মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪৩০, ০৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অভিবাসী সঙ্কট ও পশ্চিমাদের বৈষম্যনীতি

| প্রকাশের সময় : ২৯ জুন, ২০২২, ১২:০২ এএম

দেশে দেশে যুদ্ধ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে। স্বদেশে নিরাপত্তাহীন উদ্বাস্তুরা আন্তজার্তিক সীমান্ত ও সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে পাড়ি দিচ্ছে নিরাপদ জীবনের আশায়। বলাবাহুল্য,মিথ্যা অজুহাতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সামরিক আগ্রাসনে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সরাসরি দায় রয়েছে, একইভাবে ইউক্রেন যুদ্ধের মত চলমান আঞ্চলিক বাস্তবতার জন্যও পশ্চিমা সাম্প্রাজ্যবাদী শক্তি দায়ী। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনের মানুষ সাম্প্রাজ্যবাদী পশ্চিমাদের ভূ-রাজনৈতিক খেলার চরম শিকার হয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে অভিবাসনের জন্য পাড়ি জমাচ্ছে। অন্যদিকে, ফসিল জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং গ্রীনহাউস গ্যাস নি:স্বরণের কারণে বিশ্বের উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন জণিত ক্লাইমেট ভিকটিম বা জলবায়ু উদ্বাস্তুদের চরম পরিনতির জন্যও মূলত শিল্পন্নোত পশ্চিমাদেরই দায় বেশি। কিন্তু সেসব মানবিক দায় পূরণে পশ্চিমাদের অনীহা ও দায়িত্বহীন আচরণ লাখ লাখ মানুষকে মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ভূমধ্যসাগরে হাজার হাজার ভাসমান উদ্বাস্তুদের প্রায়শ: মর্মান্তিক মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মেক্সিকো, কলাম্বিয়ার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তবিরোধ একটি চরম ঐতিহাসিক বাস্তবতা। সেখানে রয়েছে ইউরোপীয় ও মার্কিনীদের ভূমি দখলের ইতিহাস। তাদের দখলবাজি ও লুন্ঠনের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শক্তির ভারসাম্যহিনতার সাথে সাথে অভিবাসী ও উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস সীমান্তে একটি ট্রাকে অর্ধশতাধিক অভিবাসন প্রত্যাশী অথবা পাচারের শিকার হওয়া বিদেশি নাগরিকের মধ্যে ৪৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। চরম সংকটজনক অবস্থায় জীবিত উদ্ধার হওয়া ১৬ জনের মধ্যে অন্তত ৪ জন শিশু ও কয়েকজন নারী রয়েছেন। ভাগ্যবিড়ম্বিত এসব নাগরিকরা কোন দেশের তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবোট এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের নীতিকে দায়ী করেছেন। আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তারা এ ধরণের ঘটনাকে যেভাবেই ব্যাখ্যা করুন না কেন, অভিবাসন সংকটের মত বৈশ্বিক মানবিক সংকটকে স্থানীয় বা আঞ্চলিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিচারে সীমাবদ্ধ রাখা অসম্ভব। এ সপ্তাহে জার্মানীতে অনুষ্ঠিত শিল্পোন্নত বিশ্বের নেতাদের জি-সেভেন বৈঠকে অভিবাসী ক্রসিং সমস্যা নিয়ে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং ফরাসী প্রধানমন্ত্রী ইমানুয়েল ম্যাঁখো আলোচনায় বসেও কোনো ঐক্যমত্য বা সমাধানে আসতে পারেননি। এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, স্বেতাঙ্গ ইউক্রেনীয়রা এখন যুদ্ধের মুখোমুখী হয়ে উদ্বাস্তু হওয়ায় বৃটিশ ও ফরাসি নেতারা এ বিষয়ে একটি ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠার উপর জোর দিতে চাচ্ছেন। তাদের সৃষ্ট সমস্যায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হলেও সেদিকে তাদের কোনো খেয়াল নেই। ইউক্রেনীয়রা শ্বেতাঙ্গ হওয়ায় তাদের প্রতি দরদ উৎলে উঠেছে। তাদের কিভাবে আশ্রয় দেয়া যায়, এ নিয়ে উদ্বেলিত হয়ে পড়েছে। ট্রেনে করে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকার দেশগুলো সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ে তাদেরকে এতটা আগ্রহী বা বিচলিত হতে দেখা যায় না। এটা যে চরম বৈষম্যমূলক আচরণ, তা বুঝতে বাকি থাকে না।

করোনা মহামারী পরবর্তি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, খাদ্য সংকট, কর্মসংস্থান ও মূল্যস্ফীতির মত বিষয়গুলোতে শিল্পোন্নত বিশ্বের নেতাদের তেমন কোনো মাথাব্যথা না থাকলেও চীনের বিআরআই বা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের প্রতাপ ঠেকাতে জি-সেভেন নেতারা ৬০ হাজার কোটি ডলারের তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। পশ্চিমা দেশগুলোর এই বিশাল অংকের বিনিয়োগের সিকিভাগও যদি মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকাসহ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ব্যয় করা হয়, তাহলে বিশ্বের শতকোটি দরিদ্র মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটা সম্ভব। এর ফলে অভিবাসন সংকটের তীব্রতাও কমে আসতে পারে। তবে রাশিয়া ও চীনের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে কথিত এই তহবিল একটি অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও ঠান্ডাযুদ্ধের সূচনা ছাড়া কিছুই নয়। এটা স্পষ্ট, তারা শুধু তাদের স্বার্থে এবং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য বিস্তারে বিশ্বকে একটি ভারসাম্যহীন অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পশ্চিমা নেতাদের এই বৈষম্যনীতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। শুধু ইউক্রেনীয়দের জন্য নয়, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশগুলোর অভিবাসন সংকটের দিকে পশ্চিমাবিশ্বের মনোযোগ দিতে হবে। দেশে দেশে রাজনৈতিক সংকট, দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার কারণেও অভিবাসনের চাপ এবং মানিলন্ডারিংয়ের মত সমস্যা দেখা দিয়েছে। শিল্পোন্নত পশ্চিমা বিশ্বকে এসব বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। অভিবাসন সংকট থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। লিবিয়া বা তিউনিসিয়া থেকে সমুদ্রপথে ইউরোপে পাড়ি জমানো অভিবাসিদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিকের উপস্থিতি দেখা যায়। ভূমধ্যসাগরে বিভিন্ন দেশের কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর অভিযানে অথবা প্রাকৃতিক দুযোর্গ কবলিত নৌযানে আটকে পড়া অভিবাসিদের মধ্যে বাংলাদেশিদের নাম উঠে আসতে দেখা যায়। গতমাসেও ভূমধ্যসাগরে তিউনিসীয় নৌবাহিনীর হাতে আটক হওয়া একটি নৌকায় বিভিন্ন দেশের ৮২জন অভিবাসন প্রত্যাশির মধ্যে ৩২ জন বাংলাদেশী ছিল। অবৈধ অভিবাসন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী পশ্চিমা বিশ্বকেই এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা এবং তা সমাধানে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
আবির ২৯ জুন, ২০২২, ১:৪৩ এএম says : 0
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা ইচ্ছা করলে বিশ্বের মাঝে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে।
Total Reply(0)
আবির ২৯ জুন, ২০২২, ১:৪৪ এএম says : 0
বিশ্বের মাঝে অশান্তি লাগাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা
Total Reply(0)
আবির ২৯ জুন, ২০২২, ১:৪৬ এএম says : 0
মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকার দেশগুলো সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ে পশ্চিমারা আগ্রহী বা বিচলিত হতে দেখা যায় না। এটা যে চরম বৈষম্যমূলক আচরণ, তা বুঝতে বাকি থাকে না।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন