোহাম্মদ খুরশিদ, খান এম শামসুর রহমান সিএসপি, হাবিলদার একেএম শামসুল হক, হাবিলদার আজিজুল হক, এএসপি মাহফুজুল বারী, সার্জেন্ট শাসমুল হক, মেজর শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আবদুল মোতালেব, ক্যাপ্টেন এম শওকত আলী, ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা, ক্যাপ্টেন এএনএম রহমান, প্রাক্তন সুবেদার এএকে তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী রেজা, ক্যাপ্টেন খুরশিদ উদ্দিন আহমদ ও ফার্স্ট লে. আবদুর রউফ।

১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী আগরতালা মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট ফজলুল হক ও সার্জেন্ট জহিরুল হকের উপর গুলি চালায়। সার্জেন্ট জহিরুল হক ঘটনাস্থলেই নিহত হন। কেউ কেউ এটা আইয়ুব খান বিরোধী সামরিক চক্রের ষড়যন্ত্র বললেও খবরটি ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লে প্রচন্ড বিস্ফারণ ঘটে। পল্টনে সার্জেন্ট জহিরুল হকের লাশ নিয়ে আসা হল। এখানে জানাজা অনুষ্ঠিত হল। কারফিউ জারী করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে বেরিকেড দিয়ে ছাত্র জনতা মিলিটারী প্রতিরোধ করে। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে প্রায় বিনা উস্কানীতে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডক্টর শামসুজ্জোহাকে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দেয়া সেনাবাহিনীর পক্ষেও অসম্ভব হয়ে উঠে। সারাদেশ থেকে মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। আগরতলা মামলার বিচারকের অস্থায়ী বাস ভবনসহ আইয়ুব খানের ১০ জন মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। ঢাকা সেনানিবাস যে কোন সময় জনগণ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে, এ ধরনের আশংকার কথাও ক্ষমতাসীন মহল চিন্তা করতে থাকে। ১৮ ফেব্রুয়ারি কঠোর কারাফিউ বলবৎ করা হয়। ছাত্র-জনতা শহরের বিভিন্নস্থানে কারফিউ ভেঙ্গে রজপথে নেমে আসে। পরিস্থিতি গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছি।

১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান এক বেতার ভষণে ঘোষণা করলেন, তিনি আর কখনও প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াবেন না। আগরতলা মামলা খারিজ করা হল এবং তিনি বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে বসে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা চান। আনন্দ উল্লেসিত জনতার ঢল নামে রাজপথে। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল বন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঢাকার রেডকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ লক্ষ জনতার অনুমোদনক্রমে তাঁকে বঙ্গবন্ধু অভিধায় ভূষিত করেন। এখানেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘৬ দফা বাঙালির মুক্তির সনদ’। ৬ দফার ব্যাপারে কোন আপোস নেই। যেখানে যার সঙ্গেই সংলাপ হোক না কেন। [সমাপ্ত]


লেখক: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন